যে যুদ্ধের শুরু সহজ ছিল, গুটিয়ে আনা কঠিন

আফগানিস্তানে দীর্ঘ দেড় যুগের সহিংসতা বন্ধে ঐকমত্যে পৌঁছেছে যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবান। দেশটিতে শান্তি ফিরিয়ে আনতে দুই পক্ষ শান্তি চুক্তি সই করেছে। ছবি: এএফপি ফাইল ছবি।
আফগানিস্তানে দীর্ঘ দেড় যুগের সহিংসতা বন্ধে ঐকমত্যে পৌঁছেছে যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবান। দেশটিতে শান্তি ফিরিয়ে আনতে দুই পক্ষ শান্তি চুক্তি সই করেছে। ছবি: এএফপি ফাইল ছবি।

দোহায় মোল্লা আবদুল গনি বারাদারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘চুক্তি’র দৃশ্যটি বেশ কৌতুককর ছিল। তালেবানের প্রধান প্রয়াত মোল্লা ওমরের ডেপুটি ছিলেন আবদুল গনি। ২০১০-এর ফেব্রুয়ারিতে আটকও হয়েছিলেন পাকিস্তানের করাচিতে। আট বছর পর তাঁকে সুস্থভাবেই ছেড়ে দেওয়া হয় সিআইএর অনুরোধে এবং এখন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে আরেক ফেব্রুয়ারিতে তাঁর সঙ্গেই যুদ্ধ বন্ধে চুক্তি করলেন দেশটির আফগানিস্তান পুনর্মিলনবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি জালমে খলিলজাদ। অথচ ওয়াশিংটন বরাবরই ‘সন্ত্রাসীদের’ মদদ দেওয়ার দায়ে পাকিস্তানকে দোষারোপ করে থাকে।

আন্তর্জাতিক রাজনীতি ঠিক এমনি। সাধারণ মানুষের জন্য অবোধগম্য অনেক জটিল ধাঁধা থাকে তাতে। ন্যাটোর সঙ্গে আফগান তালেবানের যুদ্ধ চলছে প্রায় ১৯ বছর। এ যুদ্ধে প্রায় অর্ধলাখ সাধারণ আফগান মারা গেলেও মোল্লা ওমরের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে এবং মোল্লা আবদুল গনিও বেঁচে আছেন। আর সেই যুদ্ধ বন্ধে চুক্তি হলো মাত্র ‘এক সপ্তাহ সহিংসতা কমা’র এক নিরীক্ষা চালিয়ে! দৃশ্যটি এবং ভাষ্যগুলো অস্বাভাবিক। কৌতূহলকরও বটে।

বাস্তবে উভয় পক্ষই এই যুদ্ধে ক্লান্ত ছিল এবং যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণায় উভয়ের স্বার্থ রয়েছে। কেবল নেই সাধারণ আফগানদের জন্য স্থায়ী কোনো আশাবাদ।

‘চুক্তিতে’ কী আছে এবং কী নেই

২৯ ফেব্রুয়ারির চুক্তির মূল দিক হলো তালেবান অঙ্গীকার অনুযায়ী সহিংসতা বন্ধ করলে ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তান ছাড়বে। তাদের ভাড়াটে সশস্ত্র ঠিকাদারদেরও দেশটি ছাড়তে হবে। ১৪ মাসের মধ্যে এটা হবে; তবে সেটা ঘটবে ‘পর্যায়ক্রমে’। প্রাথমিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র সৈন্যসংখ্যা আগামী চার-পাঁচ মাসে আট-নয় হাজারে নামিয়ে আনবে। বাকিদেরও সরানো হবে ধাপে ধাপে, আনুমানিক তিন বছর সময়ের মধ্যে। ন্যাটোর অন্য সদস্যরাও সৈন্য কমাবে। সব সামরিক ঘাঁটি থেকেই সৈন্য সরানো হবে। এর মধ্যে তালেবান বন্দীদেরও ছাড়তে হবে। প্রায় পাঁচ হাজার তালেবান যোদ্ধা ন্যাটো বাহিনীর হাতে বন্দী অবস্থায় আছে। তাঁরা এখনই ছাড়া পাবেন! যদিও তাঁদের ছবি দেখিয়েই বিশ্বব্যাপী ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ চলেছিল গত দেড় দশক!

