দিল্লি-সহিংসতা: ভারতকে পেছনে ঠেলে এগোতে চায় বিজেপি

এএফপি ফাইল ছবি।
এএফপি ফাইল ছবি।

নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের (সিএএ) পক্ষের বা বিপক্ষের বড় বড় সংবাদমাধ্যম দিল্লির ঘটনা বর্ণনা করার সময় ‘বিক্ষোভকারী’ অথবা ‘দুই পক্ষ’ সংঘর্ষে জড়িয়েছে বলে যে তথ্য দিচ্ছে, তাতে কেউ বিভ্রান্ত হবেন না। ভগবানের দোহাই, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জি কিশান রেড্ডি ‘দুর্বৃত্তরা ভারতের বদনাম করার জন্য চক্রান্ত করছে’ বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা বিশ্বাস করবেন না। কারণ, এটি মোটেও সংঘাত নয়, এটি হামলা। এই হামলা যারা করেছে তারাও কেউ অচেনা নয়।

৭০ দিন ধরে রাজধানী দিল্লি ও অন্যান্য জায়গায় সিএএ নিয়ে যাঁরা প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন, তাঁরা কোথাও কোনো অশান্তি ঘটাননি। তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় জাতীয় পতাকা হাতে ধর্নায় বসেছেন। তাঁদের হাতে ছিল সংবিধানের কপি কিংবা ড. বি আর আম্বেদকর, মহাত্মা গান্ধী ও মাওলানা আজাদের ছবি। তাঁরা কোথাও পাথর ছোড়েননি। কারও বাড়িঘর জ্বালাননি। কাউকে মারধর করেননি। ৭০ দিন ধরে তাঁরা অহিংস প্রতিবাদ করে যাওয়ার পরও আচমকা কেন দিল্লি সহিংসতায় ভরে গেল? কারা এই ঘটনা ঘটাল? কারা এমনটি হতে দিল?

এখন আর এ বিষয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই, বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র পুলিশের উপস্থিতিতে বিজেপি কর্মীদের মুসলমানদের ওপর সরাসরি হামলা চালানোর আহ্বান জানানোর পর থেকেই এই সহিংসতা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। যে দিল্লি পুলিশ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে জবাবদিহি করে থাকে, সেই দিল্লি পুলিশ কপিল মিশ্রকে এই ধরনের উসকানি দিতে বাধা তো দেয়ইনি বরং সহিংসতা ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সুস্পষ্টভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

মিশ্রর ভাষণ শুনে হিন্দুত্ববাদী একদল পাণ্ডা উত্তর-পূর্ব দিল্লির একটি সিএএ-বিরোধী সমাবেশে প্রথম আক্রমণ চালায়। একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত হলে নিশ্চিতভাবে দেখা যাবে, সেখানে বিনা উসকানিতে আক্রমণের শিকার হওয়ার পর প্রাণ বাঁচাতে বিক্ষোভকারীরা প্রতিরোধমূলক লড়াই চালিয়েছেন। এ সময় দিল্লি পুলিশ ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর যে ভূমিকা ছিল, তা–ও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। সেখানে একতরফাভাবে একটি শান্তিপূর্ণ অবস্থানে থাকা লোকের ওপর চালানো হামলাকে কিছু বড় সংবাদমাধ্যম ‘সিএএপন্থী ও সিএএ–বিরোধীদের মধ্যকার সংঘর্ষ’ বলে চালিয়ে দিল। কিন্তু প্রকৃত কুৎসিত সত্য সেই দিন রাতে ও পরদিন সকালে বেরিয়ে এল।

হামলাকারীরা যদি শুধু সিএএ-এর সমর্থনে রাস্তায় নেমে থাকে, তাহলে তারা কেন ‘হিন্দুস্তানমে রেহনে হোগা তো “জয় শ্রীরাম” বোলনা হোগা’ (হিন্দুস্তানে থাকতে হলে ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে হবে) স্লোগান দিচ্ছিল? এটি স্পষ্ট যে হিন্দুত্ববাদীরা সিএএ–বিরোধী সমাবেশের নামে নির্বিচার মুসলমানদের ওপর হামলা চালিয়ে এমন একটি ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করতে চেয়েছে, যাতে গোটা দিল্লিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তৈরি হয়। হিন্দু–মুসলমানের মধ্যে যাতে বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তার জন্য তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে।

আসল সত্য হলো, মুসলমানদের দিক থেকে কোনো ধরনের উসকানি ছাড়াই উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে মুসলমানদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছে। যেভাবে বাবরি মসজিদের মিনারে উঠে গৈরিক পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, অশোক নগরের বড় মসজিদে ঠিক একই কায়দায় হিন্দুত্ববাদীরা হামলা চালিয়েছে। একই কায়দায় মিনারে উঠে হনুমান পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে। এরপর তারা মসজিদটিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।

