বুদ্ধি বাড়াও খর্বতা দূর করো

বাংলাদেশের মানুষের গড় উচ্চতা খুব বেশি না। পার্বত্য অঞ্চলসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় মানুষের কম উচ্চতা বা খর্বাকৃতি একটি বড় সমস্যা। এটা দূর করতে হলে খাদ্যের সঙ্গে প্রয়োজনীয় পুষ্টিও দরকার। এ বিষয়ে আমরা তেমন সচেতন না। শিশুর জন্মের আগে থেকেই পুষ্টির ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা করা সম্ভব সন্তানসম্ভবা মায়ের পর্যাপ্ত খাদ্য ও পুষ্টির ব্যবস্থা করার মাধ্যমে। মা পুষ্টিকর খাবার খেলে পেটের শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ ও শরীরের গঠন ভালো হয়। শিশুর সুষ্ঠু বিকাশ নিশ্চিত হয়।

শিশুর জন্মের প্রথম ১ হাজার দিন বা প্রায় তিন বছর পর্যন্ত পুষ্টির ভূমিকা খুব বেশি। এরপরও নিশ্চয়ই পুষ্টির প্রয়োজন কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শুরুতে শিশুর মস্তিষ্কে প্রতি সেকেন্ডে ১০ লাখেরও বেশি নিউরন সংযোগ তৈরি হয়। পুষ্টির অভাব মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে।

তার মানে, প্রথমে প্রসূতি মায়ের এবং জন্মের পর থেকে মা ও শিশুর খাদ্যতালিকায় প্রয়োজনীয় অনুপাতে আমিষ, স্নেহজাতীয় পদার্থ (ফ্যাট), আয়রন, জিঙ্ক, আয়োডিন, ভিটামিন-এ ইত্যাদি যেন থাকে, তা নিশ্চিত করা দরকার। এখানে মনে রাখতে হবে শিশুর প্রথম ছয় মাস মায়ের বুকের দুধই যথেষ্ট। বাইরের আর কিছুর দরকার নেই। এমনকি বাইরের পানিরও দরকার নেই। এসব ব্যাপারে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চলতে হবে।

পুষ্টির ব্যবস্থা হলে মস্তিষ্কের বিকাশ নিশ্চিত হবে। শিশু তুখোড় বুদ্ধিমান হবে। চটপটে হবে। স্কুলে পড়াশোনায় এগিয়ে থাকবে। তার দেহের গঠনও ভালো হবে। তরতর করে উচ্চতা বাড়বে। বেঁটে–খাটো থাকবে না।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় অভীষ্ট-২–এ খাদ্য ও পুষ্টির বিষয়ে বলা হয়েছে। সেখানে খর্বাকৃতি দূর করার লক্ষ্যমাত্রার কথাও রয়েছে। কেউ অভুক্ত থাকবে না। এটা যেমন, তেমনি পুষ্টির অভাব দূর করার ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাংলাদেশ গুরুত্ব দিচ্ছে।

সেদিন ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা: খাদ্য ও পুষ্টি প্রতিশ্রুতি’ বিষয়ে প্রথম আলো ও বেসরকারি সংস্থা গেইন-এর উদ্যোগে গোলটেবিল বৈঠকে খাদ্য তো বটেই, সেই সঙ্গে বিশেষভাবে পুষ্টির বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও পুষ্টিতে ঘাটতি রয়েছে। এক হিসাব অনুযায়ী খর্বাকৃতি কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তারপরও দেশে খর্বাকৃতি একটি বড় সমস্যা। তাই পুষ্টির দিকে বেশি নজর দিতে হবে।

আমরা সাধারণত দুই ধরনের ভুল করি। অনেকে মনে করি, পেট ভরে ভাত খেলেই চলবে। সেই সঙ্গে শাকসবজি, মাছ-মাংস, ডিম, দুধ, ফলমূলের দিকে নজর দিই না। ফলে পুষ্টির অভাবে আমরা দুর্বল থেকে যাই। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার অভাব দেখা দেয়।
সারা বছর অসুখ–বিসুখে ভুগতে হয়। আবার আরেক ধরনের ভুল করি। ভাজা-পোড়া, অতিরিক্ত তেল-চর্বিসমৃদ্ধ খাবার খেয়ে শরীর-স্বাস্থ্যের ক্ষতি করি। খাদ্যের ব্যাপারে আমাদের পুরোনো অভ্যাস ও ধ্যানধারণা বদলে দিতে হবে। না হলে আমরা বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারব না। বুদ্ধিতেও খাটো থাকব। উচ্চতায় তো খাটো আছিই। এ পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতে পারব না।

এখন আমেরিকার মতো দেশেও অনেকে চিনি খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। কারণ, চিনি আমাদের স্বাভাবিক পরিপাক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। আমরা যদি পুষ্টিকর খাবার খাই, তাহলে শরীর সেই খাদ্য পরিপাকের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ করে এবং শরীর চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি হিসেবে গ্লুকোজ সঞ্চয় করে। এটাই আমাদের শরীরের স্বাভাবিক কাজ। কিন্তু চিনি সরাসরি শরীরে সঞ্চিত হয় এবং বিপাক প্রক্রিয়া ওলটপালট করে দেয়। ওজন বাড়ে। রোগব্যাধি জন্ম নেয়। তাই একজন আমেরিকান কয়েক বছর আগে চিনির অপকারিতা সম্পর্কে সোচ্চার হন। তিনি এখন শুধু আমেরিকায়ই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ‘অ্যান্টিসুগার গাই’ (চিনিবিরোধী ব্যক্তি) নামে খ্যাতি অর্জন করেছেন।

এটা একটা ছোট্ট উদাহরণ। আমরা না জেনে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অনেক কিছু খাই। সচেতনতার অভাবে আমরা মরছি। দিন–দুনিয়ার খবর না রাখলে আমাদের এগিয়ে যাওয়া কঠিন হবে।

সরকার একটা ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। স্কুলে শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাবারের টিফিন দেবে। শিশুদের প্রতিদিন দুপুরে টিফিনের সময় যদি অন্তত দুটি বাদামি আটার রুটি, একটু সবজি, একটা ডিম ও একটা কলা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করি, তাহলে দেশে বেঁটে মানুষের সংখ্যা দ্রুত কমে আসবে। বুদ্ধিতেও আমরা এগিয়ে যাব।

আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
[email protected]