দিল্লির সহিংসতা: আমাদের নেতারা ভয়ের ভারত গড়তে চান

নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের প্রতিবাদে পাঞ্জাবের অমৃতসরে বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি
নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের প্রতিবাদে পাঞ্জাবের অমৃতসরে বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি

ভয়াল নিকষ কালো রাতের অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে ভারত। দিল্লিতে যে দাঙ্গা হচ্ছে তাকে কোনো দলের মামুলি কৌশলগত বিচ্যুতি বা নজরদারির অন্যমনস্কতাজনিত ঢিলেমি বলে চালানো যাবে না। আমাদের সাহায্য-সহযোগিতায় যে শাসকগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, তারা আমাদের ভবিষ্যৎকে কোন দিকে নিতে যাচ্ছে, এ দাঙ্গাগুলো তার নির্ণায়ক হয়ে উঠেছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, নিষ্ঠুরতা, ভয়, বিভক্তি ও সহিংসতা ছড়িয়ে দেওয়া একটি শাসকগোষ্ঠী ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ওপর কার্পেটবোমা বিছিয়ে দিতে চায়। গোড়াতেই এটি পরিষ্কার ছিল যে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আসা অমুসলিমদের সমস্যা সমাধান নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) মূল মোক্ষ ছিল না। ধর্মের ভিত্তিতে কাউকে বৈষম্যের মুখে না ফেলা এবং নাগরিকত্ব অর্জনে কারও ধর্মীয় পরিচয় টেনে না আনার নীতির ভিত্তিতে একটি বিল পাস করেই এ লক্ষ্য পূরণ করা যেত।

এনআরসি, সিএএ এবং এনপিআরের মধ্যে কোনো সম্পর্ক খোঁজা হবে না বলে সরকারের দিক থেকে যে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, তা প্রথম থেকেই কারও কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। এর ফল হিসেবে কোটি কোটি ভারতীয় মনে, বিশেষ করে মুসলমানদের মনে প্রবল ভয় ও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এ প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত কোন পর্যন্ত গড়াবে তা তারা আন্দাজ করতে পারছে না।

আটক শিবির নিয়ে যে আতঙ্ক ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে তাকে উড়িয়ে দেওয়া খুবই কঠিন। এ বিক্ষোভ ও সহিংসতা অতি সহজেই থামানো যেত এবং এখনো থামানো যায়, যদি সরকার নাগরিকদের মধ্যে এ আস্থা তৈরি করতে পারে যে ভারতে বসবাসকারী কেউ ঝুঁকির মধ্যে নেই এবং কাউকে ধর্মীয় বা অন্য কোনো পরিচয়ের কারণে বৈষম্যের শিকার হতে হবে না। সরকার যদি এতে অস্বীকৃতি জানায় তাহলে তা সংখ্যালঘুদের অবমাননাকর পরিস্থিতি বাড়াবে এবং সহিংসতা আরও ফেঁপে উঠবে।

এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় আঘাত হেনেছেন সুপ্রিম কোর্ট। ‘প্রতিরোধমূলক আটকাবস্থায়’ থাকা ব্যক্তিকে সশরীরে আদালতে হাজির করতে হবে—আমাদের সংবিধানে রাখা এ মানবাধিকারকে সর্বোচ্চ আদালত পাশ কাটিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট আসামিকে সশরীরে আদালতে হাজির করার বাধ্যবাধকতাকে উড়িয়ে দিয়েছেন।

প্রতিটি ইস্যুতে সুপ্রিম কোর্টকে সুপরিকল্পিতভাবে সরকারের পাশে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে। মৌলিক বৈষম্যমূলক আচরণ করার অভিযোগের শুনানিতে দীর্ঘসূত্রতা এবং ক্ষমতাসীন নেতাদের প্রতি নতজানু হওয়ার মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট সাংবিধানিক বিচারের সব আশা ধূলিসাৎ করে দিয়েছেন। উপায় না দেখে নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে নামতে হয়েছে।

এ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে সমাজের সব স্তরের নর-নারী, ছাত্রছাত্রী ও সংখ্যালঘুরা ছিলেন। কোনো ধরনের উসকানি না থাকা সত্ত্বেও আইনের মারপ্যাঁচে এসব বিক্ষোভ মিছিল বা সমাবেশ করা কঠিন করে তোলা হয়েছে। উত্তর প্রদেশের মতো কিছু রাজ্যে কিছু সহিংসতা হয়েছিল। এ ঘটনাগুলোকে সরকারবিরোধীদের দমিয়ে রাখার বড় অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের অভিযোগ ও ক্ষোভ প্রকাশ না করতে দিলে সব সময়ই উগ্রবাদীদের সক্রিয় হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।

সরকারের কূটকৌশলের মধ্যেও চরম নিষ্ঠুরতা লুকিয়ে আছে। দিল্লিতে শাহিনবাগে বিক্ষোভ মিছিল করতে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল এ কারণে নয় যে সরকার নমনীয় ছিল। সরকার বিক্ষোভকারীদের রাস্তায় নামতে দিয়ে সংখ্যাগুরুদের সংঘবদ্ধ করার একটা অজুহাত তৈরি করছিল। তারা সংখ্যাগুরুদের দেখাচ্ছিল: দেখো, সংখ্যালঘু মুসলমানরা কীভাবে রাস্তাঘাট অবরোধ করে হিন্দুদের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালাচ্ছে। বিজেপির বিষাক্ত নীতি হলো, প্রথমে আমরা তাদের বৈষম্যের শিকার বানাব। তারা প্রতিবাদে নামলে সেটিকে যথাসম্ভব উসকে দিয়ে একটি অজুহাত তৈরি করব। এরপর তাদের ওপর চড়াও হব।

এর বাইরে সংবাদমাধ্যমের ব্যর্থতা একটি বড় বিষয়। আমরা দেখেছি, বহু সাহসী সাংবাদিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করে আমাদের মূল ঘটনা জানাতে চেয়েছেন, কিন্তু সরকারের চাপের কারণে সংবাদ প্রকাশ বা সম্প্রচার করা কর্তৃপক্ষ তা প্রকাশ বা সম্প্রচার করতে পারেনি। তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভয়ে এতটাই ভীত যে তাদের সাংবাদিকতার পেশাদারি এখন প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

বিরোধী দলগুলোর ভূমিকা হয়েছে আটকে পড়া হরিণের মতো। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন এখন রাজঘাটে গিয়ে ছবি তোলা এবং অন্য বিরোধী নেতাদের কর্মতৎপরতা বড়জোর টুইট করায় সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। বিরোধী দলে এখন কর্মীর চেয়ে পরামর্শকের সংখ্যা অনেক বেশি। সুশীল সমাজের মধ্য থেকে বিজেপির তৎপরতার বিরোধিতা জোরালোভাবে আসছে না। রাস্তায় মানুষ ‘জয় শ্রীরাম’ বলে যে স্লোগান দিচ্ছে তা আসলে ভগবান রামের জয়ধ্বনি বলে মনে হচ্ছে না, বরং এটিকে এখন মানুষ হত্যায় ছুটে আসার আহ্বানের সমার্থক স্লোগান বলে মনে হচ্ছে।

দিল্লির এ সহিংসতা হয়তো থেমে আসবে। কিন্তু সেখানেই সব সহিংসতার সমাপ্তি, তা ধরে নেওয়া যাবে না। তার আগে সরকারকে শান্তির মনোভঙ্গিতে আসতে হবে। এর অন্যথা হলে কিছুই সম্ভব হবে না।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
প্রতাপ ভানু মেহতা: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর কন্ট্রিবিউটিং এডিটর