ইরানের নির্বাচন: কট্টরপন্থীদের জয়ের পেছনের কারণ

রয়টার্স ফাইল ছবি।
রয়টার্স ফাইল ছবি।

ইরানের পার্লামেন্ট নির্বাচনে কট্টরপন্থীরা জয়ী হয়েছে তাদের প্রতি জনগণের ব্যাপক সমর্থনের কারণে নয়, বরং প্রেসিডেন্ট রুহানির সরকারের প্রতি জনগণের ব্যাপক ক্ষোভ কট্টরপন্থীদের জয়কে ত্বরান্বিত করেছে। ২১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে সর্বকালের সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে। যদিও হতাশাব্যঞ্জক, তারপরও এ নির্বাচন ৪১ বছর বয়সী ইসলামি প্রজাতন্ত্রটির ভবিষ্যতের পথচলার জন্য উল্লেখযোগ্য নির্দেশক হিসেবে রয়ে যাবে, যা ইরানের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সংস্কারপন্থীদের হাত থেকে ইরানের সম্পূর্ণ ক্ষমতা চলে যাচ্ছে কট্টরপন্থীদের হাতে।

পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভোট এতটাই কম পড়েছে যে রাজধানী তেহরানের নির্বাচনী কর্তৃপক্ষ প্রথমে ভোটের সামগ্রিক চিত্র ঘোষণা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ভোটের ফলাফলের ঘোষণা প্রথম আসে প্রদেশগুলো থেকে। ইরানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রোববার অবশেষে ঘোষণা করেছে যে নির্বাচনে মাত্র ৪২ দশমিক ৫৭ শতাংশ ভোট পড়েছে, যা ১৯৭৯ সালে ইসলামি প্রজাতন্ত্র গঠনের পর থেকে সবচেয়ে কম। বিরোধীদের হিসাব অনুযায়ী, তেহরানের ৮০ শতাংশ এবং সারা দেশের ৬০ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে যাননি।

ভোটে অংশ না নেওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগই সম্ভবত তরুণ, শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের। তাঁরা নানা কারণে ক্ষুব্ধ ছিলেন সরকারের প্রতি। নির্বাচনের আগে রুহানির সরকারের প্রতি জনগণের ক্ষোভ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ছিল। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে সৃষ্ট ভয়াবহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, জানুয়ারিতে ইউক্রেনের বিমান লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা এবং গত নভেম্বরে সরকারবিরোধী লোকজনের ওপর দমন–পীড়ন—সব মিলিয়ে জনগণ ক্ষুব্ধ ছিল রুহানির সরকারের প্রতি, যা কিনা কট্টরপন্থীদের জয়কে ত্বরান্বিত করেছে।

ইরানের সাধারণ মানুষের অধিকাংশই তাদের দেশে মার্কিন হস্তক্ষেপের বিরোধী। কিন্তু দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র নানা সময় ইরানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছে। ইরানি জনগণের ধারণা, রুহানির সরকার যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। কম ভোট পড়ার পেছনে এ ধারণাও পরোক্ষভাবে কাজ করেছে।

আয়াতুল্লাহ খামেনি, যিনি ‘মার্কিন ঔদ্ধত্যের’ বিরুদ্ধে দাঁড়ানোকে ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছিলেন, তিনিও হতাশাগ্রস্ত জনসাধারণকে প্রকৃত বিষয়টি বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর ফলাফল হচ্ছে ইরানের পার্লামেন্ট এখন ডান ও ডানপন্থী কট্টরপন্থীদের দখলে। একজন আইআরজিসির জেনারেল মোহাম্মদ বাঘের গালিবাফ তেহরানের তালিকার শীর্ষে রয়েছেন, তারপর সাবেক কট্টরপন্থী সংস্কৃতিমন্ত্রী মোস্তফা মিরসালিম এবং কট্টরপন্থী আলেম মুর্তজা আকা-তেহরানি রয়েছেন।

গালিবাফ ও মিরসালিম বিগত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হলেও উভয়ই হাসান রুহানির কাছে হেরেছিলেন। এ ছাড়া সাবেক কট্টরপন্থী পশ্চিমাবিরোধী প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদের ঘনিষ্ঠ ১৫ জন কেবিনেট মন্ত্রী এবং প্রাদেশিক গভর্নর নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। নির্বাচনের ফলাফলের প্রশংসা করতে গিয়ে তাঁর বক্তব্যে খামেনি বলেন, ইসলামি প্রজাতন্ত্রের নির্বাচন এই ইঙ্গিত দেয় যে ‘ধর্ম হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রের নিখুঁত প্রতীক’।

তিনি যে বিষয়টি খেয়াল করতে ব্যর্থ হয়েছেন তা হলো কারচুপির নির্বাচনগুলোও স্বৈরাচারী শাসনের একটি বিশেষ চিহ্ন, যারা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন বা অবাধ গণমাধ্যমের অনুমতি দেয় না। প্রকৃতপক্ষে, তারা তাদের হুমকি এবং ভয় দেখানোর প্রচারের জন্য গণমাধ্যমকে নিপুণভাবে ব্যবহার করে।

কর্তৃত্ববাদী শাসনকর্তারা নির্বাচন করেন শুধু তাঁদের শাসনের বিরোধিতার মাত্রা নির্ধারণ করতে এবং জনগণকে বোঝাতে যে তাঁরা জিতবেন এবং তাদের একমাত্র উপায় হচ্ছে সরকারের সঙ্গে থাকা। ইরানের পার্লামেন্ট এখন কট্টরপন্থীদের দখলে, যারা শুধু কঠোর প্রক্ষেপণে সক্ষম, যা কিনা যেকোনো ‘গণতন্ত্রের প্রতীক’ থেকে অনেক দূরে।

একবার নতুন কট্টরপন্থী পার্লামেন্টের উদ্বোধন হয়ে গেলে এবং নতুন স্পিকার নির্বাচন করা হলে এটি সম্ভবত প্রেসিডেন্ট রুহানি এবং তাঁর মন্ত্রিসভাকে অভিশংসিত করবে। এরপর এটি পারমাণবিক চুক্তি (জিসিপিওএ) এবং অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) থেকে নিজেদের সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করে নেবে। ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের (এফএটিএফ) প্রস্তুত করা কালো তালিকা থেকে মুক্ত হয়ে নতুন সরকার বিশ্বব্যাপী এর বেশ কয়েকটি মিলিশিয়া বাহিনীর জন্য অর্থ বানানোর ও অর্থ পাচারের নতুন পদ্ধতিগুলো সম্ভবত অনুমোদন করবে।

অর্থাৎ নির্বাচনের এ ফলাফল ইরানিদের জন্য কোনো রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক মুক্তি আনবে না। ইরানে চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় কট্টরপন্থীরা মনোযোগ দেবে, এমনটা মনে হয় না। অনেকেই বলছেন, তাদের ওপর কোনো বিশ্বাস নেই। নির্বাচনের পরও তারা কোনো কথা রাখবে না, যা তারা প্রতিজ্ঞা করেছিল। এখন কী করে কট্টরপন্থীরা, সেটাই দেখার অপেক্ষা।

টিআরটি ওয়ার্ল্ড থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
মাসৌমেহ তরফেহ: লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের গবেষণা সহযোগী