জিতলেন আসাদ, মুখ পুড়ল এরদোয়ানের

প্রায় এক দশকের গৃহযুদ্ধ। মার্কিনসহ পৃথিবীর বড় পরাশক্তিগুলোর আধিপত্য বিস্তারের যুদ্ধে বলি হয়েছে সিরিয়ার সাধারণ মানুষ। প্রাণ হারিয়েছে ভূমধ্যসাগরে ডুবে অথবা গুলি–বোমায়। তবে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনদের ক্ষয়িষ্ণু আধিপত্যে ফিরিয়ে এনেছে রাশিয়াকে। বৈধ শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে কুর্দি স্বাধীনতাকামী পিকেকে। ধসিয়ে দিয়েছে তুরস্কের জাতীয় স্থিতিশীলতা। দশকব্যাপী এই যুদ্ধে বিজয় নিশ্চিত করে চলেছে আসাদ সরকার। বিদ্রোহীদের সর্বশেষ ঘাঁটি ইদলিবে তুরস্কের ৩৩ সেনাকে হত্যার মধ্য দিয়ে পিকেকেসহ আসাদ বাহিনী সিরিয়ার প্রায় সব অংশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। তুরস্কের ৩৩ সেনা হত্যার ঘটনা আবার ন্যাটো-রাশিয়াকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। তৈরি করেছে যুদ্ধাবস্থা।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বিজয়ের জন্য আসাদ হত্যা করেছেন লাখ মানুষ। তবে এ সবকিছুই ফেব্রুয়ারির শেষ দিনে রুশ বিমানবাহিনীর সহায়তায় ইদলিবে ৩৩ তুর্কি সেনা হত্যার ঘটনাকে ছাড়িয়ে যায়নি। তুরস্কের পক্ষ থেকে সংখ্যাটা ৩৩ বলা হলেও আদতে সংখ্যাটা ৫০–এর বেশি। এত বেশি সেনা হারানোর ঘটনা একদিকে যেভাবে তুরস্ক-সিরিয়া-রাশিয়া যুদ্ধাবস্থা তৈরি করেছে, তেমনিভাবে তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতির দিনতা ফুটিয়ে তুলেছে। আসাদ এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আঙ্কারার সঙ্গে আলোচনার সব পথ বন্ধ করে সিরিয়ায় একক নিয়ন্ত্রণের পথে আরও এক ধাপ এগিয়েছেন। আসাদের এই কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা অবাক না হলেও তুরস্কের ৩৩ জন সেনা হত্যার ঘটনায় রাশিয়ার অংশগ্রহণ সবাইকে অবাক করেছে। কারণ, সোচি চুক্তির ৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী ইদলিবে তুরস্কের সব সেনার নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল রাশিয়ার। তুরস্ককে পাশ কাটিয়ে আসাদ আর সৌদিবলয়ের ক্ষমতায় ভর করেই যদি পুতিন মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র অঙ্কন করতে চান; সেটা সামগ্রিক অর্থে সফল হবে না। এরদোয়ান হয়তো চলে যাবেন কিন্তু জাতি হিসেবে তুর্কিরা এই হত্যাকাণ্ডে রাশিয়ার ভূমিকার কথা স্মরণ রাখবে। তাই তুর্কিদের অনাস্থা সিরিয়ার যুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার ভূমিকাকে শ্লথ করতে পারে।

আদতে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে রাশিয়াকে টেনে এনে দামেস্কের নিরাপত্তায় রাজি করানোর সময় থেকেই আসাদের সুসময় শুরু হয়েছিল। সেই সুসময়কে শুভদিনে রূপান্তরিত করেছিল ২০১৬ সালের এরদোয়ানের বিরুদ্ধে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে পশ্চিমাদের সমর্থন। ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান পুতিন-এরদোয়ানকে ঘনিষ্ঠ করে শত বছর পর রাশিয়া-তুরস্কের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নতুন আবহ তৈরি করে। যে আবহ আসাদকে অনেকটা রাজনৈতিক বৈধতা এনে দিয়েছিল, হাজার হাজার মানুষের প্রাণ সংহার আর প্রচুর সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও। রাশিয়া–তুরস্কের মৈত্রীর সুবাদে আসাদ বাহিনী ধীরে ধীরে বিদ্রোহীদের দখল করা অঞ্চলসমূহ উদ্ধার করতে শুরু করে। বড় সাফল্য পায় ২০১৮ সালের গ্রীষ্মে। আসাদ বাহিনী দখল করে উত্তর–পশ্চিম জর্ডান সীমান্তবর্তী দারা শহর।

তবে আসাদের এই সুসময়কে সোনালি দিনে রূপান্তর করে ট্রাম্পের সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা। আদতে ওই ঘোষণা ছিল আসাদের বৈধতায় মার্কিনদের মোহর। কারণ, মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণার পরই পিকেকে ৪০ বছরের বিবাদ মিটিয়ে রুশ ও মার্কিনদের সহায়তায় আসাদের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। চুক্তিতে পিকেকে আসাদের প্রতিপত্তি স্বীকার করে নেয় এবং তুরস্ককে একক শত্রু হিসেবে নির্ধারণ করে। আসাদ-পিকেকের চুক্তি এবং মার্কিনদের সেনা প্রত্যাহার সিরিয়ার যুদ্ধে আঙ্কারাকে নাস্তানাবুদ অবস্থার সম্মুখীন করে। এই নাস্তানাবুদ অবস্থা আরও বাড়ে যখন ট্রাম্প প্রশাসন সিরিয়ায় তুরস্ক সীমান্তবর্তী মার্কিন স্থাপনাসমূহ অঘোষিতভাবে রাশিয়ার কাছে হস্তান্তর করে। তবে মার্কিনরা কিছু সেনা এবং স্থাপনা রেখেছে পিকেকের সান্ত্বনার জন্য। পিকেকে এবং মার্কিনদের সঙ্গে অঘোষিত চুক্তির পর সিরিয়ায় আসাদের প্রতিপক্ষ ছিল কেবল তুরস্ক আর তুরস্ক–সমর্থিত বিদ্রোহীরা। ইদলিব ছিল বিদ্রোহীদের সর্বশেষ ঘাঁটি। তুরস্কের ৩৩ সেনা হত্যার মাধ্যমে ইদলিব দখলের রাস্তা পরিষ্কার করেছেন আসাদ।