 ‘চুক্তির’ অংশ হিসেবে তালেবানও নিশ্চিত করবে আল-কায়েদা, আইএস, হাক্কানি নেটওয়ার্ক বা ও রকম সশস্ত্র শক্তিগুলোকে তারা আর সহযোগিতা করবে না। তাদের হাতে থাকা আফগান সরকারি বাহিনীর প্রায় এক হাজার বন্দীকেও ধাপে ধাপে ছাড়তে হবে এখন।

এর মধ্যেই চুক্তি অনুযায়ী আফগানিস্তানের বর্তমান সরকারের সঙ্গে তালেবানের আলোচনা শুরু হবে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সেটা শুরু হতে পারে। চুক্তির প্রতিটি অঙ্গীকারই পরস্পর সম্পর্কিত। অর্থাৎ একটা প্রতিপালনে সমস্যা হলে বাকিগুলোও বিলম্বিত হবে। এটাই হলো দুশ্চিন্তার দিক।

চুক্তির ভাষা ও ধরন বলছে, বর্তমান সমঝোতা কেবল একটা সম্ভাব্য শান্তিচুক্তির প্রাথমিক শর্ত মাত্র। যখন সবার হাতে বন্দুক থাকবে বটে, তবে ট্রিগারে আঙুল থাকবে না। বিষয়বস্তুর দিক থেকে এই চুক্তি গত সেপ্টেম্বরে যে চুক্তি হওয়ার কথা ছিল, তার মতোই। এটা প্রথাগত কোনো শান্তিচুক্তি নয়। বরং কয়েক স্তরের একটা চুক্তির একাংশ মাত্র। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে দেশটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈনিকেরা তাৎক্ষণিকভাবে চলে যাবে না। তালেবানও এখনই তাদের হারানো ‘ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তান’ আবার গড়তে পারছে না। দুটিই অনেক সময়সাপেক্ষ বিষয় হবে। এমনকি চুক্তিতে বারবার বলা হয়েছে, তালেবানের ‘ইসলামিক আমিরাতকে’ যুক্তরাষ্ট্র কোনো বৈধ সরকার বলে স্বীকারও করছে না।

চুক্তির নড়বড়ে ভাষা সাক্ষ্য দিচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবান—কেউ কাউকে এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করছে না। ভবিষ্যৎ নিয়েও তারা অতি আশাবাদী স্বপ্ন দেখায়নি। তবে একটা ‘ইসলামি’ সরকার প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত রয়েছে চুক্তির দলিলে। তালেবানের দিক থেকে এটা একটা সফলতাই বটে।

এই সময় কেন এ চুক্তি হলো

যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে নানা রূপে যোগাযোগ চলছে ২০১২ থেকে। তারও আগে প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই ২০০৭-এ তালেবানের দিকে আলোচনার হাত বাড়িয়েছিলেন। সর্বশেষ ২৯ ফেব্রুয়ারি যে চুক্তি হলো, তার পেছনে প্রায় আট বছরের আলাপ-আলোচনার শ্রম রয়েছে।

এ চুক্তিতে সবচেয়ে উচ্ছ্বসিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং সাধারণ আফগানরা। উভয়ের উচ্ছ্বাসের ভিন্ন ভিন্ন কারণ রয়েছে। ট্রাম্পের জন্য নির্বাচনী মৌসুম এখন। বর্তমান সমঝোতার বড় পটভূমি হিসেবে কাজ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের আগামী নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। দীর্ঘ আলোচনার পর ঠিক এই সময় এসে যে শান্তির আওয়াজ উঠবে, সেটা ভবিতব্যই ছিল। বিষয়টি নির্মম ও কৌতুককর হলেও সত্য—যুদ্ধ ও শান্তি দুটিই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে হয়েছে।

