'বজরঙ্গি ভাইজান'দের হাতে না পড়ুক শিশুরা

ফ্যাসিবাদী জার্মানিতে হিটলারের ঘৃণামন্ত্রে এভাবে দীক্ষিত করা হতো শিশুদের।
ফ্যাসিবাদী জার্মানিতে হিটলারের ঘৃণামন্ত্রে এভাবে দীক্ষিত করা হতো শিশুদের।

বছর কয়েক আগের কথা। ভারত ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক সিনেমাবাজারও দখলে নিয়েছিল একটি ছবি। দারুণ ব্যবসাসফল মুম্বাইয়ের এই ছবির নাম ‘বজরঙ্গি ভাইজান’। মানবিক ভালোবাসার ছবি। বিনোদনে ভরপুর হয়েও বক্তব্যটি অসাধারণ। ধর্ম ও সীমান্তের ব্যবধান বড় কিছু নয়, রাজনৈতিক বিশ্বাসও তুচ্ছ। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ কথাটিই পরম সত্য।

সিনেমাটির নায়ক সালমান খান ‘বজরং’ দলের একনিষ্ঠ পান্ডা। হনুমানের ছবি হোক, গণেশের ছবি হোক, দেখামাত্র বজরঙ্গি ভাইজান সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বসে। মুখে শুধুই তার ‘জয় শ্রীরাম’ ‘জয় হনুমানজি’। এই সময় ঘটনাচক্রে সে উদ্ধার করে এক পাকিস্তানি মুসলিম বালিকাকে। নিয়তির ফেরে বালিকাটি মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ‘বজরঙ্গি ভাইজান’-এর ভেতরের মহামানবটি জেগে ওঠে। আনন্দ-হাসি-কান্নার নানা ঘটনাপরম্পরায় সে বুঝে ফেলে, বালিকাটি মুসলিম এবং চিরশত্রু দেশ পাকিস্তানের। তাতে কী? অন্তরাত্মায় গভীর ভালোবাসা ও মানবিকতায় ঝলকে ঝলসে ওঠেন আমাদের ‘বজরঙ্গি ভাইজান’। এক বিপৎসংকুল ও মহাপ্রতিকূল মিশনে নামতেও পিছপা হলো না মোটেই। উদ্দেশ্য, যেভাবেই হোক শিশুটিকে মা-বাবার কাছে পৌঁছাবেই। নিজের জীবনাপন্ন করেও সে মিশনটি সফল করল। আমাদের মতো দর্শকদের চোখ কৃতজ্ঞতা, মমতা, ভালোবাসায় আর্দ্র হলো। মনে হয়েছিল, এই সিনেমা কোটি কোটি ভারতীয় দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেবে।

দিল্লিতে নির্বিচার মুসলিম হত্যাকাণ্ডের পর সিনেমাটি আবার দেখুন। ভাবুন, কারা ছিল সিনেমাটির আমদর্শক। খানিকটা কম শিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত খেটে খাওয়া নিম্ন-মধ্য বা মাঝারি আয়ের ও নিম্ন-মাঝারি সামাজিক অবস্থানের মানুষই ছিল এর মূল দর্শক। তাদের বড় অংশ কিশোর বয়সী। এই বয়সে মন থাকে কাদামাটির মতো। ভালোবাসায় ভরপুর। কাদামাটি গড়েপিটে যেমন বানানো যায় নজরকাড়া মূর্তি ও হৃদয়হরা মৃৎপাত্র; শিশু-কিশোরদেরও গড়ে তোলা যায় মানব হিসেবে। গড়ে তোলা যায় দানব হিসেবেও।

‘বজরঙ্গি ভাইজান’–এর গল্পটি শুধুই সিনেমা। শুধুই বিনোদন। সিনেমার ‘বজরঙ্গি ভাইজান’ হতে শিশু-কিশোরেরা কি ভালোবাসার পাঠ নিয়েছে? নেয়নি সম্ভবত। বাস্তবের ‘বজরঙ্গি ভাইজান’রা সিনেমার ‘বজরঙ্গি ভাইজান’ কখনোই হয় না। বাঘ যেমন কখনো তৃণভোজী হয় না! বাস্তবের শিশু-কিশোরেরা বাস্তবের ‘বজরঙ্গি ভাইজান’দের ঘাতক রূপেই আকর্ষিত হয়েছে বেশি। তাই তো এবারের দিল্লির হত্যাযজ্ঞের পুরোভাগে শিশু-কিশোরদের দেখা গেছে। তাদের হাতে ছুরি-কিরিচ-কৃপাণ-লোহা-লাঠি-পেট্রল। নির্দ্বিধায় তারা ঝাঁপিয়ে পড়ছিল হত্যাকাণ্ডে। মুসলিমদের ঘরবাড়ি-দোকানপাটে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিতে।

ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে একটি ছবি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একদল উন্মত্ত জার্মান শিশু বীভৎস আনন্দে আক্রমণ করে চলছে মায়ের প্রতিমূর্তিসম এক ইহুদি নারীকে। তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে শিয়াল তাড়ানোর ধরনে। রক্তাক্ত, অর্ধনগ্ন নারীটি প্রাণ রক্ষার জন্য ছুটছেন অনির্দিষ্টের দিকে। তাঁর কষ্টকর অভিব্যক্তিটি কোনো স্বাভাবিক সংবেদনসম্পন্ন রক্ত-মানুষের পক্ষে এক পলকের বেশি দেখা সম্ভব নয়। ছবিটিই বলে দেয় হিটলারের উগ্র নাজি জাতীয়তাবাদী ‘ডেঞ্জারাস আইডিওলজি’ সেই শিশুদের মধ্যে ঘৃণা ছড়িয়ে দিতে দারুণভাবে সফল হয়েছিল। একই রকম দৃশ্য দেখা গেল বজরং-আরএসএস-বিজেপির সম্মিলিত মুসলিম হত্যাযজ্ঞে।

শিশু-কিশোরদের নৃশংস করে তুলতে নাৎসিদের বিশেষ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। মগজধোলাই থেকে অস্ত্র চালনার সব ব্যবস্থাই রাখা ছিল সেখানে। সম্প্রতি ইন্ডিয়া টুডের ভিডিও প্রতিবেদন ছাড়াও বহির্বিশ্বের অনেকগুলো মিডিয়ায় নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রে দেখা যাচ্ছে যে একই পদ্ধতি ব্যবহার করছে বজরং-আরএসএস-বিজেপি। শিশুদের মগজধোলাই ছাড়াও লাঠিখেলা, কুস্তি, জুডো, কারাতে, শরীরচর্চা, যোগব্যায়াম এবং অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। আরও জানা গেল যে এটি কোনো নতুন কর্মসূচি নয়। বজরং-আরএসএসের জন্মলগ্ন থেকেই বজরঙ্গিরা শিশু-কিশোরদের মনের গহিনে অহিন্দুদের প্রতি তীব্র ঘৃণার বীজ পুঁতে দিচ্ছে।

‘বজরং’ একটি মতবাদ। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ও বিজেপির মূলমন্ত্র। কিন্তু এই লেখাটিতে সব ডেঞ্জারাস আইডিওলজিকেই ‘বজরঙ্গি’ বলছি। আইসিসের জন্য লাভ-জিহাদ করতে যাওয়া কিশোরীরা কী? একইভাবে মগজধোলাই করে কিশোরদের সুইসাইড বোম্বার হিসেবে ও নৃশংস খুনি হিসেবে ব্যবহার করেছে আইসিস ও তালেবান। আইসিসের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হতেও পিছপা হয়নি অনেক শিশু-কিশোর। আশির দশক থেকে নব্বইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত রুয়ান্ডায় হুটু ও টুটসি উভয় গোষ্ঠীই শিশুদের ব্যবহার করেছে। তাদের মগজধোলাইয়ের মূল লক্ষ্যই ছিল এক গোত্রের মধ্যে আরেক গোত্রের প্রতি তীব্র ঘৃণা টিকিয়ে রাখা। তাই ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডার বীভৎস হুটু-টুটসি দাঙ্গায় সরাসরি অংশ নিয়ে হত্যাকাণ্ড চালাতে দেখা গেছে কিশোরদের একটি বড় অংশকে। একই সময়ে শ্রীলঙ্কায় তামিল-সিংহলি উভয় পক্ষেই কিশোর-কিশোরীরা হয়ে উঠেছিল পারস্পরিক ঘৃণার আধার। ২০১৪ সালে উগ্র বৌদ্ধবাদী সিংহলদের দ্বারা মুসলিমদের আক্রমণের সময়ও কিশোর বয়সীরাই বেশি সক্রিয় ছিল। জাপানের বিখ্যাত আন্ডারগ্রাউন্ড কাল্ট ‘ওমশিংরিকিও’ কিশোর-কিশোরীদের বিশেষভাবে টার্গেট করত মানবঘৃণায় উজ্জীবিত করার জন্য। আমেরিকার বর্ণবাদী গুপ্তগোষ্ঠী কু-ক্লাক্স-ক্লানের উগ্র শ্বেতাঙ্গবাদী আদর্শের দীক্ষাদানের জন্য তখনো যেমন, এখনো তেমনই আদর্শ টার্গেট হয়ে রয়েছে শিশু-কিশোরেরা। বাংলাদেশের ঘৃণাবাদী জঙ্গিবাদীদের প্রাথমিক টার্গেট সরলমতি শিশু-কিশোর-কিশোরীরা।