৩৩ সেনা হারানোর ঘটনা তুরস্ক-রাশিয়ার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে দুর্বল করবে। একইসঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার ওপর আস্থা হ্রাস পাবে অন্যান্য দেশের। এটা পরিষ্কার যে রাশিয়া সোচি চুক্তি কেবল ভঙ্গই করেনি, একইসঙ্গে তুর্কি সেনা হত্যায় আসাদকে বিমানবাহিনীর সহায়তা দিয়েছে। সমালোচকেরা বলছেন, লিবিয়া সংকটের শুরু থেকেই পুতিন এরদোয়ানকে হয় লিবিয়ার ত্রিপলি অথবা সিরিয়ার ইদলিব থেকে যেকোনো একটি বেছে নেওয়ার কথা জানান। কিন্তু এরদোয়ান রাজি হননি। কারণ, ত্রিপলি ছেড়ে দিলে ভূমধ্যসাগর হারাতে হবে, আবার ইদলিব ছাড়লে প্রায় ১০ লাখ শরণার্থীসহ তুরস্কের জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত অনেক বিষয়ে ছাড় দিতে হবে। দুই কুল রক্ষা করতে গিয়েই আঙ্কারার এই দুর্দশার মুখোমুখি হতে হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

সার্বিকভাবে সিরিয়ায়, বিশেষ করে ইদলিবের ঘটনায় পশ্চিমাদের পাশে না পাওয়ার প্রতিদানস্বরূপ আঙ্কারা ইউরোপের সঙ্গে তার সব সীমান্ত খুলে দিয়েছে। লাখ লাখ সিরীয় এখন গ্রিস হয়ে ইউরোপের পথে। আঙ্কারা ঘোষণা দিয়েছে, তারা সীমানা তখনই বন্ধ করবে যখন ন্যাটো ইদলিব রক্ষায় আঙ্কারার পাশে দাঁড়াবে। এক দশক ধরে ইউরোপের দেশসমূহ, বিশেষ করে ফ্রান্স ও জার্মানি শরণার্থীদের ভিড়ে কাবু হয়েছে। জার্মান চ্যান্সেলর ম্যার্কেলের মতো অনেকেই আবার শরণার্থীদের সামলাতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে খেই হারিয়ে ফেলছেন। এই অবস্থার মধ্যে তুরস্কের সীমানা খুলে দেওয়ার বিষয়টি ইউরোপে একধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। হয়তো পুতিন এভাবেই ইউরোপকে সাজা দিচ্ছেন। সীমান্ত ব্যবহার করে এরদোয়ান ইদলিব রক্ষায় ইউরোপকে টেনে আনতে চাইছেন। যদি ইদলিব রক্ষায় ন্যাটো এগিয়ে আসে, যদিও বাস্তবে যার কোনো লক্ষণ নেই, তাহলে রাশিয়ার নয়, বরং ইরান এবং সিরিয়ারই ক্ষতি হবে। কারণ, সিরিয়ায় রাশিয়ার স্থল বাহিনীর কার্যক্রম সীমিত—আকাশপথেই বেশি। গত এক দশকের গৃহযুদ্ধে আসাদের বাহিনী নিঃস্ব হয়েছে। আসাদ মূলত টিকে আছেন রাশিয়ার কারিগরি সাহায্য আর ইরানের সেনা সাহায্যের ওপর ভর করে। কাসেম সুলাইমানি–পরবর্তী ইরান আর কত দিন আসাদকে সেনা সাহায্য দিয়ে যেতে পারবে, তা সময় বলে দেবে।

আসাদের সোনালি সময় মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি নিয়ে আসবে না, বরঞ্চ অশান্তি বাড়াবে। ইতিমধ্যেই সৌদিবলয়ের দেশসমূহ দামেস্কে তাদের দূতাবাসসহ স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করেছে। সৌদিরা ইরানের বিরুদ্ধে থাকলেও সিরিয়ায় আসাদের বিরুদ্ধে নয়। বরং আসাদকে সব ধরনের সাহায্য দিয়ে চলেছে লিবিয়ার হাফতারের মতোই। সৌদিবলয়ের আসাদ ও পিকেকে প্রেমের কারণ তুরস্ক। পিকেকে এবং আসাদকে তাদের দরকার তুরস্ককে শায়েস্তা করতে। সৌদিবলয়ের এই অভিলাষে পশ্চিমাদের মদদ থাকলে ভবিষ্যতে তুরস্ককে কঠিন দিনের মোকাবিলা করতে হবে। আসাদ দশকব্যাপী গৃহযুদ্ধ জিতে নিয়েছেন কিন্তু ইতিহাস তাঁকে জেনারেল অগাস্তো পিনোশে, হিটলার আর মুসলিনির কাতারে স্মরণ করবে।
রাহুল আনজুম: গবেষক