আফগানিস্তানের শান্তির চেয়েও ট্রাম্পের জন্য জরুরি ছিল একটা চুক্তি। সেটা যতটা প্রতীকী চরিত্রেরই হোক না কেন। তিনি সফল। নভেম্বরের আগে টিভিতে আফগানিস্তান থেকে সৈন্যদের বাড়ি ফেরার দৃশ্য ট্রাম্পের জন্য বিজ্ঞাপনচিত্রের মতো কাজ করবে। এই চুক্তি তাঁকে নির্বাচনী যুদ্ধে অনেক এগিয়ে দিল। নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েও ওবামা যা পারেননি, ট্রাম্প তাতে প্রাথমিকভাবে সফল। হয়তো টুইটারে এবার তিনি পুরস্কারটি দাবিও করে বসতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে বড় দাবিদার কূটনীতিবিদ জালমে খলিলজাদ। যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে কূটনীতিকের দায়িত্বে থাকলেও জন্মসূত্রে তিনি আফগান। আফগানদের কেউ এখনো শান্তিতে নোবেল পাননি। সে রকম কিছু হলে খলিলজাদ হবেন মালালা ইউসুফজাইয়ের পর এই পুরস্কার পাওয়া দ্বিতীয় পশতুন। যদিও এখন আর পশতুন নন, যুক্তরাষ্ট্রেরই মানুষ তিনি এবং ওয়াশিংটনের স্বার্থই দেখছেন আফগানিস্তানে।

খলিলজাদের বড় কৃতিত্ব, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর স্বার্থের বিবেচনা থেকে ফেব্রুয়ারি চুক্তি বেশ লাভজনক হয়েছে। চুক্তির পরই ন্যাটো সৈন্যদের আফগানিস্তান ছাড়তে হচ্ছে না। বরং তালেবানের হামলা থেকে নিজেদের নিরাপদ করার কিছুটা নিশ্চয়তা পেল তারা। আরেকটি লাভের দিক, তালেবানকে এখন বর্তমান আফগান সরকারের দিকে ঠেলে দেওয়া গেল। ফলে ভবিষ্যতের যেকোনো সহিংসতার দায় ওয়াশিংটন ওই দুই পক্ষের ওপর বর্তাতে পারবে।

যুক্তরাষ্ট্র জানে, সাধারণ আফগানরা যুদ্ধে যুদ্ধে অধৈর্য। তালেবানের সঙ্গে দেশটির তৃণমূলের সংযোগ রয়েছে। সাধারণ মানুষের এই ক্লান্তিকে আমলে না নিয়ে তাদের উপায় থাকবে না। ফলে তালেবানের যুদ্ধ–সামর্থ্য হয়তো ক্রমে এখন নিষ্ক্রিয় হবে।

সর্বশেষ সমঝোতা সম্ভব হয়েছে চীন ও পাকিস্তানের উৎসাহেও। তারা তালেবানকে চুক্তিতে আসতে মদদ দিয়েছে। এ দুই দেশ তাদের অর্থনৈতিক করিডরের সঙ্গে দ্রুত আফগানিস্তানকে যুক্ত করতে আগ্রহী। সেটা ঘটাতে পারলে উভয় দেশের জন্য বড় ধরনের অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক ফায়দা আছে। আর মস্কো আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নতমুখে বিদায়ের যেকোনো দৃশ্যের অন্যতম উত্সাহী দর্শক হয়ে আছে বহুদিন। আফগানিস্তানের ইতিহাসে তারাই কেবল এখন আর পরাজিত পরাশক্তি নয়।

শান্তি আসবে কি

প্রায় ১৯ বছর চলছে সর্বশেষ এ আফগান মহাযুদ্ধের। গত বছরও এ যুদ্ধে ১৪ হাজার গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। তাতে বেসামরিক মানুষ আহত-নিহত হয়েছে প্রায় ১০ হাজার। এর আগেও দেশটিতে লাখ লাখ মানুষ আহত-নিহত হয়েছে সোভিয়েত ও ব্রিটিশ সৈনিকদের সঙ্গে। সংগত কারণেই বিশ্বজুড়ে গত দুই দিন আলোচনা চলছে, সর্বশেষ চুক্তিটি রক্তপাতের ধারাবাহিকতার শেষ ঘটাতে চলেছে কি না।

