এই চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়ের দলিল

আফগানিস্তানে দীর্ঘ দেড় যুগের সহিংসতা বন্ধে ঐকমত্যে পৌঁছেছে যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবান। ছবি: এএফপি
আফগানিস্তানে দীর্ঘ দেড় যুগের সহিংসতা বন্ধে ঐকমত্যে পৌঁছেছে যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবান। ছবি: এএফপি

যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে সম্পাদিত শান্তিচুক্তি আফগানিস্তানে ১৮ বছর ধরে থাকা মার্কিন সেনাদের উপস্থিতির অবসানের প্রক্রিয়ার সূচনা করল। গত শনিবার দোহায় দুই পক্ষের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র আগামী ১৩৫ দিনের মধ্যে তার সৈন্যসংখ্যা এখনকার ১৩ হাজার থেকে ৮ হাজার ৬০০-তে নামিয়ে আনবে এবং ১৪ মাসের মধ্যে সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে। এই প্রত্যাহারের অঙ্গীকার শর্তমুক্ত নয়; চুক্তির বাস্তবায়ন নির্ভর করছে আগামী দিনগুলোতে তালেবানের আচরণ, আফগানিস্তানে সহিংসতার মাত্রা হ্রাস এবং তালেবান ও আফগান সরকারের মধ্যে সফল আলোচনার ওপরে।

এই চুক্তির জন্য দুই পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে কয়েক বছর ধরে, তাতে কখনো অগ্রগতি হয়েছে, কখনো মনে হয়েছে আলোচনা নিষ্ফল হতে চলেছে। এখন এই চুক্তির কৃতিত্ব প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করবেন এই বলে যে,২০১৬ সালের নির্বাচনে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যুদ্ধের অবসান করবেন, সৈন্যদের ফেরত আনবেন, তিনি সেই প্রতিশ্রুতি পালন করেছেন। নির্বাচনের বছরে তাঁর এই দাবি তাঁর সমর্থকদের কাছে খানিকটা হলেও গুরুত্ব বহন করবে, কিন্তু তাঁরা এই ইতিহাস জানতে চাইবেন না যে এই প্রক্রিয়ার সূচনা হয়েছিল ট্রাম্পের পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলেই। যুদ্ধাবসানের ও সৈন্য প্রত্যাহারের আলোচনার সূত্রপাত যিনিই করুন না কেন, আর যাঁর আমলেই যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের এই দীর্ঘতম যুদ্ধের অবসান হোক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে এই চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়ের দলিল।

২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে আল-কায়েদার সন্ত্রাসী হামলার পর আল-কায়েদা ও তার নেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয়দাতা আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যুক্তরাষ্ট্র যে যুদ্ধের সূচনা করেছিল, এখন তা থেকে পরাজিত যুক্তরাষ্ট্র পশ্চাদপসরণ করল। ইতিমধ্যে পৃথিবীতে অনেক বদল হয়েছে, এই যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া পড়েছে সারা বিশ্বে। এই যুদ্ধ সামনে রেখে যে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক যুদ্ধের’ বা গ্লোবাল ওয়ার অন টেররের সূচনা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা, তার ভয়াবহ পরিণতির ভার বইছে সারা দুনিয়ার সাধারণ মানুষ—দেশে দেশে নাগরিকদের অধিকার সংকুচিত হয়েছে, লাভবান হয়েছে ক্ষমতাসীনেরা, বিশেষ করে স্বৈরাচারী শাসকেরা, আর্থিক লাভ গুনেছেন যুদ্ধ ব্যবসায়ীরা; অন্য পক্ষে দেশে দেশে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো তাদের ডালপালা বিস্তার করার পক্ষে যুক্তি হাজির করেছে, সফল হয়েছে।

আফগানিস্তানে মার্কিনদের উপস্থিতি এবং অন্তহীন যুদ্ধের আলোচনায় যে কথাগুলো বারবার উঠেছে, শনিবার চুক্তি সম্পাদনের পর আবারও তা বলা হচ্ছে—ক্ষতির পরিমাণ কত? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২ হাজার ৩০০ সৈন্য নিহত হয়েছেন, আহতের সংখ্যা প্রায় ২১ হাজার। মানসিকভাবে অসুস্থতার শিকার হয়েছেন কত, তার হিসাব নেই। ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের করা এক হিসাবে ২০০১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর ৫৮ হাজার সদস্য নিহত হয়েছেন। অর্থের হিসাব করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুই ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। আর আফগান নাগরিকদের কত জন মারা গেছেন, তার কোনো নির্ভরযোগ্য হিসাব নেই—জাতিসংঘ ২০০৯ সাল থেকে যে হিসাব রাখতে শুরু করেছে, তাতে দেখা যায় কমপক্ষে ৩৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে, ৬৫ হাজার আহত; হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দেওয়া হিসাবে ২০১৬ থেকে প্রতিবছর যে ১১ হাজার নাগরিক মারা গেছে, তার কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ হচ্ছে শিশু। কিন্তু এসব হিসাব যে পূর্ণ হিসাব নয়, তা সহজেই বোধগম্য। নিহতের সংখ্যা লাখের ওপরে বলেই অনেকের অনুমান।