প্রতিপক্ষ ও কল্পিত শত্রুর প্রতি সীমাহীন ‘ঘৃণা’ নির্মাণই এসব ‘বজরঙ্গি’ আদর্শের মূল। ইসরায়েলের শিশুদের বুকজুড়ে ভালোবাসার বদলে ফিলিস্তিনিদের প্রতি ঘৃণার বিষ ঢেলে রেখেছে জায়নবাদীরা। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে আমরা জেনেছি, মিয়ানমারের শিশুদের মনের গভীরের ভালোবাসার প্রদেশটি রোহিঙ্গাদের প্রতি ঘৃণার খনি হয়ে উঠেছে। মিয়ানমারের শিশুরা তাদের ‘রোহিঙ্গা’ না বলে ঘৃণাসূচক ‘কালার’ (অনাকাঙ্ক্ষিত বহিরাগত) নামে ডাকতে শিখেছে। বৌদ্ধ উগ্র জাতীয়তাবাদী ‘৯৬৯ আন্দোলন’ নামক ডেঞ্জারাস আইডিওলজিই নিষ্পাপ শিশুদের শিখিয়েছে যে রোহিঙ্গারা ‘কালার’ এবং মুসলিম। তাই তারা নিধনযোগ্য।

আমাদের শিশু-কিশোরদের নিয়ে গভীর ভাবনারও দুশ্চিন্তার প্রয়োজন আছে। তারা কী শিখছে, কী শেখাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে কোন আদর্শের বা বিশ্বাসের বলি হতে যাচ্ছে, নজর রাখা দরকার। ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট’ বা ‘টেকসই উন্নয়ন’ নামক গালভরা বুলিটির সংজ্ঞার জন্মই হয়েছে ওদের জন্য। ‘এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব’—সুকান্তের এই প্রত্যাশাই মূর্ত সেখানে। আমরাই মেনে নিয়েছি যে ‘টেকসই উন্নয়ন’ সেটিই, যা হলে বাসযোগ্য দুনিয়ায় আমাদের সন্তানদের রেখে শান্তিতে ও নিশ্চিন্তে শেষনিশ্বাসটি ত্যাগ করতে পারব। সে জন্য তাদের শিক্ষায়, বোধে, মননে ছড়িয়ে দিয়ে যাওয়ার কথা পরিবেশের প্রতি দায়িত্ববোধ, প্রাণের প্রতি ভালোবাসা এবং ধ্বংস ও ধর্ষকামিতার প্রতি ঘৃণা।

কিন্তু সেসব না হয়ে ‘বিপজ্জনক মতবাদ’গুলোর (ডেঞ্জারাস আইডিওলজিস) দাবার গুটি হচ্ছে কিশোর-কিশোরীরা। দুনিয়ার নজরও এদিকটায় তেমন একটা নেই। এই সুযোগে কিশোর-কিশোরীদের প্রাণশক্তি ও বোধের নিদারুণ অপব্যবহার করে নিচ্ছে ‘বজরঙ্গি’রা। তাই তো দেখি এই ‘বজরঙ্গি’দের স্বভাব ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইসরায়েল, সিরিয়া, ইরাক, কঙ্গো, সুদানে—সব জায়গায় একই রকম।

যেকোনো বজরঙ্গিবাদই শিশু-কিশোরদের খুনি–অমানুষ বানিয়ে ফেলতে পারে। ধর্মের খোলসে, জাতীয়তাবাদের জজবায় বা দেশপ্রেমের মোড়কে বজরঙ্গিবাদ শিশু-কিশোরমনে ঘৃণার বিষবৃক্ষ রুয়ে দেয়। বর্তমান সময়ে পৃথিবীর অনেকগুলো গণতান্ত্রিক পরিচিতির দেশেই ফ্যাসিজম থাবা বিস্তার করে চলেছে। ফ্যাসিজম সচরাচর শিশু-কিশোরদের ঘৃণাবাদী করে গড়ে তোলার প্রক্রিয়াগুলো সচল রাখে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, শিশুদের ঘৃণাচর্চামুক্ত রাখার জন্য বিশ্বময় সামাজিক সতর্কতা আন্দোলনের বিকল্প নেই। পারিবারিক পর্যায়ে সচেতন নজরদারি দরকার, যাতে শিশু-কিশোরেরা ঘৃণার কারিগরদের হাতের পুতুল হয়ে উঠতে না পারে। মনে রাখা দরকার, ঘৃণামুক্ত ‘বজরঙ্গি ভাইজান’ শুধু সিনেমাতেই সম্ভব, বাস্তবে নয়।

হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোসিওলজি; নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।