এর কোনো নিশ্চিত উত্তর নেই। বরং সব ভাষ্যকারের পর্যবেক্ষণে সংশয়ই প্রকাশ পাচ্ছে। এর কারণ, আফগানিস্তানের বিষয়ে তালেবান বা যুক্তরাষ্ট্রই কেবল ‘পক্ষ’ নয়। দেশের অভ্যন্তরে তালেবান ছাড়াও রয়েছে আইএস ও আল-কায়েদা। তারা সহিংসতা চালিয়ে যেতে পারে। আইএস তালেবানের এক বড় প্রতিপক্ষ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিতে অসন্তুষ্ট দলত্যাগী তালেবান সদস্যদের কাছে টানার জন্য আইএস অপেক্ষায় আছে। তালেবানের সব কমান্ডার বর্তমান চুক্তিতে সন্তুষ্ট হবেন, সেটা না–ও হতে পারে।

আবার জাতিগত দিক থেকে পশতু ছাড়াও হাজারা, তাজিক ও উজবেকরা আফগান সমাজের গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শক্তি। এ রকম সবার হাতে অস্ত্র রয়েছে। কোনো অবস্থায় কোনো শক্তি নিজেদের উপেক্ষিত দেখতে চাইবে না। ন্যাটো বাহিনী প্রত্যাহার হলে শিয়া হাজারারা সুন্নি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর আক্রমণের খোরাক হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। তালেবানের স্মৃতিতে এ–ও উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে—তাজিক, উজবেক ও হাজারারা তাদের উৎখাতে ন্যাটোকে সাহায্য করেছিল। একটি চুক্তি ইতিহাস থেকে রক্তের সব দাগ মুছে দিতে পারে না।

অভ্যন্তরীণ এ জাতিগত রসায়নের গভীর সম্পর্ক রয়েছে দেশটির সীমান্ত পরিস্থিতিরও। আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দেশটিতে শান্তি আনতে পাশের অন্তত পাঁচ প্রতিবেশীকেও সন্তুষ্ট করার দক্ষতা দেখাতে হবে হবু সরকারকে। বিশেষ করে পাকিস্তান ও ইরানকে। ভারতসহ ওই দুই দেশ ভবিষ্যতের সরকার গঠনের আলোচনায় নিজ স্বার্থ খুঁজতে নেমে পড়বে এখনই। এ রকম সব পক্ষকে সন্তুষ্ট করে একটা প্রশাসনিক ফর্মুলা তৈরি সহজ নয়। ফলে শান্তির সম্ভাবনা বরাবরই ঝুঁকিতে থাকবে। ঘরের ও বাইরের সব শক্তির সহযোগিতা ছাড়া দেশটিতে দ্রুত স্থিতিশীলতা আশা করা যায় না। চূড়ান্ত স্থিতিশীলতা ও শান্তি আনতে অবশ্যই দরকার হবে সবার অস্ত্র সমর্পণ। আফগানিস্তানের সমাজজীবনের জন্য যা প্রায় অবিশ্বাস্য এক চাওয়া। দেশটির সব পাড়ায় অস্ত্র রয়েছে।

চুক্তি প্রতিবেশীদের কতটা সন্তুষ্ট করছে?

ন্যাটো সৈন্যরা বিদায় নিলে আফগানিস্তানে প্রতিবেশী দেশগুলোর ভূমিকাই হবে মুখ্য। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে কাবুলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের সুসম্পর্ক থাকলেও আফগান পশতুরা পাকিস্তান সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ। আবার আফগানিস্তানের বর্তমান সরকার ভারতের অন্যতম মিত্র হলেও সাধারণ আফগানরা বিজেপি সরকারের মুসলমানবিদ্বেষের বিষয়ে ওয়াকিবহাল। জটিল এ হিসাব কাবুলে নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে মার্চ থেকে।

