'প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ' কথাটি সংকটে

অপরাধ সংঘটনের ঘটনা সংবাদমাধ্যমে আলোচিত হলেই তার সঙ্গে আরেকটি শিরোনাম প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে গেছে। সেটা হলো ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ’। কখনো এর সঙ্গে উপযুক্ত ব্যবস্থা বা আইনানুগ পদক্ষেপ নিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বা কখনো প্রধানমন্ত্রীর কড়া নির্দেশ কথাটি জুড়ে দেওয়া হয়। অব্যাহতভাবে এর ব্যবহার একটা সংকটে পড়ে গেছে। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর হাতেই সর্বময় ক্ষমতা। সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদ বলেছে বটে, প্রধানমন্ত্রীর হাতেই প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা থাকবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে যাঁরা মানুষকে অবহিত করেন যে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কোনো আসামি বা অভিযুক্তকে পুলিশ খোঁজে বা গ্রেপ্তার করে, তার একটা সাংবিধানিক শুদ্ধতা আছে। 

আসলে বিশেষ পরিস্থিতি বা কোনো ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি ছাড়া, বিশেষ করে সাধারণ ফৌজদারি অপরাধ দমনে ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ’ কথাটির ব্যবহার অপ্রয়োজনীয়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে ইদানীং এর অকারণ ব্যবহার অনেকটা দৃষ্টিকটু বা শ্রুতিকটু পর্যায়ে চলে গেছে। 

২৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর সেতু ভবনে বাংলাদেশ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ) প্রকল্পের চুক্তি সই অনুষ্ঠান চলছিল। এ সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জনগণকে জানিয়েছেন যে, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই যুব মহিলা লীগের নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’ এরপর তাঁর দাবি, দলীয় কর্মীদের শাস্তি দেওয়ার সৎসাহস একমাত্র শেখ হাসিনারই রয়েছে এবং বাংলাদেশের অন্য রাজনৈতিক দলগুলো এমন দৃষ্টান্ত দেখাতে পারেনি। 

তার ওই অভিমতের শেষের অংশটি নিয়ে আমাদের মন্তব্য নেই। এর উত্তর দেওয়ার দায় অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর। কিন্তু আমাদের জানার বিষয় হচ্ছে, এটা যাচাই করে দেখা যে ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই পাপিয়াকে গ্রেপ্তারের’ খবরের শুদ্ধতা। আমাদের প্রশ্ন, এর কোনো আইনি ভিত্তি আছে কি? রাজনৈতিকভাবে তা প্রধানমন্ত্রীকে কোনো বিশেষ সুবিধা দেবে কি? নাকি উদ্দেশ্য ভালো থাকলেও শুধু অযথাযথ ও অপ্রয়োজনীয় হওয়ার কারণে তা কোনো সুফল দেবে না, বরং তা উল্টো ফলও বয়ে আনতে পারে। 

 ওবায়দুল কাদের নিশ্চয় তাঁর সরকারের কৃতিত্ব দাবি করবেন। বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি যে কথা বলছেন, সেটা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। তাৎক্ষণিক যে তিনি কথা বলছেন, সাংবাদিকদের কৈফিয়ত মোকাবিলা করছেন। কিন্তু চাঁদাবাজি ও আওয়ামী লীগকে কলঙ্কিত করাসহ নানা অভিযোগে একজনকে গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ কথাটি জুড়ে দেওয়ার আদৌ কোনো দরকার ছিল কি? প্রচলিত আইন এবং রীতিনীতি সেটা সমর্থন করে না। পাপিয়া এমন কোনো অপরাধ করেননি, যা নতুন। নতুন অপরাধ হলে পাপিয়াকে কোন ধারায় কে কীভাবে গ্রেপ্তার করবে, তা আলোচনার বিষয় হতো। ধরা যাক, ভিন গ্রহ থেকে এলিয়েন এসে একটা অদ্ভুত অপরাধ করল। শুধু আমরা কেন, বিশ্ববাসী কখনো এমন অপরাধ শোনেনি। তখন কী করা প্রয়োজন, সে বিষয়ে ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ’ কথাটির ব্যবহার অত্যন্ত দরকারি ও কার্যকর হতো। দলীয় প্রভাবে পাপিয়া যা যা করেছেন, তা তো আকস্মিক বা এক দিনে ঘটেনি। নারী সাংসদ অপু উকিল বলেছেন, কীট-পাপিয়ার অপরাধের দায় দল নেবে না। অবশ্যই নেবে না। কিন্তু আমাদের কথা হলো, কোনো অপরাধ নতুন হলে সংসদের কাজ বেড়ে যেত। অপরাধ বিবেচনায় নিয়ে তার জন্য কী করলে কী করতে হবে, তা আইনে লিখতে হতো। আইনবেত্তারা তর্ক তুলতেন, এলিয়েন এসে মানবজাতির অজানা অপরাধ করেছে বটে, কিন্তু আইন না থাকার কারণে ভূতাপেক্ষভাবে তো এখন নতুন আইনে তার বিচার চলবে না। 

পাপিয়ার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তা কোনো নতুন অপরাধ নয়। তিনি, তাঁর স্বামী এবং তাঁদের মদদদাতারা সবাই দীর্ঘদিন ধরে জানতেন, তাঁদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা প্রচলিত আইনের লঙ্ঘন। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই পাপিয়ার মতো একজন চুনোপুঁটিকে গ্রেপ্তারের তথ্য প্রধানমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের পদের মর্যাদার সঙ্গে ঠিক খাপ খায় না। 

