বুনো পূর্বের পাপিয়া ও নৈরাজ্যিক পুঁজিবাদ

একের পর এক কুৎসিত গল্প বেরিয়ে আসছে। সেই সঙ্গে নানা চরিত্রও। চমকের যেন শেষ নেই। এসব চমকে আছে সম্রাটের মতো জুয়ার আসরের গডফাদার, পাপিয়ার মতো রাজনৈতিক নেত্রী ও যৌনকর্মী সরবরাহকারী, বাড়িভর্তি সিন্দুক আর সিন্দুকভর্তি অবৈধ টাকার মজুত। আছে ব্যাংক ও শেয়ারবাজার তছনছকারীদের দল। এখানে–সেখানে চলছে অস্ত্রের ঝনঝনানি। প্রতিপক্ষকে ফেলে দেওয়ার জন্য চলছে রক্তাক্ত লড়াই। সন্তানকে টেলিফোনের অপর প্রান্তে রেখে মেরে ফেলা হচ্ছে বাবাকে। চোখের সামনেই মেরে ফেলা হচ্ছে মাকে। মায়ের ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে মেয়ে। কী নেই এখানে। যেন বুনো পশ্চিমের (ওয়াইল্ড ওয়েস্ট) দৃশ্য নতুন করে চিত্রায়িত হচ্ছে এ দেশে। নানা ঘটনার পরও বুনো পশ্চিমের কাহিনিগুলোয় যাঁরা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারতেন, তাঁরাই হর্তাকর্তা বনে যেতেন। ওয়েস্টার্ন কাহিনি ও সিনেমাগুলোয় জো জিতা ওহি সিকান্দার। আমাদের এখানেও যাঁরা টিকে যান, তারাই নগরপিতা বা মাতা হন, এমনপি হন, রাজনীতিবিদ বনে যান। পাপিয়া, সম্রাটেরা কোনো কারণে টিকতে পারেননি, তাই আরও বড় হতে পারলেন না। আরও কিছুদিন টিকে থাকতে পারলেই পাপিয়া, সম্রাটেরা এমপি না হন, নিদেনপক্ষে মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করতে পারতেন।

শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, ব্যাংকের লুটপাট, বালিশ–কাণ্ড, ক্যাসিনো সাম্রাজ্য দেখে মনে হচ্ছে, দেশে একধরনের ‘অ্যানার্কো ক্যাপিটালিজম’ বা ‘নৈরাজ্যিক পুঁজিবাদ চলছে। যে যেভাবে পারছে লুটেপুটে নিচ্ছে সব। ‘অ্যানার্কো ক্যাপিটালিজম’ সম্পর্কে সম্যক ধারণার জন্য বুনো পশ্চিমের ইতিহাসে ঘুরে আসা যাক।

বুনো পশ্চিমের ইতিহাস আমাদের কমবেশি অনেকেরই পড়া আছে। কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে বাফেলো শিকার, স্বর্ণের খোঁজে পশ্চিমে যাত্রা, পথিমধ্যে কোনো সরাইখানায় বিশ্রাম নেওয়ার কালে ব্যাংক ডাকাতদের সঙ্গে লড়াই, চকিতে গুলি করে কয়েকজনকে ধরাশায়ী করা, পিস্তল চালানোয় দক্ষতা দেখে বারটেন্ডারের অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকা, শৈশবের বান্ধবীকে ফিরে পাওয়া—একসময়ের আমেরিকার গল্প। বাস্তবের জমিনের ওপর ভিত্তি করেই এসব গল্প বেড়ে উঠেছে। বুনো পশ্চিমের গল্পের পাতায় পাতায় আছে দখল, মাদক, গোলাগুলি, ধর্ষণ-হত্যার এক নির্মম বিবরণ। বুনো পশ্চিম বলতে মূলত যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপি নদীর পশ্চিম তীরের ভূখণ্ডকেই নির্দেশ করা হয়। যেখানে আদিবাসীদের বসবাস ছিল। বাইসন, বুনো মহিষ ঘুরে বেড়াত। আর ছিল কামাচিদের সাম্রাজ্য। এমন না যে আদিবাসীরা বুনো ছিল; বরং ইউরোপীয়রাই সম্পদ দখল করতে গিয়ে পশ্চিমে এক বুনো লড়াইয়ের ক্ষেত্র তৈরি করে। কামাচি সাম্রাজ্যকে ইউরোপীয়রা ধীরে ধীরে দখলের প্রতিযোগিতায় নামে এবং পুরোটাই শেষ পর্যন্ত দখল করে নেয়।