পাকিস্তান মনে করে, ২৯ ফেব্রুয়ারির চুক্তিতে সাহায্য করে যুদ্ধে পরাজিত যুক্তরাষ্ট্রকে মুখ রক্ষায় সাহায্য করেছে তারা। এর প্রতিদান হিসেবে ভবিষ্যতের আফগানিস্তানে তার স্বার্থ রক্ষিত হতে হবে। বিশেষ করে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় এলে তালেবান ১৮৯৩-এ তৈরি অমীমাংসিত সীমান্তরেখা হিসেবে ‘ডুরান্ড লাইন’ মেনে নেবে এবং এ নিয়ে কোনো বিতর্ক তুলবে না। এমন আশ্বাস পাকিস্তানের জন্য জরুরি। প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তকে স্থায়ী বিভক্ত রেখা হিসেবে মেনে নেওয়া মানে পশতুনদের ঐতিহাসিক অঞ্চলটি দুই খণ্ড হয়ে যাওয়া। তা ছাড়া এতে আফগানিস্তান বড় কিছু ভূখণ্ড হারাবে। এটা নিশ্চিত, আফগান শান্তি আলোচনা চূড়ান্ত রূপ পাওয়ার আগেই পাকিস্তান এ বিষয়ে তালেবানের সঙ্গে একটা রফায় আসতে চাইবে।

তালেবানের কাছে ভারতেরও বহু আরজি আছে। কাবুলে প্রভাব ধরে রাখা তাদের জন্যও অতি জরুরি। দোহায় চুক্তি স্বাক্ষরের মুহূর্তেই ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা কাবুল চলে গেছেন। কাতারে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন সেখানকার ভারতীয় রাষ্ট্রদূত পি কুমার। ২০০১-এর পর এই প্রথম তালেবানের কোনো অনুষ্ঠানে ভারতের কোনো কূটনীতিবিদকে দেখা গেল। এটাই আজকের দিনের ‘আন্তর্জাতিক রাজনীতি’!

আফগানিস্তানে রাশিয়া ও ইরানেরও সুনির্দিষ্ট ভূরাজনৈতিক স্বার্থ আছে। ইরান শিয়া হাজারাদের সরকারে শক্তিশালী অবস্থানে দেখতে চাইবে। মাজার-ই-শরিফে ২২ বছর আগে তালেবানের হাতে একদা তাদের ৯ কূটনীতিবিদকে প্রাণ হারাতে হয়েছিল। সে অবস্থার প্রত্যাবর্তন তারা মোটেই চাইবে না। ইতিমধ্যে গত এক দশকে শত শত হাজারাকে সামরিকভাবে প্রশিক্ষিত করে রেখেছে সদ্য প্রয়াত জেনারেল কাশেম সোলাইমানির আল-কুদস বাহিনী।

তাজিক ও উজবেকদের সামনে রেখে রাশিয়াও আফগানিস্তানে তার প্রভাব বাড়াতে চাইবে। আর চীন নতুন আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক অবকাঠামো তৈরির কাজগুলো পেতে উন্মুখ হয়ে আছে। তাকেও সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ‘নিজস্ব মানুষ’ খুঁজে পেতে হবে। উইঘুরদের কেউ যাতে আফগানিস্তান থেকে সশস্ত্র হয়ে কাশগরের দিকে যেতে না পারে, সেটাও তালেবানের কাছে চীনের চাওয়া। রাশিয়াও একইভাবে তার চেচেন ও উজবেক গেরিলাদের ফিরতে দেখতে চায় না। তালেবান ইতিমধ্যে রাশিয়া ও চীনকে যেকোনো চূড়ান্ত শান্তিচুক্তির ‘সাক্ষী’ হওয়ার আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছে। এর কারণ স্পষ্ট। রাশিয়ার সহযোগিতা ছাড়া উজবেক ও তাজিকদের সামলাতে পারবে না পশতুভাষী তালেবান। একই কারণে ইরানও তালেবানের জন্য জরুরি।

‘শান্তিচুক্তি’র পর আরেক বড় চ্যালেঞ্জ হবে ইরান ও পাকিস্তান থেকে শরণার্থীদের দেশে ফেরার ব্যবস্থা করা। এই ২ দেশে প্রায় ৩০ লাখ আফগান শরণার্থী হিসেবে আছে। অনেক শরণার্থীর শঙ্কা, অনিশ্চয়তার মধ্যেই তাদের ফেরত যেতে বাধ্য করা হবে। পাকিস্তান ও ইরান উভয়ে এ কাজ দ্রুত সমাধা করতে সর্বোচ্চ চাপ দেবে এখনই। পাকিস্তানের উপজাতীয় এলাকায় অশান্তির এক বড় কারণ আফগান শরণার্থীরা। আফগান যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিপুল সাহায্য পেয়েছে দেশটি—বিনিময়ে নিজ দেশে তালেবানের একটা শাখাকে মোকাবিলা করতে করতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ক্লান্ত।

আফগান সরকারের ভবিষ্যৎ কী?