বিশ্বজুড়ে রুল অব ল বা আইনের শাসন ধারণাটি যুগ যুগ ধরে বহুল উচ্চারিত। প্রাচীন যুগের সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী বা রাজা-বাদশাহর আমলে রুল অব ল কথাটিই ছিল না। তার বাস্তব কারণ ছিল। কারণ, তখন ক্ষমতার পৃথক্‌করণ ছিল না। রাষ্ট্রব্যবস্থা আনুষ্ঠানিক ছিল না। রাষ্ট্র তিনটি অঙ্গে বিভক্ত ছিল না। লোকসংখ্যা ছিল কম। তাদের জীবনের খাওয়া-পরা, ভালোমন্দ, বিচার–আচার সংগত কারণেই বহুলাংশে রাজার আদেশ-নির্দেশনির্ভর ছিল। সেটা অনেকাংশে সম্ভবও ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে রাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে তৈরি হলো এবং তার লোকসংখ্যাও বাড়তে থাকল। তাই মৌখিক বা লিখিত আদেশ-নির্দেশ দিয়ে সাধারণভাবে দেশ পরিচালনা আর সম্ভব হলো না। এটা একটা বাস্তবতা। সুতরাং আইনে যা লেখা আছে, সে অনুযায়ী সবার চলা বা আইন মান্য করা একটি অাবশ্যকীয় বিষয়। এটা কোনোভাবেই বিকল্প নয়। এটা কোনোভাবেই কারও পছন্দ বা অপছন্দের বিষয় নয়।

মানুষের সমাজ। তাই অপরাধ ঘটবেই। সেটা কে কখন চাইল বা চাইল না, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো আইন তার আপন গতিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলল কি চলল না। কেউ চুরি করল, কেউ ডাকাতি করল, কেউ ঘুষ খেল—এটা নিয়ে সাধারণভাবে হইচই হওয়ার কিছু নেই। হইচই হওয়ার কথা তখন, যখন দেখা যাবে অপরাধী অপরাধ করছে অথচ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নীরবতা পালন করছে। তখন উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনা লাগতে পারে। সেখানেও একটা হায়ারার্কি বা নির্দেশনা দেওয়ার ক্রম আছে। সেটা মানতে হবে। 

একজন চৌকিদার বা দফাদার দুর্নীতি করেছেন। জনতা তাঁকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছে। এখানে রুল অব ল হলো সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ থেকে চেয়ারম্যান বা মেম্বার শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেবেন। এখন যদি দেখা যায় চৌকিদারকে গ্রেপ্তার করতে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী কড়া নির্দেশ দিলেন, তখন বুঝতে হবে এটা স্বাভাবিক নয়। সন্ত্রাসীরা কোথাও তাণ্ডব করে পালিয়েছে। পুলিশ তখন তাদের খুঁজে বের করবে। কারও নির্দেশের অপেক্ষায় থাকবে না। ট্রাফিক পুলিশ রাজপথে ডিউটি দিচ্ছেন। তিনি হাতেনাতে ধরলেন। কাগজপত্র ঠিক নেই। চালকের ছাড়পত্র নেই। গাড়ির ফিটনেস সনদ নেই। এ অবস্থায় তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে ফোন করে তাঁর হুকুম নেবেন না। আইনে লেখা আছে, আইন অমান্য করলে তার করণীয় কী। ট্রাফিক পুলিশ তাই করবেন। লঙ্ঘনকারীর যেকোনো পরিচয় জেনেও তিনি নির্লিপ্ত থাকবেন। এটাই রুল অব ল। আইনের শাসন। 

কিন্তু অপ্রিয় হলেও ওপরের চিত্র অনুযায়ী বাংলাদেশ চলছে না। অতীতের সামরিক বা আধাসামরিক সরকারগুলোর আমলেও চলেনি। কিন্তু শুরুটা করতে হবে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তির স্বার্থেই। বুঝতে হবে এ রকম দাবি দল বা সরকারের জন্য ভালো নয়। ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ, ওবায়দুল কাদের’, কথা লিখে গুগলে সার্চ দেওয়ার পর অনেক কিছু পাওয়া গেল। গোড়ার দিকের কয়েকটি এ রকম: ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পাপিয়াকে গ্রেপ্তার: কাদের’, ‘নুরের ওপর হামলায় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর’, ‘প্রধানমন্ত্রী তালিকা সংশোধনের নির্দেশ দিয়েছেন: কাদের’, ‘রাজাকারের তালিকা সংশোধন করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ’, ‘মন্ত্রী-এমপিদের আচরণবিধি লঙ্ঘন না করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ’ ইত্যাদি। 

ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে ২৫টি ক্রমিকে শতাধিক ভিআইপি পদের মর্যাদাক্রম দেওয়া আছে। এর মধ্যে একজন পাপিয়া গ্রেপ্তারে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তির নির্দেশ কথাটির ব্যবহার তাই যথাযথ নয়। বরং ক্যাসিনো-সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী পাপিয়ার পরে এটা আমরা শুনতে চাই যে এ ধরনের যাঁরা দলে আছেন, অবিলম্বে তাঁদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। 

মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]