আমার দুই সহকর্মী নাওমি বার্টন ও অবিচল দুবে ওই সময় অশোক নগরের ঘটনাস্থলে ছিলেন। তাঁরা দ্রুত এই মসজিদে হামলা নিয়ে প্রতিবেদন করলেন। বিজেপি সমর্থকেরা তাৎক্ষণিকভাবে সেই খবরকে ভুয়া খবর বলে উড়িয়ে দেওয়া শুরু করলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা হোম কিষান রেড্ডি ঘোষণা দিলেন, যে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে খবরটি প্রচার করা হয়েছে, সেটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তবে শেষ পর্যন্ত ওই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ ভিডিও ফুটেজ ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ার পর রেড্ডি চুপ করে গেলেন। এরপরই আমরা মুজাফ্ফরাবাদে মসজিদে আগুন দিতে দেখলাম। সবচেয়ে বেদনাজনক দৃশ্য হলো, গরিব মুসলমান পরিবারগুলোর কুঁড়েঘরে আগুন দিয়ে মুখোশ পরা হিন্দুত্ববাদীরা পুড়িয়ে দিচ্ছে এবং মুসলমান নারী ও শিশুদেরও শাসানি দেওয়া হচ্ছে, জয় শ্রীরাম না বললে তাদের মেরে ফেলা হবে।

দিল্লি পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলাকে যাঁরা ‘ভারতের বদনাম’ ঘটানোর চক্রান্ত বলে মনে করেন, তাঁরাও জানেন পুলিশ এই সময়ে কী ভূমিকা রেখেছে। মুজাফ্ফরাবাদে গুরুতর আহত ২০ জন যখন ছোট্ট স্বাস্থ্যকেন্দ্র অল হিন্দ হসপিটালে কাতরাচ্ছিলেন, তখন চিকিৎসকেরা বলছিলেন, তাঁদের দ্রুত সরকারি গুরু তেজ বাহাদুর হসপিটালে পাঠানো দরকার। তেজ বাহাদুর হসপিটালের ডাক্তাররা বিকেল চারটা পর্যন্ত পুলিশের সহযোগিতা চাচ্ছিলেন, যাতে অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে পুলিশ প্রহরায় আহতদের হাসপাতালে আনা যায়। কিন্তু পুলিশ তাদের কোনো সহযোগিতা দেয়নি। পরে চিকিৎসকেরা উপায় না পেয়ে এক আইনজীবীর মাধ্যমে হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন। সেখান থেকে আদেশ দেওয়ার পর পুলিশ ওই রোগীদের তেজ বাহাদুর হাসপাতালে নেয়।

একটি প্রশ্ন বারবারই উঠছে। সেটি হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যখন নরেন্দ্র মোদি উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতে ব্যস্ত, ঠিক এমন সময় কেন বিজেপি দিল্লিতে এমন সহিংসতা হতে দিল? কেউ কি তার নিজের সমাবেশে নিজেই জলকামান মারে? কিন্তু এই জবাব খুব সোজা। সেই বিচ্ছু ও ব্যাঙের গল্পটি আপনাদের মনে আছে? একটি ব্যাঙ একটা বিচ্ছুকে পিঠের ওপর নিয়ে সাঁতরে খাল পার করে দিচ্ছিল। মাঝপথে যখন দুজনই ডুবল, তখন ব্যাঙ চিৎকার করে উঠল, ‘তুমি আমাকে কামড়াচ্ছ কেন? আমরা তো দুজনই মারা যাচ্ছি।’ তখন বিচ্ছু বলল, ‘আমি কী করব রে ভাই! এটা তো আমার স্বভাব!’

আসল কথা হলো, বিজেপির চরিত্রই হলো বিভক্তি ও মেরুকরণ করা। তাদের এই সাম্প্রদায়িক বিষ যদি গোটা ভারতকে শেষও করে দেয়, তাহলেও সে বিচ্ছুর মতো কামড় বসাবেই। মোদি এবং অমিত শাহর কাছে ট্রাম্পের সফর খুবই সাময়িক ঘটনা, কিন্তু ভোটব্যাংক গড়ে তোলা এবং ইলেকশনিয়ারিংএকটি সীমাহীন প্রক্রিয়া। এ কারণে ট্রাম্পের সফরের বিষয়টি তারা বেশি গুরুত্ব দেয়নি।

সাম্প্রতিক দিল্লি নির্বাচনের প্রচারে বিজেপি সরাসরি মুসলিমবিদ্বেষী ভাষণ দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা মুসলমানদের সরাসরি বিশ্বাসঘাতক বলেছে। তাদের গুলি করে মারা উচিত বলেও অনেক বিজেপি নেতা মন্তব্য করেছেন। মুসলমানরা আম আদমি পার্টিকে একচেটিয়া ভোট দেওয়ায় আম আদমির কাছে বিজেপি হেরে যায়। বিজেপি এখন অঙ্ক করে দেখেছে, দিল্লিতে মুসলমানদের ওপর হামলা চালালে আম আদমি পার্টি মুসলমানদের পক্ষে খুব একটা এগিয়ে আসতে পারবে না। সব মিলিয়ে এই হামলাকে হিন্দুত্ববাদ জোরালো করার পন্থা বলে মনে করেছে বিজেপি। মোদি ও অমিত শাহ মনে করছেন, এই উন্মাদনা ভারতকে দুর্বল করলেও বিজেপিকে শক্তিশালী করবে।

সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট দ্য ওয়ার থেকে নেওয়া। অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
সিদ্ধার্থ ভরদ্বারাজন: দ্য ওয়ারেরপ্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও দ্য হিন্দুর সাবেক সম্পাদক