বর্তমান আফগান সরকার অর্থ ও সামরিক শক্তি উভয় অর্থেই ন্যাটোর মদদের ওপর নির্ভরশীল। তার দায়িত্ব হবে ক্রমে দেশে শাসনভার জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিদের কাছে হস্তান্তর করা। দ্রুত এ কাজ শুরু হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের শেষ সৈনিকটি যাওয়ার আগেই সরকারকে এ কাজ সমাধা করে বিদায় নিতে পারলে ভালো হয়। ইতিমধ্যে সৃষ্ট সমঝোতার ধরন দেখে স্পষ্ট, তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় বর্তমান সরকারকে দুটি বিষয় ফয়সালা করতে হবে। একটা, স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চুক্তি এবং আরেকটা, ক্ষমতার হিস্যাসংক্রান্ত চুক্তি। দুটিই দুরূহ। সময়সাপেক্ষ। তবে তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় সরকারকে কূটনৈতিক মদদ দেওয়া অব্যাহত রাখবে যুক্তরাষ্ট্র।

ন্যাটো সমর্থিত এই সরকার এ মুহূর্তে প্রায় দ্বিধাবিভক্ত। প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানিকে মানতে অনিচ্ছুক সরকারের প্রধান নির্বাহী আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ। সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই, প্রভাবশালী আরেক নেতা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার, উজবেক নেতা রসিদ দোস্তামের ছেলে বাতুর দোস্তাম মদদ দিচ্ছেন আবদুল্লাহকে। এ রকম অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে তালেবানের সঙ্গে কারা আলোচনায় বসবে, সেটা নির্ধারণ কঠিন হবে। বিভিন্ন গোত্রপ্রধানদের ‘লয়া জিরগা’ ডেকে একটি প্রতিনিধিদল বাছাইয়ের দিকে যেতে পারে সরকার। তালেবানের কাছেও তা অধিক গ্রহণযোগ্য হবে।

দেশটির সর্বশেষ নির্বাচন এবং নির্বাচিতদের তালেবানের তরফ থেকে কোনো বৈধতা নেই। ফলে সরকারের অন্তঃকলহ ও দ্বিধাবিভক্তি তাদের জন্য ভালো সুযোগ। এতে সরকার সমর্থক রক্ষীদলেও আনুগত্যের প্রশ্নে ভাঙন ধরতে পারে, যা কৌশলগত অবস্থানে ও দর–কষাকষিতে তালেবানকে ভালো অবস্থানে রাখবে।

ন্যাটোর আগ্রাসনে দেশটির যে অভিজাতরা তালেবানের বিরুদ্ধে ছিল, তাদের অনেকেই ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত। এদের একাংশ প্রতিহিংসা এড়াতে আপাতত দেশ ছাড়বে। ফলে ন্যাটো মদদপুষ্ট বর্তমান সরকার শিগগির আরও দুর্বল হয়ে পড়বে বলে মনে হচ্ছে। তার বাড়তি দুর্বলতা মানে গৃহযুদ্ধের শঙ্কা, যা এ মুহূর্তে আইএস বা আল-কায়েদা ছাড়া কোনো পক্ষ চাইছে না।