দখলের পর ইউরোপীয় ধারার নতুন নতুন শহর গড়ে ওঠে পশ্চিমে। তৈরি হয় র‌্যাঞ্চ। খনিগুলো কবজা করা হয়। স্থাপন করা হয় রেলপথ। পোঁতা হয় টেলিগ্রাফের খুঁটি। পুরো পশ্চিমকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গড়ে ওঠে একধরনের মাফিয়াকেন্দ্রিক অর্থনীতিও। ভূমি ও খনির দখল বজায় রাখা, র‌্যাঞ্চের সুরক্ষার জন্য বেসরকারি উদ্যোগে শহরগুলোয় স্থানীয় বাজারভিত্তিক আইন গড়ে ওঠে। একেক শহরের একেক ধরনের আইন ছিল। সংঘবদ্ধ অস্ত্রধারীরা খনিজ ভর্তি ট্রেনের বগি পাহারা দিত। অস্ত্রধারী প্রতিপক্ষ খনিজ সম্পদ লুটের উদ্দেশ্যে ওত পেতে সময় সুযোগমতো হানা দেওয়ার চেষ্টা করত। দখল, লুটপাট, হত্যা, রক্তপাতের অর্থনৈতিক চক্রকে সমাজবিজ্ঞানীরা বলেছেন ‘অ্যানার্কো ক্যাপিটালিজম’। অ্যানার্কো ক্যাপিটালিজমের দাঙ্গা–ফ্যাসাদের ভেতর থেকেই হলিউডের গল্পকাররা সিনেমার মাল-মসলা খুঁজে পেয়েছেন।

টেরি অ্যান্ডারসন ও পি জে হিল বুনো পশ্চিমের ‘অ্যানার্কো ক্যাপিটালিজম’ ধারণাটি সামনে নিয়ে আসেন। তাঁদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বারবারা হ্যারিস ও লুসিয়া মিচেলুত্তি দক্ষিণ এশিয়ায় ‘অ্যানার্কো ক্যাপিটালিজম’–এর একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। ১৭, ১৮ ও ১৯ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বুনো পশ্চিমের লড়াই ছিল সম্পদ দখলকে কেন্দ্র করে। বর্তমান সময়েও বুনো পশ্চিমের সেই দখলকেন্দ্রিক ধারণা ও লড়াই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় কতটা প্রাসঙ্গিক তা ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বিভিন্ন ঘটনার আলোকে প্রমাণের চেষ্টা করেছেন বারবারা হ্যারিস ও লুসিয়া মিচেলুত্তির সম্পাদনায় প্রকাশিত বই ‘দ্য ওয়াইল্ড ইস্ট: ক্রিমিনাল পলিটিক্যাল ইকোনমি ইন সাউথ এশিয়া’–এর লেখকেরা। গবেষকেরা এই বইয়ে তুলনা করে দেখিয়েছেন, কীভাবে বুনো পশ্চিমের ১৮ বা ১৯ শতকের অর্থনৈতিক কাঠামোর মাফিয়াতন্ত্রের সঙ্গে বুনো পূর্বের সাংঘাতিক মিল রয়েছে। বুনো পশ্চিমের সম্পদের ওপর দখলদারি, প্রযুক্তির আবির্ভাব, ছোট বা মাঝারি শিল্পের সঙ্গে বড় বড় পুঁজির সংঘাত, সবই বিদ্যমান বুনো পূর্বে। এখন হয়তো সেই বুনো পশ্চিমের মতো কেউ র‌্যাঞ্চ দখলে যায় না, তবে জমি দখল হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন উপায়ে। আর এর পুরোভাগে থাকছে বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান। আইনও তৈরি হয় করপোরেটদের পক্ষেই। এখন দখলের পদ্ধতিগত পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু দখল করার মনোভাবের খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। বুনো পশ্চিমে আদিবাসীদের জমি দখল করে র‌্যাঞ্চ প্রতিষ্ঠা করা হতো। এখন আবাসন প্রকল্পের নামে দখল হয়ে যাচ্ছে ভূমি। বুনো পশ্চিমে হোলস্টারের পিস্তল, কাঁধে রাইফেল নিয়ে ঢুকে ব্যাংক ডাকাতি করা হতো। এখন করা হয় ঋণ খেলাপের মাধ্যমে। উভয় ক্ষেত্রেই বন্দুক অথবা রাজনৈতিক ক্ষমতা হলো হাতিয়ার। নিমেষেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তহবিল থেকে রিজার্ভের মুদ্রা হাওয়া হয়ে যায়। ক্যাসিনো, জুয়ার বোর্ড তখনো ছিল, এখনো আছে।

