পরিবহনমালিকদের দৌরাত্ম্য

গত সোমবার ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এর প্রধান শিরোনামটি আনওয়ান্টেড অবস্ট্রাকশন। অনাকাঙ্ক্ষিত বাধা। সড়ক পরিবহন খাতটির নিয়ন্ত্রণ এখন আর রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির হাতে নেই, এটি চলছে বেসরকারি পরিবহনমালিক-শ্রমিকের কথায়। খবরের সারকথা হলো বিআরটিসি নতুন কোনো রুটে বাস নামাতে গেলেই বেসরকারি পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের বাধার মুখে পড়ে। বিশেষ করে কোনো রুটে দ্বিতল বাস নামাতে গেলেই তাঁরা ধর্মঘট ডেকে জনজীবন অচল করে দেওয়ার মতো চরম পদক্ষেপ নিতেও দ্বিধা করেন না। আর এসব অন্যায় কাজে পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা ব্যবহার করছেন ১৬ বছর আগের একটি কালো চুক্তি, যেটি সই হয়েছিল বিএনপি আমলের যোগাযোগমন্ত্রী নাজমুল হুদার নির্দেশে। 

পত্রিকার প্রতিবেদনমতে, সম্প্রতি সরকার বিআরটিসির গাড়িবহরে আরও ৬০০ বাস যুক্ত করেছে। আরও বেশ কিছু বাস কেনার প্রক্রিয়ায় আছে। গত ডিসেম্বরে বিআরটিসি ময়মনসিংহ অঞ্চলে দ্বিতল বাস নামালে বেসরকারি বাসমালিকেরা ধর্মঘট ডাকেন। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে
সেই ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়। তবে সেটি মালিকদের দাবি মেনেই। বিআরটিসি দ্বিতল বাস নামাবে না এবং নিয়মমাফিক একতলা বাস চালাবে—এ শর্ত মেনে নেওয়ার পর বেসরকারি পরিবহনমালিকেরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন। চলতি মাসের গোড়ার দিকে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী তাঁর নির্বাচনী এলাকা রংপুর-৬-এ দ্বিতল বাস সার্ভিস উদ্বোধন করলেও একই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। পরে শহরের বাইরে দ্বিতল বাস চলবে না—এ শর্তে মালিকেরা প্রতিবাদ কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সড়ক পরিবহন খাতটি বেসরকারি পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। 

বিআরটিসির বাস নামাতে বেসরকারি মালিকদের আপত্তির কারণ এর ভাড়া অপেক্ষাকৃত কম। পরিবহনও আরামদায়ক। ফলে যাত্রীরা বিআরটিসির বাসেই চলাচল করতে পছন্দ করেন। বেসরকারি পরিবহনমালিকেরা আশঙ্কা করছেন, সরকারি বাস নামলে তাঁদের মুনাফা কমে যাবে। তাঁরা একদিকে মুক্তবাজার অর্থনীতির কথা বলবেন, অন্যদিকে সরকারি বাস বন্ধ করে ব্যবসা চালাবেন—এ স্ববিরোধিতা চলতে পারে না। 

বিএনপি সরকার সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করেছে বলে আওয়ামী লীগের নেতারা হরহামেশা বক্তৃতা দিয়ে থাকেন। অথচ সেই বিএনপি সরকারের আমলে সই করা একটি গণবিরোধী চুক্তি তঁারা টিকিয়ে রেখেছেন। ওই চুক্তি ১৯৬১ সালের বিআরটিসি আইন তথা ১১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে পাস করা সংশোধিত আইনেরও পরিপন্থী। এ বিষয়ে নির্দেশনা চেয়ে বিআরটিসির চেয়ারম্যান গত বছরের ১২ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখে ২০০৩ সালের চুক্তিটি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু মন্ত্রণালয় কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। বরং সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেছেন, যেহেতু বিআরটিসি চুক্তিটি করেছিল, সেহেতু তারাই এটি বাতিল করে দিতে পারে। কিন্তু সচিব মহোদয়ের জানা উচিত যে ২০০৩ সালে তৎকালীন যোগযোগমন্ত্রীর নির্দেশেই চুক্তিটি হয়েছিল। এখন বাতিল করতে হলে মন্ত্রণালয় থেকেই সিদ্ধান্ত আসতে হবে। 

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় বিআরটিসির জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিদেশ থেকে নতুন নতুন বাস কিনে আনছে। কিন্তু সেসব বাস যদি রুটেই তারা নামাতেই না পারে, তাহলে বাস কিনে কী হবে। সড়ক পরিবহন খাত বেসরকারি পরিবহনমালিকদের মর্জির ওপর চলতে পারে না। অবিলম্বে নাজমুল হুদার আমলের গণবিরোধী চুক্তি বাতিল করা হোক।