ভারতে হিংসার রাজনীতির বিস্ফোরণ

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। হায়দরাবাদ হাউস, নয়াদিল্লি, ২৫ ফেব্রুয়ারি। ছবি: এএফপি
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। হায়দরাবাদ হাউস, নয়াদিল্লি, ২৫ ফেব্রুয়ারি। ছবি: এএফপি

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যখন স্যামন মাছের টিক্কা, খাসির বিরিয়ানি এবং হ্যাজেলনাট আপেলের পাই দিয়ে রাজকীয় ভোজে ব্যস্ত, তখন গুরু তেগ বাহাদুর হাসপাতালে শহীদ খানের (২২) পরিবার বোঝার চেষ্টা করছিল, কেন তিনি খুন হলেন। রিকশাচালক শহীদ, চার ভাইয়ের সবার ছোট, কুখ্যাত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে ভারতের রাজধানীতে চলমান দাঙ্গায় নিহত ব্যক্তিদের একজন।

দশকের পর দশক দিল্লি এমন নিকৃষ্ট সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দেখেনি। নয়াদিল্লি যখন যুদ্ধক্ষেত্র, তখন রাষ্ট্রপতি ভবনে অতিথি ট্রাম্পকে ঘিরে চলছে এক বেসুরো ও পরাবাস্তব উৎসব। ট্রাম্পের এই সফর ঝামেলামুক্ত—স্বভাবের বাইরে গিয়ে তিনি বেশ সংযমী, লিখিত ভাষণের বাইরে কিছু বলছেন না। ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে একেবারে কাঙ্ক্ষিত সব। তবু কোনো অঙ্গীকার বা চুক্তিস্বাক্ষর তিনি করেননি। সবই ঠিক ছিল। কিন্তু সহিংসতা একলহমায় সংবাদের শিরোনাম থেকে প্রেসিডেন্টকে সরিয়ে দিল—এমনকি মোদি সরকারপন্থী ওয়েবসাইটেও তিনি নেই।

ট্রাম্পের এই সফরের সময় ভারতের ভাবমূর্তির চূড়ান্ত প্রদর্শনী দেখানোর কথা ছিল। বিশ্বের বৃহত্তম ও আদিতম দুই গণতন্ত্রের মিলনের মহা উদ্‌যাপন হওয়ার কথা ছিল। ট্রাম্পের জন্য এটা ছিল মার্কিন নির্বাচনের বছরে ভারতীয় দর্শকদের চমক দিয়ে বিত্তবান ও প্রভাবশালী ভারতীয় আমেরিকানদের কাছে টানার সুযোগ। মোদিও চাইছিলেন দিল্লির নির্বাচনী পরাজয়ের প্রসঙ্গ, ধুঁকতে থাকা অর্থনীতি এবং বৈশ্বিক গণমাধ্যমের নেতিবাচক প্রচার খবরের শিরোনাম থেকে হটিয়ে দিতে।

অথচ কিনা গোটা দুনিয়ার চোখের সামনে ফেটে পড়ল ভারতের হিংসার রাজনীতির চেহারা। এক শহরে একসঙ্গে বাস করতে থাকা হিন্দু ও মুসলিমরা সংঘর্ষে জড়িয়েছে। আইন ও শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। পুলিশ কেবল অথর্বই নয়, হামলায়ও জড়িত। সরকারি কর্মকর্তারা ঘটনাকে নাগরিকত্ব আইনের পক্ষ–বিপক্ষের সংঘাত বলে দেখাতে চাইলেও এবং প্রাথমিক খবরে উভয় শিবিরের হামলার কথা এলেও দিনের শেষে পরিষ্কার হয়ে যায় যে এই সংগঠিত ও খোলাখুলি সন্ত্রাস একপক্ষীয়ভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে। উন্মত্ত দঙ্গল বেছে বেছে যখন মুসলমানবাড়িতে ঢুকে তাদের টেনে বের করে আনছিল, তখন অনেকেই পুলিশের জরুরি হেল্পলাইনে ফোন করেছে। পোড়ানো মসজিদের মিনারে উঠে পড়েছে দাঙ্গাবাজেরা।

