জৈব ক্ষমতা, করোনাভাইরাস ও জীবাণু অস্ত্র

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

করোনা নামের এক ভয়ংকর ভাইরাসের দাপটে বিশ্ব কাঁপছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবমতে, গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত ৫৩টি দেশে ৮৩ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। আর মৃত্যুবরণ করেছেন ২ হাজার ৮০০ জন। আক্রান্ত এলাকা ও মৃত মানুষের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া সব মহাদেশেই করোনার অস্তিত্ব মিলেছে। জাপানে স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। উত্তর কোরিয়া স্কুলের ছুটি বৃদ্ধি করেছে। ইরানে জুমার নামাজ বাতিল করা হয়েছে। সৌদি আরব মক্কায় ওমরাহ ও মদিনা সফর আপাতত বন্ধ ঘোষণা করেছে। সাধারণের মধ্যে আতঙ্ক, ভয় ও অনিশ্চয়তা কাজ করছে। অনেকেই মাস্কের জন্য ওষুধের দোকানে ছুটছে। গণমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, বিশ্ব করোনা মহামারির দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছে। শেয়ারবাজারগুলোয় করোনার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

প্রকৃতপক্ষে, গত আড়াই দশকে একের পর এক ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে বিশ্ববাসী। সার্স, সোয়াইন ফ্লু, নিপাহ, এনকেফেলাইটিস, ইয়েলো ফিভার, ইবোলাসহ হরেক রকমের ভাইরাসের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হচ্ছে। একটি শেষ হচ্ছে তো আরেকটির প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ছে। একসময় যক্ষ্মা, কলেরা, বসন্ত হলে জনপদের পর জনপদ উজাড় হয়ে যেত। সভ্যতা এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে কলেরা ও বসন্তকে দমানো গেলেও নতুন নতুন রোগব্যাধির প্রকোপও বাড়ছেই। বিশ্বে একদিকে সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপ বৃদ্ধি বাড়ছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোয় অসংক্রামক রোগবালাই বাড়ছে। উন্নয়নের নামে নতুন নতুন হাসপাতাল হচ্ছে আমাদের মতো দেশগুলোয। হাসপাতালগুলোয় সারা বছরই রোগী গিজ গিজ করছে।

করোনা কী, কীভাবে এর বিস্তার ঘটল, এ নিয়ে জনপরিসরে নানা কথাবার্তা ঘুরে বেড়াচ্ছে। গণমাধ্যম, প্যারিসে কফি শপের আড্ডা বা ঢাকার চায়ের স্টল—সব জায়গাতেই করোনা বিস্তারের নানা ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ চলছে। জনপরিসরে মতামত ও ধারণা গঠিত হয়। মতামত ভুল বা সঠিক হতে পারে। কিন্তু জনপরিসরে নানা আলোচনার ভেতর দিয়ে চলমান পরিস্থিতির একটি রূপকল্প তৈরি হয়। এই রূপকল্প থেকে থেকে বের হয় আসা কঠিন। করোনাভাইরাস নিয়েও নানা ধরনের মতামত ও ধারণা তৈরি হচ্ছে। প্রথমেই সাধারণ নাগরিকেরা ধারণা করছে, আক্রান্ত হওয়ার সঠিক তথ্য দেওয়া হচ্ছে না। আক্রান্ত ও মৃত ব্যক্তির প্রকৃত সংখ্যা সরকারগুলো চেপে যাচ্ছে বলে সাধারণের বড় একটি অংশ সন্দেহ করছে।

গুজববশত সমাজের বড় একটি অংশ মনে করছে, করোনাভাইরাস একটি জীবাণু অস্ত্র। অস্ত্রের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য সাধারণের মধ্যে জীবাণু ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। পরীক্ষা–নিরীক্ষা শেষে যথাসময়ে প্রতিষেধকও ওষুধ কোম্পানিগুলো বাজারে ছাড়বে। এই পক্ষের যুক্তি হচ্ছে, বাদুড়, সাপ বা নানা ধরনের বন্য প্রাণী চীন, দক্ষিণ/পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকার মানুষ শত শত বছর ধরেই ভক্ষণ করে। এটা তাদের খাদ্যাভ্যাসের অংশ। এত দিন করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়নি। এখন কোত্থেকে উদয় হলো। এসব একেবারেই সাধারণ ভাবনা। বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে নির্দিষ্ট করে বলতে পারবেন।

