একত্ববাদের তাৎপর্য ও গুরুত্ব

সব সদ্‌গুণাবলির অধিকারী ও সর্বশক্তির আধার অবশ্যম্ভাবী সত্তা, যিনি অনাদি অনন্ত, যাঁর শুরু নেই, শেষ নেই, লয়-ক্ষয় ও পরিবর্তন নেই, কিছুই ছিল না, তিনি ছিলেন, সবকিছু ফানা হয়ে যাবে, তিনি থাকবেন, তিনি সব সৃষ্টির খালিক ও মালিক, সৃজন, লালন-পালন, সংরক্ষণ ও ধ্বংস সাধন যাঁর এখতিয়ার, সেই অদ্বিতীয় সত্তার নাম ‘আল্লাহ’। কোরআনে কারিমে সুরা ফাতিহার সূচনায় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিজের পরিচয় ও পরিচিতি প্রদান করেছেন। ‘আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা! যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক, যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু, যিনি কর্মফল দিবসের মালিক।’ (সুরা-১ ফাতিহা, আয়াত: ১-৩)।

আল্লাহ তাআলার গুণাবলি বিবেচনায় তাঁর বহু নাম রয়েছে, যা ‘ইসমে সিফাত’ বা গুণবাচক নাম। এগুলোকে ‘আসমাউল হুসনা’ বলা হয়। কোরআন মাজিদে রয়েছে: ‘আর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার রয়েছে সুন্দর সুন্দর নামসমূহ। তোমরা তাঁকে সেসব নামে ডাকো।’ (সুরা-৭ আরাফ, আয়াত: ১৮০)। ‘তোমরা আল্লাহ নামে ডাকো অথবা রহমান নামে তাঁকে ডাকো (যে নামেই ডাকো তিনি সাড়া দেবেন)। তাঁর রয়েছে সুন্দরতম নামসমূহ।’ (সুরা-১৭ ইসরা, আয়াত: ১১০)।

আল্লাহকে বিশ্বাস করা মানেই হলো তাঁর জাত ও সিফাত (সত্তা ও গুণাবলি) বিশ্বাস করা। ইমানে মুজমালে উপরিউক্ত বিষয়টি পূর্ণাঙ্গরূপে প্রকাশ করা হয়েছে। যথা: ‘আমি ইমান আনলাম তথা বিশ্বাস করলাম আল্লাহর প্রতি, যেমন যেরূপ আছেন তিনি তাঁর নামাবলি ও গুণাবলিসহ। এবং আমি মেনে নিলাম তাঁর সকল আদেশাবলি ও নিষেধাবলি।’

তাওহিদ বা একত্ববাদ

ইসলামি বিশ্বাসের মৌলিক তিনটি বিষয় হলো তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাত। এর মধ্যে তাওহিদ হলো প্রধান ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও তাত্পর্যমণ্ডিত। সব নবী–রাসুল (আ.)–গণের কালিমা বা প্রচারের মূলমন্ত্র ছিল এই তাওহিদেরই মর্মবাণী ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’। অর্থাৎ ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই’। দ্বিতীয় অংশে হলো যুগের নবী–রাসুলের পরিচয় ও স্বীকৃতির ঘোষণা। যেমন ‘আদামু ছফিয়ুল্লাহ’ (আদম আ. আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত), ‘নূহুন নাজিয়ুল্লাহ’ (নূহ আ. আল্লাহ কর্তৃক মুক্তিপ্রাপ্ত), ‘ইবরাহিমু খলিলুল্লাহ’ (ইবরাহিম আ. আল্লাহর খলিল বা বন্ধু), ‘দাউদু খলিফাতুল্লাহ’ (দাউদ আ. আল্লাহর খলিফা), ‘মুসা কালিমুল্লাহ’ (মুসা আ. আল্লাহর কালামপ্রাপ্ত), ঈসা রুহুল্লাহ’ (ঈসা আ. আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা রুহ), ‘মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ (মুহাম্মদ সা. আল্লাহর রাসুল)। লক্ষণীয়, কালিমার দ্বিতীয় অংশ রিসালাতের বিবরণ আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর আগমনের পূর্ব পর্যন্ত যুগে যুগে পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু কালিমার প্রথম অংশ তাওহিদ তথা আল্লাহর জাত ও সিফাতের (সত্তা ও গুণাবলি) বিবৃতি কোনোরূপ পরিবর্তিত হয়নি।

তাওহিদ ও শিরক

তাওহিদের বিপরীত হলো শিরক। শিরক অর্থ শরিক বা অংশীদার স্থির করা। ইসলামি পরিভাষায় শিরক হলো আল্লাহর জাত (সত্তা), সিফাত (গুণাবলি) ও ইবাদত (আনুগত্যে) কোনো কাউকে সমকক্ষ, শরিক বা অংশীদার, হকদার তথা উপযুক্ত মনে করা। মহাজ্ঞানী লুকমান (আ.) তাঁর প্রিয় সন্তানকে শিরক বিষয়ে সতর্ক করে বলেছিলেন: ‘হে আমার স্নেহের পুত্র! তুমি আল্লাহর সাথে শরিক করবে না, নিশ্চয়ই শিরক মহা অন্যায়।’ (সুরা-৩১ লুকমান, আয়াত: ১৩)।

তাওহিদ ফিয্যাত

আল্লাহ এক, একক, অদ্বিতীয়, অবিভাজ্য। তিনি ‘লা শরিক’ অংশীবিহীন। কোরআন মাজিদে সুরা তাওহিদে এই বিষয়ের পরিপূর্ণ বিবরণের সারসংক্ষেপ বিবৃত হয়েছে। ‘বলো, আল্লাহ একক, আল্লাহ অমুখাপেক্ষী (স্বনির্ভর), তিনি জনকও নন এবং তিনি জাতও নহেন, আর তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই।’ (সুরা-১১২ ইখলাস, আয়াত: ১-৪)।

তাওহিদ ফিছিছফাত

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ‘সিফাতে কামাল’ বা পরিপূর্ণ গুণাবলির অধিকারী। সৃষ্টির গুণ বা বৈশিষ্ট্য অসম্পূর্ণ। এর ব্যতিক্রম বিশ্বাস হলো ‘শিরক ফিছিছফাত’ অর্থাৎ কোনো কাউকে কোনো গুণে বা বৈশিষ্ট্যে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করা বা সমান্তরাল ভাবা হলো ‘শিরক ফিছিছফাত’।

তাওহিদ ফিল ইবাদত

ইবাদত তথা আনুগত্যে ও উপাসনায় তাঁর কোনো শরিক নেই। মহাগ্রন্থ আল–কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘বলো, হে অবিশ্বাসীরা! আমি সেসবের ইবাদত করি না, যেসবের উপাসনা তোমরা করো। এবং তোমরা তাঁর ইবাদতকারী নও, আমি যাঁর ইবাদত করি। আর আমিও ইবাদতকারী নই তাদের, যাদের তোমরা উপাসনা করো। এবং তোমরাও ইবাদতকারী নও তাঁর, যাঁর ইবাদত আমি করি। তোমরা তোমাদের দীন (কর্মফল) ভোগ করবে, আর আমি আমার দীন (পরিণতি) লাভ করব।’ (সুরা-১০৯ কাফিরুন, আয়াত: ১-৬)। এর ব্যত্যয় হলো ‘শির্ক ফিল ইবাদাত’ অর্থাৎ আল্লাহর ইবাদতে শরিক করা।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail,com