পুলিশ পাশেই দাঁড়িয়ে থেকেছে হয় অপ্রস্তুত অবস্থায়, নয়তো জড়িয়ে পড়েছে স্বেচ্ছায়। পুলিশের এক হেড কনস্টেবল নিহত এবং ৫০ জনের বেশি আহত হলেও তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক ধসের বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। একটা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ আশপাশে থাকা অবস্থায় জনতার দঙ্গল লাঠি–ঢিল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আরেকটা ভিডিওতে দেখা যায়, একদল লোক যখন হাত জোড় করে ক্ষমা চাইছে, তখন পুলিশ তাদের জোর করে জাতীয় সংগীত গাওয়াচ্ছে।

ট্রাম্পের সফরের সময় ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইনকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে দিল্লিতে। ছবি: রয়টার্স
ট্রাম্পের সফরের সময় ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইনকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে দিল্লিতে। ছবি: রয়টার্স

দিল্লির পুলিশ চলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর কথায়। দেশের দ্বিতীয় প্রধান ক্ষমতাবান ব্যক্তি তিনি। পরিস্থিতি নিয়ে একাধিক বৈঠক করলেও অন্য সময়ে সরব এই মন্ত্রী এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে কিছুই বলেননি। মঙ্গলবার পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীও হানাহানি বিষয়ে মুখ খোলেননি। একটা সংবাদ সম্মেলনে দাঙ্গা ও নাগরিক আইন বিষয়ে প্রশ্নের মুখে পড়লে ট্রাম্প শুধু মাথা নাড়িয়ে বিষয়টা স্বীকার করেন এই বলে যে মোদির সঙ্গে ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ে তাঁর কথা হয়েছে। তাঁর মতে, ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য মোদি ‘অবিশ্বাস্য’ ও ‘কঠিন পরিশ্রম’ করে চলেছেন।

ব্যস, এটুকুই। ট্রাম্পের এই মামুলি প্রতিক্রিয়া এবং ভারত সরকারের শীর্ষ মহলের নীরবতা আশঙ্কাজনক। হতাহত ব্যক্তিদের সংখ্যা বাড়তে থাকলেও তাঁদের চিন্তিত মনে হয়নি। এর এক দিন আগেই, শাসক দলের নেতা কপিল মিশ্র নাগরিকত্ব আইনের বিরোধীদের রাস্তা থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার হুমকি দিয়েছিলেন। এটা বলার সময় তাঁর পাশে পুলিশ কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে ছিলেন।

মাসাধিক কাল ধরে তারা প্রতিবাদ করছে। বসে থাকছে, মিছিল করছে নয়াদিল্লির বিভিন্ন জায়গায়। এসবের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল শাহিনবাগে মুসলিম নারীদের বিক্ষোভ। তাঁদের এই বিক্ষোভ ছিল শান্তিপূর্ণ এবং ভারতীয় হিসেবে গর্বিত। স্বাধীনতা আন্দোলন ও ভারতের সংবিধানের জয়গান ছিল তাঁদের কথায়।

কিন্তু আচমকা সন্ত্রাস দেখা দিল এবং ছড়িয়ে পড়ল। জ্বালাময়ী বক্তৃতায় বলা হলো, ‘রাস্তা ছাড় দেশ ছাড়’। একদল লোক আমাকে জানিয়েছে, তাদের মিশন হলো নাগরিক আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন বন্ধ করে দেওয়া। ‘এমনকি ট্রাম্পও জানেন যে এখানে কিছু ভুল ধর্ম ও ভুল লোক আছে’, মুসলিম নাগরিকদের বিরুদ্ধে খোলাখুলি ঘৃণা নিয়ে তাদের একজন বলছিল আমাকে।

মোহাম্মদ ফুরকান (৩২) নামের নিহত একজনের ভাই সরাসরি ক্ষমতাসীন দলকে দায়ী করেন। তাঁর কথায়, বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র এই সহিংসতা উসকে দিয়েছেন। জনাব মিশ্র অবশ্য তাঁর হুমকি পরিষ্কার করেই দিয়েছেন, ‘যতক্ষণ ট্রাম্প আছেন, ততক্ষণ আমরা শান্তি বজায় রাখব।’ তাঁরা অবশ্য বেশি অপেক্ষা করেননি।

বারখা দত্ত: ভারতীয় সাংবাদিক।
(যুক্তরাষ্ট্রের দৈনিক পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্ট–এর ওয়েবসাইটে বুধবারে প্রকাশিত। ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন ফারুক ওয়াসিফ)