কিন্তু জীবাণু অস্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ এবারই প্রথম না; এর আগেও হয়েছে। ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই জীবাণু অস্ত্রের ধারণাও ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮০–৮১ সাল পর্যন্ত কিউবাতে ডেঙ্গু জ্বরে কয়েক লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। মতান্তরে কেউ কেউ বলেন, এর সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখ। ওই সময় কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো অভিযোগ করেছিলেন, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল যুক্তরাষ্ট্রের জীবাণু অস্ত্রের আক্রমণে। পেন্টাগন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অনুদান দিয়ে থাকে জীবাণু অস্ত্র নিয়ে গবেষণা করার জন্য। এমন অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। অভিযোগ রয়েছে অনুদানপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দেশে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার নামে জীবাণু অস্ত্রের গবেষণাগার গড়ে তোলে। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত মার্কিন সামরিক বাহিনীর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পোকামাকড়ের মাধ্যমে জীবাণু অস্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের ছিল। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ আ্যালগিপ্টি মশার মাধ্যমে আফ্রিকায় ইয়েলো ফিভার ছড়ানো হয়। করোনার ক্ষেত্রে জীবাণু অস্ত্রের ধারণা একেবারেই বাতিল করে দেওয়া যায় না।

সমাজের এই অংশ করোনাভাইরাসকে জীবাণু অস্ত্র মনে করলেও নিশ্চিত না এর জন্য দায়ী কে। এ নিয়ে আবার বিভাজন আছে। একটি অংশ মনে করে যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়া এর পেছনে থাকতে পারে। নিজেদের অস্ত্রের পরীক্ষা এবং বিশ্বকে একটু টলিয়েও দেওয়ার জন্য এই অস্ত্রের প্রয়োগ করেছে। আবার অপর একটি অংশ মনে করছে, চীন নিজেই এর জন্য দায়ী। চীনের ল্যাবরেটরিতে করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা হচ্ছিল। অসাবধানতাবশত এই জীবাণু পরিবেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং এর বিস্তার ঘটেছে বলে তাদের অভিযোগ।

করোনার উৎপত্তি ও বিস্তারের কারণ যা–ই হোক না কেন, এটাকে জীবাণু অস্ত্র মনে করার কারণ হচ্ছে রাষ্ট্রগুলোর বায়োপাওয়ার বা জৈবশক্তি প্রয়োগের অভ্যাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, ১৯৯৬ সালের পর বেশ কিছু নতুন ভাইরাসের বিস্তার ঘটেছে। অনেকেই কাছাকাছি সময়ে ঘন ঘন ভাইরাসের প্রকোপকে ভাইরাস–রাজনীতি বলে মনে করছেন। এর সঙ্গে ক্ষমতার রাজনীতি ও আধিপত্যবাদের সম্পর্ক রয়েছে। ভাইরাস–রাজনীতিকে মিশেল ফুকোর বায়োপাওয়ার বা জৈব ক্ষমতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। মিশেল ফুকো নাগরিকের দৈহিক বা জৈবিক অবয়বের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণকে জৈব ক্ষমতা বলেছেন। ফুকোর মতে বায়ো পলিটিকসকে বায়োপাওয়ারের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়। ফুকো অবশ্য ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বায়োপলিটিকসের কথা বলেছিলেন। যেমন সরকার কর্তৃক নাগরিককে সন্তান গ্রহণের সংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়া বায়োপাওয়ারের একটি উদাহরণ। একজন নাগরিক কতগুলো সন্তান জন্ম দেবেন, এটা সরকারের ওপর নির্ভর করে। নাগরিকের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ সীমিত হলেও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ অনেক ক্ষেত্রেই ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু রাষ্ট্র নাগরিকে আটক করে দৈহিক নির্যাতন করে, গুম করেও দেয়। কার্যত, রাষ্ট্র নাগরিকের দেহকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে।

কারণ যা–ই হোক, ফল হলো করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বসভ্যতা একটা বড় হুমকির মুখে পড়েছে। দেশে দেশে, মানুষে মানুষে সহযোগিতা ছাড়া এ থেকে আমরা রক্ষা পাব না। সহযোগিতার সংস্কৃতি ছাড়া যে উপায় নেই, করোনা এসে তা বুঝিয়ে দিল।

ড. মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক