বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা, তুমি কার?

আমরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়কে শুধু মেধা লালনের তীর্থভূমিরূপে দেখতে চাই, তাহলে ভর্তি পরীক্ষাকে রাখতে হবে সব ধরনের আশঙ্কার বাইরে। ইউএনবি ফাইল ছবি
আমরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়কে শুধু মেধা লালনের তীর্থভূমিরূপে দেখতে চাই, তাহলে ভর্তি পরীক্ষাকে রাখতে হবে সব ধরনের আশঙ্কার বাইরে। ইউএনবি ফাইল ছবি

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা যে উত্কণ্ঠা, অনিশ্চয়তা ও বিভ্রান্তির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন, তাতে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, পরীক্ষাটি আসলে কার জীবনের সঙ্গে যুক্ত। শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক, প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত কিছু মানুষ, রাজনৈতিক ব্যক্তি, প্রভাবশালী মহল, কোচিং–বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, স্বজন-তোষক, গদি আঁকড়ে থাকা তাঁবেদার, উন্নয়নকামী দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসকারী নব্য-উপনিবেশীর দোসরের?

যদি শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ও মর্যাদা বজায় মূল বিবেচ্য হয়, তাহলে এ পরীক্ষা শিক্ষার্থীর এবং এ জন্য কেন্দ্রীয় বা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হবে আত্মঘাতী। অভিযোগ আছে, শিক্ষকেরা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন এই পরীক্ষা থেকে অর্জিত ‘বিপুল অর্থ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়’।

একটি তথ্য হচ্ছে, ২০১৯ সালে ভর্তি পরীক্ষা থেকে সিলেকশন গ্রেডের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের আয় ছিল ৯ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে এ পদের একজন অধ্যাপকের সপ্তাহখানেকের পরিশ্রমের পর ১০০টি প্রশ্ন এবং তার উত্তর তৈরি করার জন্য তাঁর ‘মজুরি’ ছিল ৩ হাজার টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নির্দেশ আছে নিজস্ব তহবিল তৈরি করার, যেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ হবে। এ কারণে ফরম বিক্রির মোট আয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ৪০ শতাংশ কেটে রাখে। বাকি ৬০ শতাংশ থেকে ভর্তিপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত আইসিটি বিভাগ, ক্যাম্পাসের পুলিশ বাহিনী, ভ্রাম্যমাণ আদালত ইত্যাদির ব্যয় বহনের জন্য কর্তৃপক্ষ আরেকটি অংশ কেটে রাখে। বাকি টাকা এই পরীক্ষা গ্রহণকারী তিনটি ইউনিটকে দেওয়া হয়।

ভর্তিপ্রক্রিয়ার শুরু থেকে শেষ ধাপ পর্যন্ত সব ধরনের ব্যয় বহনের পর যে টাকা থাকে, তার ১০ শতাংশ প্রতিটি বিভাগকে দেওয়া হয় ‘উন্নয়ন তহবিল’ হিসেবে। এই অর্থ ব্যবহৃত হয় শুধু শিক্ষার্থীদের কল্যাণ খাতে, যেমন দরিদ্র ও অসুস্থ শিক্ষার্থীদের আপত্কালীন সহায়তা, কেবল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের উন্নয়নের জন্য। এখানে শিক্ষকদের জন্য ব্যয় করার কোনো সুযোগ নেই। এসব খাতে বণ্টনের পর যে কিঞ্চিৎ অর্থ থাকে, তা বণ্টন করা হয় ইউনিটের সব শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও অনুষদ-কর্তাদের মধ্যে। আর্থিক লাভ যদি না-ই হয়, তবে শিক্ষকেরা কেন এর বিপক্ষে? এর অন্যতম কারণ, প্রশ্নপত্র ফাঁস, দুর্বল অবকাঠামোসংবলিত নতুন কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে জালিয়াতি, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদির আশঙ্কা।

অনেক কলেজের পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোতে জালিয়াতি বা নকল করতে না দেওয়ার কারণে পরিদর্শক–শিক্ষকদের মারধর, স্থানীয় দলবাজদের পরীক্ষাকেন্দ্র দখল বা খোদ পরিদর্শকদেরই নকলে সহযোগিতার অভিযোগ আমরা গণমাধ্যমগুলোতে দেখি। আঞ্চলিকতার কারণে পরীক্ষাকেন্দ্রে স্বজনপ্রীতি বা স্থানীয় প্রভাবশালীদের উৎপাতের আশঙ্কা থাকে, ফলে রাজনৈতিক কর্মী বা কম মেধাবীদের ভর্তির সুযোগ বেড়ে যায়, মেধাবীটি ঝরে পড়ে। অন্তত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকম ঘটনা সম্ভব নয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশ্নপত্র তৈরি, ছাপানো, সংরক্ষণ, সরবরাহ, জবাবদিহির প্রক্রিয়া এবং পরীক্ষাকেন্দ্রে নিবিড় পর্যবেক্ষণের কারণে ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগ আজ পর্যন্ত ওঠেনি। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার প্রক্রিয়ায় অনেক বেশিসংখ্যক ধাপ থাকবে, কোনো একটি ধাপে প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও জবাবদিহির জায়গাটি সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা দুরূহ হয়ে পড়বে।

এখন দেখা যাক সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার পক্ষে কারা কথা বলছেন এবং কেন:

১. যাঁরা নিঃস্বার্থভাবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভোগান্তি কমাতে চান। কিন্তু সমস্যা হলো, তাঁদের অধিকাংশই দুই পদ্ধতির প্রক্রিয়া সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত নন। ফলে বিষয়টির অতিসরলীকরণ ঘটে এবং তাঁরা মুদ্রার অন্য পিঠের কথা ভাবেন না। ফলে তাঁরা নিজের মেধাবী এবং রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাহীন সন্তানকে নিজের অজান্তে ঝরে পড়তে সাহায্য করেন।

২. প্রশাসনের সেই সব ব্যক্তি যাঁরা স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষায় যুক্ত হতে পারেন না, তাঁরা সমন্বিত পদ্ধতির কোনো একটি ধাপে সংশ্লিষ্ট হওয়ার জায়গা খুঁজে নেন।

৩. দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে জড়িত কিছু ব্যক্তি ও শিক্ষক যাঁরা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কোনো একটি ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতার সুযোগে রাজনৈতিক কর্মী বা নিজের কম মেধাবী সন্তান বা প্রার্থীকে ভর্তি করানোর সুযোগ খোঁজেন। এসব ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি, প্রশ্নপত্র ফাঁস, টাকার লেনদেন ইত্যাদির সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে কোচিং–বাণিজ্য আরও বিস্তৃত হওয়ার সুযোগ ঘটে।

৪. বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি যাঁরা শিক্ষক নিয়োগ, প্রশাসন, টেন্ডার ইত্যাদির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করেন, কিন্তু শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে এখনো নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পাননি।

৫. প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত কিছু শিক্ষক যাঁদের দায়িত্ব, ক্ষমতা ও সুযোগ ছিল পুরো প্রক্রিয়ার উভয় পিঠ সরকার ও জনগণকে অবহিত করা, তাঁরা ‘জো হুকুম জাহাঁপনা’ নীতিতে অটল থেকে পদ আঁকড়ে থাকতে চান বা নতুন পদের সন্ধানে থাকেন।

এখন আমাদের উচিত স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভোগান্তি কমানোর পথ খুঁজে বের করা। নিচের পদক্ষেপগুলো বিবেচনায় আনা যেতে পারে:

১. ভর্তি ফরম বিনা মূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে শিক্ষার্থীদের দেওয়া হোক। বাকি ব্যয় নির্বাহের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্ধারিত বরাদ্দ দেওয়া হোক। বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যয় নির্বাহের জন্য নিজস্ব তহবিল তৈরির পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত।

২. রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে জনগণের সম্পৃক্ততার উদ্যোগ নেওয়া যায়। যাতায়াতের দুই দিন এবং পরীক্ষার দিন আন্তনগর ট্রেনের টিকিট, বাস ও লঞ্চে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রবেশপত্র যাচাই সাপেক্ষে পরীক্ষার্থী ও তাঁর একজন অভিভাবকের টিকিটে বড় ছাড় দেওয়া বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বসে থাকা বিরাটসংখ্যক বাসকে শহরের ভেতর পরীক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য চালু করা যেতে পারে।

৩. হোটেল ব্যবসাকেও এই ছাড়ের অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। সমাজের বিত্তবান শ্রেণির মানুষেরা একত্র হয়ে ইউনিটভিত্তিক শিক্ষার্থীদের জন্য খাবার সরবরাহের উদ্যোগ নিতে পারেন। কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও খুব সীমিত আকারে এগিয়ে আসতে পারে।

৪. এসব ক্ষেত্রে পরিবহন ব্যবসা, হোটেল ব্যবসার মালিক ও এসব সমিতির নেতা ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সঙ্গে সভা এবং জনগণকে এর সঙ্গে সম্পৃক্তকরণের জন্য নাগরিক সমাবেশের আয়োজন করা যেতে পারে।

৫. সমন্বিত ভর্তিপ্রক্রিয়া এবং স্বতন্ত্র ভর্তিপ্রক্রিয়া সম্পর্কে জনগণকে অবগত করার জন্যও নাগরিক সমাবেশ করা যায়। পাশাপাশি শিক্ষাবিদ, পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকের এবং জনসাধারণের মতামত জানার জন্য এ বিষয়ে তাঁদের ওপর ক্ষুদ্র পর্যায়ে জরিপ করা প্রয়োজন।

৬. শিক্ষকদের মতামত যাচাইয়ের জন্য একাডেমিক কাউন্সিলের সভা আহ্বান করা প্রয়োজন, যেখানে সব শিক্ষকের মতামতের প্রতিফলন ঘটবে।

৭. বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক পরিষদের ভর্তি পরীক্ষাসংক্রান্ত সভায় সব ডিন ও বিভাগীয় সভাপতিদের সংযুক্ত করা প্রয়োজন। কারণ, তাঁরা এসব কাজে সরাসরি সংশ্লিষ্ট থাকেন এবং পরীক্ষা পদ্ধতির সুবিধা–অসুবিধা সম্পর্কে জ্ঞাত।

আমরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়কে শুধু মেধা লালনের তীর্থভূমিরূপে দেখতে চাই, তাহলে এই পরীক্ষাকে রাখতে হবে সব ধরনের আশঙ্কা ও ঝুঁকির বাইরে, সব ধরনের আধিপত্যমুক্ত।

ড. সুলতানা মোস্তাফা খানম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক
[email protected]