‘অ্যানার্কো ক্যাপিটালিজম’–এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সেখানে রাষ্ট্রের সমান্তরালে কালো অর্থনীতিনির্ভর একটি ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। অবশ্য কালো ও সাদা অর্থনীতির তফাত করা খুবই কঠিন। বরং বলা যায় অ্যানার্কো ক্যাপিটালিজমে সাদা ও কালো অর্থনীতির সংমিশ্রণ ঘটে। আমাদের অর্থনীতিতে সাদা ও কালো সংমিশ্রণ নিয়ে দ্য ওয়াইল্ড ইস্ট: ক্রিমিনাল পলিটিক্যাল ইকোনমি ইন সাউথ এশিয়া’ বইয়ে একটি অধ্যায় লিখেছেন নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আরিল্ড এনগেলসেন রুড।

আরিল্ডের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর দৈনন্দিন ও নির্বাচনী ব্যয় নির্বাহের জন্য নিয়মিত কোনো তহবিল নেই। দলগুলোর তহবিলের জোগান আসে মাফিয়াদের থেকেই। বিনিয়ময়ে তাঁরা পেয়ে থাকেন রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা। সঙ্গে দেওয়া হয় টেন্ডারবাজির নামে রাষ্ট্রীয় তহবিল লুটপাটের লাইসেন্স। রাজনৈতিক সুবিধা পেয়ে লুটপাট ও দখলের মহা উৎসবে মেতে ওঠে দুর্বৃত্তরা। যত্রতত্র গড়ে ওঠে ক্যাসিনোর আসর, পাপিয়াদের আখড়া। নাগরিকের হাতে যখন অবৈধ টাকা চলে আসে, তখন তা ব্যয়ের পথও বের করে নিতে হয়।

সন্দেহ নেই, দেশে বুনো পশ্চিমের আদলে অ্যানার্কো ক্যাপিটালিজমের যুগ চলছে। তবে বুনো পশ্চিমের সঙ্গে বুনো পূর্বের একটি অমিল রয়েছে। পশ্চিমের দখল, লুটপাট ছিল নিয়ন্ত্রণহীন। বুনো পূর্বে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণেই লুটপাট চলছে। যে যার মতো মেরেকেটে নিচ্ছে। রাষ্ট্রই এই পথ করে দিচ্ছে। কেবল নিজেদের মধ্যে হিসাব–নিকাশে গন্ডগোল হলেই দু-একটি ঘটনা আলোচনায় আসে। এমন না যে আরামবাগে ক্যাসিনো ও জুয়া সংগোপনে খেলা হতো। টানা তিন মাস পাপিয়া অভিজাত এলাকায় পাঁচ তারকা হোটেলের স্যুইট ভাড়া করে রাখলেন কাকপক্ষীরও অজান্তে? আচমকা চৌকস আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই বিশাল অনিয়ম ও দুর্নীতি খবর বের করে ফেলেছে। বরং সবার নাকের ডগাতেই এসব হয়েছে। পাপিয়ার গ্রাহক ছিলেন সমাজের উঁচুতলার লোকজন। তাই কেউ কিছুই জানত না—এটা বিশ্বাস করা খুবই মুশকিল।

বুনো পশ্চিমে শেরিফের সামনেই বন্দুকযুদ্ধ হতো। শেরিফের দায়িত্ব ছিল পরাজিতের সমাহিতের ব্যবস্থা করা। আমাদের এখানেও প্রকাশ্যেই সব হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকরী বাহিনীর কাজ হচ্ছে পতিত ক্ষমতাহীন পাপিয়া, সম্রাটদের আটক করে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলন করা। কার্যত, এরা সবাই ‘অ্যানার্কো ক্যাপিটালিজম’–এর ফল। এ রকম হাজার হাজার পাপিয়া, সম্রাট আশপাশের সক্রিয়। সময় শেষ হলেই এদের পতন ঘটে। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে এটা মানতেই হবে, এই যুগে এসেও আমরা যেন বুনো পশ্চিমের আমলেই বসবাস করছি।

ড. মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক