দিল্লি সহিংসতা

ভারতের বিতর্কিত সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) নিয়ে রাজধানী নয়াদিল্লিতে যে সহিংসতা চলছে, তা যারপরনাই দুঃখজনক। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে এ সম্পাদকীয় লেখার সময় পর্যন্ত নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ৩৪, দুই শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল রাজ্যে সেনা মোতায়েন ও সান্ধ্য আইন জারির জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন, তবে এখনো তা করা হয়নি। সেনাবাহিনীকে সতর্কভাবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে এবং কিছু কিছু স্থানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। এসব সত্ত্বেও দিল্লির পরিস্থিতি উদ্বেগজনক রয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার দুপুরেও ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের অনলাইন সংস্করণগুলোতে আগের দিন বিভিন্ন এলাকায় অগ্নিসংযোগের খবর প্রকাশিত হয়েছে।

এ সহিংসতার কেন্দ্রে রয়েছে এমন রাজনীতি, যার প্রধান কৌশল হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে ধর্মীয় পরিচয়কে ব্যবহার করা। ভারতের ইংরেজি ভাষার সংবাদমাধ্যমগুলোতে একে যথার্থই বর্ণনা করা হচ্ছে ‘কমিউনাল ভায়োলেন্স’ বা সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হিসেবে। দেশটিতে এর আগেও এ রাজনীতি বড় বড় ট্র্যাজিক ঘটনার কারণ হয়েছে, যা থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং এ ধরনের ভ্রাতৃঘাতী ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করার প্রয়াস প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু তা যে ঘটেনি, সেটা এক বিরাট পরিতাপের বিষয়। দিল্লির সহিংসতার শিকার হচ্ছে মূলত মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত, যা নিজেকে অসাম্প্রদায়িক বলে দাবি করে, এবং যেখানে এ চেতনার ঐতিহ্য ছিল, সেখানে এই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা বিধানে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা দুর্ভাগ্যজনক ও গ্লানিকর বিষয়।

সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকেন্দ্রিক এ সহিংসতার অকুস্থল ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি বটে, কিন্তু এর অভিঘাত শুধু ওই শহর, রাজ্য কিংবা ভারত রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ নয়। সেখানে মুসলমান সম্প্রদায় সহিংসতার শিকার হচ্ছে—এ সত্য বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশের মুসলমানদেরই পীড়িত, ক্ষুব্ধ, উদ্বিগ্ন করবে। জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং দিল্লির পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানানো হয়েছে। মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র মন্তব্য করেছেন, বিক্ষোভকারীদের শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শনের অধিকার রয়েছেএবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সংযত আচরণ করা উচিত।

আমাদের কৌতূহল, এত বড় আকারের রক্তপাত ঠেকাতে সরকারি প্রশাসন কতটা আন্তরিকভাবে তৎপর ছিল? আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সহিংসতার যেসব চিত্র ও বর্ণনা প্রচারিত হয়েছে, তাতে আইন প্রয়োগ ও নাগরিকদের জীবন রক্ষায় প্রশাসনিক ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়াতেই শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের আহ্বান জানিয়েছেন, কিন্তু এ আহ্বান কাজে দিলে পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো না। সাম্প্রদায়িকতা ও বিদ্বেষ রাজনীতিতে প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তার পরিণতি কী হতে পারে, দিল্লির ঘটনা তারই দৃষ্টান্ত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধেও বাড়াবাড়ির অভিযোগ উঠেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দিল্লির সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রসঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য (হেট স্পিচ) প্রচারের নিন্দা করে এগুলোর তদন্ত ও বিচার করার আহ্বান জানিয়েছে।

আমরা ভারতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা কামনা করি। সে জন্য সবকিছুর আগে প্রয়োজন সব ধর্ম–বর্ণের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও সহযোগিতার সম্পর্ক। বহু জাতিগোষ্ঠী, ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের বিশাল রাষ্ট্র ভারতের বহুত্ব ও বৈচিত্র্য যেন কোনোভাবেই শান্তি, সংহতি ও নিরাপত্তার পথে অন্তরায় না হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সে দেশের রাজনীতিবিদসহ সবার। আমরা আন্তরিকভাবে কামনা করি, দিল্লির সহিংসতার দ্রুত অবসান ঘটবে এবং ভারতের আর কোনো অঞ্চলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।