ট্রেন থেকে প্ল্যাটফর্ম নিচু

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, তিনি কৌরবদের মৃত্যু আগেই নিশ্চিত করে রেখেছেন, অর্জুন নিমিত্তমাত্র। দেখা যাচ্ছে, সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এ কথাকে আক্ষরিক অর্থে আত্মস্থ করেছেন। তাঁরা নাগরিক সুরক্ষার মৌলিক বিষয়গুলোকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে এমন কিছু মৃত্যুফাঁদ রচনা করে রেখেছেন, তাতে নিশ্চিতভাবে মানুষ মারা যাবে। যাচ্ছেও। লোকে জানছে তারা দুর্ঘটনায় মরছে। আপাতদৃষ্টে প্রতীয়মান ‘দুর্ঘটনাজনিত’ এসব প্রাণহানি কার্যত পূর্বনির্ধারিত হত্যাকাণ্ড। 

খুলনায় সম্প্রতি সেই মনুষ্যকৃত বিপর্যয়ের নমুনা দেখা গেল। প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, খুলনার আধুনিক রেলস্টেশন চালুর আগেই জানা গিয়েছিল, ট্রেনের বগির পাটাতন থেকে প্ল্যাটফর্ম অনেক নিচু হচ্ছে। এতে ট্রেনে উঠতে ও ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে মৃত্যুঝুঁকিতে পড়বে যাত্রীরা। ট্রেনের বগি ও প্ল্যাটফর্ম যাতে সমান থাকে, রেলস্টেশন উদ্বোধনের আগেই সেই দাবি করেছিল বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী ও নাগরিক সংগঠন। তারা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপিও দিয়েছিল। কিন্তু সেই দাবিকে পাত্তা না দিয়ে পূর্বনির্ধারিত নকশার প্ল্যাটফর্ম বানানো হয়েছে। ট্রেনের পাটাতন থেকে প্ল্যাটফর্ম প্রায় ২ ফুট নিচু। বগি ও প্ল্যাটফর্মের মধ্যে প্রায় ১৪ ইঞ্চি ফাঁকা জায়গা।

গত শনিবার ট্রেনে উঠতে গিয়ে হাত ফসকে ট্রেন ও প্ল্যাটফর্মের ওই ফাঁকা জায়গায় পড়ে কাটা পড়েন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মো. মিজানুর রহমান ভূঁইয়া। এ মৃত্যুর জন্য খুলনার নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সাংবাদিক, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার
মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলছেন, এ মৃত্যু আধুনিক রেলস্টেশনের ত্রুটি ও জনগণের যৌক্তিক দাবি উপেক্ষার বিষয়টি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। 

দায়বদ্ধতার প্রশ্নের ‘যেনতেন প্রকারেণ’ জবাব দিতে এ দেশে ‘বিভাগীয় তদন্ত’ নামক একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়। আলোচনাটি বিস্মৃতিতে তলিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ‘তদন্ত’ চলতে থাকে। এ ক্ষেত্রেও সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যাঁরা প্ল্যাটফর্ম ও ট্রেনের প্রাণঘাতী ত্রুটির বিষয়ে আগেই সরকারকে হুঁশিয়ার করেছিলেন, এখন তাঁদের ক্ষোভ প্রশমনে ওই শিক্ষকের মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি করেছে। তদন্ত প্রতিবেদন শেষ পর্যন্ত প্রকাশিত হলেও তাতে হয়তো মৃত্যুর জন্য হতভাগ্য ওই শিক্ষককেই দায়ী করা হবে। কিন্তু সর্বজনজ্ঞাত কারণটি বিদগ্ধ তদন্ত কর্মকর্তাদের অজ্ঞাতই রয়ে যাবে। সেই ত্রুটির জন্য আগের মতোই ট্রেনে উঠতে এবং ট্রেন থেকে নামতে ভোগান্তির মধ্যে পড়তে থাকবেন নারী-শিশু, বয়স্ক ও অসুস্থ মানুষেরা। আবার হয়তো কেউ ‘অসতর্ক হয়ে’ ট্রেনে উঠতে অথবা ট্রেন থেকে নামতে যাবেন এবং চাকার নিচে পড়ে কাটা পড়বেন। আবার তদন্ত কমিটি গঠিত হবে। 

নাগরিক সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে অবিলম্বে এ ‘বহুল মঞ্চস্থ নাটক’ থামানো দরকার। তাতে অন্তত কিছু অমূল্য প্রাণ বাঁচবে।