এত প্রাণ, রক্ত, অর্থ, অবকাঠামোগত ধ্বংসের শেষে কি আফগানিস্তানে শান্তির আলো দেখা যাচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে এ কথা মনে রাখতেই হবে যে দেশটি হত্যাকাণ্ডের এই লীলাভূমিতে পরিণত হয়েছে ১৯৭৯ সাল থেকেই। ১৯৭৯-৮৯ সময়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসন এবং তাঁর বিরুদ্ধে আফগানদের প্রতিরোধের সময়, ১৯৮৮ সালের ১ মে পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকারি হিসাবে তার ১৩ হাজার ৩১০ জন সৈন্য নিহত হয়েছিল, আহত হয়েছিল ৩৫ হাজার ৪৪৮ জন, নিখোঁজ ৩১১ জন। ১৯৮৮ সালের ১ মে জেনারেল আলেক্সি লিজিচেভের এই হিসাব ছিল সরকারিভাবে দেওয়া একমাত্র তথ্য (নিউইয়র্ক টাইমস, ২৬ মে ১৯৮৮)। আর বেসামরিক ব্যক্তিদের নিহত হওয়ার একটা হিসাব প্রথম করার চেষ্টা করেন মারেক সিলউন্সকি, ১৯৮৮ সালে পাকিস্তানে আফগান শরণার্থীদের ওপরে চালানো এক জরিপের মাধ্যমে। তার ভিত্তিতে তিনি বলেছিলেন, মোট নিহতের সংখ্যা আফগান জনসংখ্যার ৯ শতাংশ; ১০ থেকে ১৫ লাখ; এর ৮০ শতাংশ ছিল বেসামরিক নাগরিক। নূর আহমদ খালিদি এই বিষয়ে আরও গবেষণা করে দেখান মোট নিহতের সংখ্যা ৮ লাখ ৭৬ হাজার ৮২৫ জন (দেখুন—‘আফগানিস্তান: ডেমোগ্রাফিক কন্সিকিউয়েন্সস অব ওয়ার ১৯৭৮-১৯৮৭ ’, সেন্ট্রাল এশিয়া সার্ভে, বর্ষ ১০, সংখ্যা ৩,১৯৯১)।

এই পরিসংখ্যান দেওয়ার উদ্দেশ্য এটা নয় যে বাইরের শক্তিগুলোর মধ্যে কে বেশি বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যুর কারণ হয়েছে; বরং স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে আফগানিস্তানের নাগরিকেরা কত দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধের ভিকটিম হয়েছেন। এই হিসাবে ১৯৮৯ সালের পরে মুজাহিদ ও তালেবানের মধ্যে সংঘাতে কত মানুষ মারা গেছে, তার হিসাব নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, চার দশক ধরে আফগানিস্তান যে প্রাণঘাতী যুদ্ধের মধ্যে আছে, এই চুক্তি কি তার অবসানের পথ সুগম করবে?

বৃহৎ শক্তির ভূ-রাজনীতির সংঘাতের মঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে আফগানিস্তান—তার সূচনা ১৯৭৯ সালে নয়, ২০০১ সালেও নয়। কিন্তু আফগান ইতিহাস বলে যে ব্রিটিশ, সোভিয়েত বা মার্কিন কোনো বহিঃশক্তি আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, আফগান জনগণ দীর্ঘ মেয়াদে বাইরের শক্তিকে মেনেও নেয়নি। কিন্তু এর পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে যে আফগানিস্তানে রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে; কেননা, আফগানিস্তানের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পূর্ণ অধীনস্থ হতে চায়নি। আফগান অভ্যন্তরীণ সংঘাতের এটি একটি বড় উপাদান।

আফগানিস্তানে কাবুলকেন্দ্রিক ক্ষমতাশালী কেন্দ্রভিত্তিক (সেন্ট্রালাইজড) রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টায় কেবল আমির আবদুর রহমান (১৮৮০-১৯০১) ব্যর্থ হননি, কমিউনিস্টরা ব্যর্থ হয়েছে (১৯৭৪-১৯৮৯), তালেবান ব্যর্থ হয়েছে (১৯৯৬-২০০১) এবং ২০০১ সালের পরে সব সরকার ব্যর্থ হয়েছে। আফগানিস্তানের এখনকার সংবিধান সেই ধরনের রাষ্ট্র গঠনের দলিল, প্রেসিডেন্টের হাতে অভাবনীয় ক্ষমতা তার প্রমাণ। সেই কারণেই ভবিষ্যতে আফগানিস্তানে শান্তি আসবে কি না, তার একটা বড় দিক হচ্ছে আফগান সরকার ও তালেবানের মধ্যকার আলোচনার সাফল্য, দেশের রাজনীতির ও সংবিধানের বিষয়ে ঐকমত্য হওয়া না-হওয়া। চুক্তিতে এই বিষয়ে বলা হয়েছে, এই আলোচনার ওপরে মার্কিনদের সৈন্য প্রত্যাহার নির্ভর করছে।

আফগানিস্তানের এই চুক্তির পরে, বিশেষ করে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পরে, আঞ্চলিক শক্তিগুলোর ভূমিকা কী হবে, তার ওপরে নির্ভর করছে সুড়ঙ্গের শেষে আলো আছে কি না। তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের সখ্য সর্বজনবিদিত। গত ১৯ বছর পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ সমর্থন ও আশ্রয় না পেলে তালেবানের অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হতো। এখন তালেবান যখন আফগান রাজনীতিতে ভূমিকা রাখবে, তখন এত দিনের এই ঋণের বিনিময়ে তারা কী দেবে, সেটাই প্রশ্ন। পাকিস্তান সব সময় মনে করে এসেছে যে আফগানিস্তানকে তার প্রভাববলয়ের মধ্যে রাখতেই হবে তার নিরাপত্তার জন্য এবং মধ্য এশিয়ায় তার যাওয়ার পথ হিসেবে। অন্যপক্ষে ভারতের যে প্রভাব এখন আফগান সরকারের ওপর আছে, তা হ্রাস পাওয়ার যেকোনো সম্ভাবনাকে ভারত কীভাবে মোকাবিলা করবে? এই প্রশ্নগুলো নতুন নয়, যখন থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের কথা উঠেছে, সেই থেকেই হচ্ছে। কিন্তু এসবের উত্তর এখনো স্পষ্ট নয়। সৌদি আরব কী ভূমিকা নেবে? ইরানের সঙ্গে তালেবানের সম্পর্ক অতীতে বিভিন্ন ধরনের সমীকরণের মধ্য দিয়ে গেছে। ভবিষ্যতে কী হবে, তা অস্পষ্ট।

এই চুক্তিতে তালেবান অঙ্গীকার করেছে যে তারা আল-কায়েদা বা আইএসের মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সমর্থন ও আশ্রয়-প্রশ্রয় দেবে না। কিন্তু চুক্তির পরে তারা বলেছে এটা একেবার এতটা স্পষ্ট নয়। যুক্তরাষ্ট্র এটা আদায় করতে পেরে খুশি। কিন্তু এই অঙ্গীকার কি যথেষ্ট? চুক্তির একটা বড় দিক হচ্ছে, এতে আফগান নারীদের অধিকার রক্ষার কোনো অঙ্গীকার নেই। তালেবান শাসনে নারীদের বিরুদ্ধে যে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা জারি হয়েছিল, ভবিষ্যতে তার চেষ্টা হবে না, সেই অঙ্গীকার নেই। আফগান সরকারপক্ষ যখন আলোচনায় বসবে, তখন তারা তালেবানের কাছ থেকে এই অঙ্গীকার আদায় করতে পারবে কি?

যেকোনো চুক্তির পরেই বলা হয়, আমরাও জানি যে এটি কেবল সূচনা। অনেক প্রতিবন্ধকতা সামনে। সেগুলো পার হয়ে আফগান নাগরিকেরা শান্তি ও অধিকার দুই-ই পাবে, সেটা এখন কেবল আমরা প্রত্যাশাই করতে পারি।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর
আগামীকাল পড়ুন আলতাফ পারভেজের বিশ্লেষণ: আফগানিস্তান: যে যুদ্ধের শুরু ছিল সহজ, গুটিয়ে আনা কঠিন