কার জয়, কার পরাজয়

বর্তমানে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার সৈন্য রয়েছে বলে প্রচারিত। আফগানিস্তানে নিজেদের প্রত্যেক সৈনিকের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক খরচ প্রায় ১০ লাখ ডলার। ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণামতে আফগানিস্তানে ২০০১ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ওয়াশিংটনের যুদ্ধ খরচ প্রায় ৯৭৫ বিলিয়ন ডলার, যা এখনো অব্যাহত আছে। এ খরচ আফগান যুদ্ধে সহায়তার জন্য পাকিস্তানকে দেওয়া সাহায্যের অতিরিক্ত। যুদ্ধে তাদের অন্তত ২ হাজার ৪০০ সৈন্য মারা গেছে এবং ২০ হাজার সৈন্য আহত হয়েছে। ন্যাটোর অন্যদেরও প্রায় ১ হাজার ৪০০ সৈন্য খুন করেছে আফগানরা।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘকালের যুদ্ধ এটা। একসময় আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য সংখ্যা এক লাখের বেশি ছিল (২০১১)। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তালেবানকে পরাজিত করতে পারেনি। ক্রমে তারা বুঝেছে এ যুদ্ধে বিজয় অসম্ভব। ফলে ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে এবং এখন প্রতিপক্ষের হাতেই দেশটিকে দিয়ে যেতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এ যাওয়া বিজয়ীর বেশে নয়। এবং ঠিক কী অর্জন করতে তারা আফগানিস্তানে এসেছিল, সেই প্রশ্নের কোনো ভালো উত্তর নেই এ মুহূর্তে তাদের হাতে।

নিশ্চিতভাবেই তালেবান বিজয়ীর ভঙ্গিতেই ভবিষ্যতে কাবুল সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসবে। ইতিমধ্যে তারাই দেশটির বিশাল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। অস্ত্র, জনবল ও জনসমর্থন কোনো কিছুর ঘাটতিতে নেই তারা। সবাই জানে, সেখানে একধরনের ছায়া সরকার চালাচ্ছে তারা। শান্তি আলোচনা এগোলে ভবিষ্যতে দেশ ক্রমে তাদের আরও নিয়ন্ত্রণে যেতে থাকবে।

তবে চুক্তির পর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যেভাবেই হোক, তালেবানকে বর্তমান আফগান সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। এটা তালেবানের একরূপ নৈতিক পরাজয়। কারণ, এই সরকারকে এত দিন তারা স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে এসেছে। তাদের জন্য জয়-পরাজয়ের আসল পরীক্ষা অপেক্ষা করছে আসন্ন দিনগুলোতে। দেশকে নেতৃত্ব দিতে হলে পুরো আফগানিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। যদি পশতু নেতৃত্ব অন্যান্য জাতিসত্তাকে সঙ্গে নিয়ে দেশ পরিচালনার আস্থা তৈরি করতে না পারে, তাহলে তালেবানের আজকের ‘বিজয়’ অর্থহীন হয়ে যাবে।

শান্তির স্বার্থে ভবিষ্যৎ আফগানিস্তানে আরও বহুদিন একটা জাতীয় সরকার প্রয়োজন। দেশটিতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের চেয়েও এ মুহূর্তে জরুরি সশস্ত্রতা কমানো, বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা এবং প্রায় পুরোপুরি বিধ্বস্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো গড়া। এ কাজ একক কোনো দল পারবে না। বর্তমান আফগান সরকারের একাংশ তালেবান প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করে এখনই একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গড়তে ইচ্ছুক।
তবে অন্য কোনো রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে যৌথভাবে কাজের অভ্যাস নেই তালেবানের। তারা বরং নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি তুলতে পারে। যেখানে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে তারা অংশ নেবে। বিবাদিত এ বিষয়েও নাটকীয় অগ্রগতি ঘটা বিচিত্র নয়। বিশেষ করে যখন চুক্তি স্বাক্ষরের আগেই নিউইয়র্ক টাইমস সিরাজুদ্দিন হাক্কানির লেখা ছাপল। এই তালেবান নেতাকে ধরতে একসময় যুক্তরাষ্ট্র ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। ২০ ফেব্রুয়ারি দেশের প্রধান কাগজে তাঁর লেখা দেখে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সংবাদপত্র পাঠকই চমকে উঠেছেন।

তালেবানের তরফ থেকে এটা এক করুণ প্রতিশোধই বলতে হবে। কারণ, গত ১৯ বছর এই আমেরিকানদের করের অর্থই ঢালা হয়েছে আফগানিস্তানের যুদ্ধক্ষেত্রে সিরাজুদ্দিন হাক্কানি আর মোল্লা আবদুল গনি বারাদারদের পরাস্ত করার জন্য। এখন তাঁদের ক্ষমতায় অভিষেক সম্পন্ন করেই কেবল যুক্তরাষ্ট্র সেখান থেকে ফিরে আসতে চায়।

আলতাফ পারভেজ: ইতিহাস বিষয়ে গবেষক