মফস্বলের বইমেলা আরও বাড়ুক

বইমেলা মফস্বলেও জন্ম দিচ্ছে নতুন লেখক-পাঠকশ্রেণির। ফাইল ছবি
বইমেলা মফস্বলেও জন্ম দিচ্ছে নতুন লেখক-পাঠকশ্রেণির। ফাইল ছবি

ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে বইমেলাময় মাস। গণ–উদ্যোগে ও সরকারিভাবে দেশজুড়ে বইমেলা চলে। কোথাও তা মার্চ পর্যন্ত ছড়ায়। সেই চিলমারীর পণ্ডিত বইমেলা থেকে টাঙ্গাইলের অর্জুনা পাঠাগার বইমেলা চলছে। মানুষ বই কিনছে। নানাজন নানা কারণে বইকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। মফস্বলের কুরিয়ার সার্ভিসের অফিসগুলোতে গেলেই টের পাওয়া যায়, মানুষ বই কিনছে। আগের চেয়ে বেশিই কিনছে। আগে স্থানীয় দোকানগুলোতে প্রয়োজনীয় বই পাওয়া যেত না। এখন বিকাশে টাকা পাঠালেই বই চলে আসে। বইমেলা আর ফেসবুক মিলে মফস্বলেও জন্ম দিচ্ছে নতুন লেখকের নতুন পাঠকশ্রেণি। এ এক অভিনব লেখক-পাঠক শ্রেণি—স্থানীয় কেব্‌ল নেটওয়ার্ককে কাজে লাগিয়ে হিরো আলমরা যেমন, তেমনি লেখকশ্রেণিও।

কুড়িগ্রাম স্টেডিয়ামসংলগ্ন বইমেলা। একেকটি স্টলে আবদুল খালেক ফারুক, মঞ্জুরুল হক, সরদার রাজ্জাক ও বাদশা সৈকত নিজ নিজ ভক্তমণ্ডলীকে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। প্রথমার স্টলের সামনে সাংবাদিক সফি খানকে ঘিরে আছে একদল তরুণ। ভেতরে উঁকি দিয়ে জানলাম, তিনি গতকাল তিন তরুণকে ১ হাজার টাকা করে বই উপহার দিয়েছেন। আজ বাকিরা উপহারের জন্য ঘিরে ধরেছেন। একই ঘটনা সর্বত্র। বড়রা ছোটদের বই উপহার দেন। এটাই মফস্বলের চিরপরিচিত দৃশ্য—শ্রদ্ধা-স্নেহ, আত্মীয়তার। উপহার হিসেবে বইয়ের তুলনা নেই। সঙ্গে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো মেলাকে আনন্দমুখর করে তুলেছে।

গ্রামসমাজে মেলা মাত্রই স্বতন্ত্র। পীর-ফকির, আউল-বাউল, ভাসান, স্নান, বোলান, কথকতা নিয়ে মেলা বসে। পয়লা বৈশাখে প্রচুর মেলা বসে। বঙ্গভঙ্গের ফল হিসেবে পেয়েছি স্বদেশি মেলা। তেমনি ভাষা আন্দোলনের ফল একুশে বইমেলা। স্থানিক দূরত্ব ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতা মেলাগুলোকে স্বতন্ত্র রূপ দিয়েছে। একেকটি মেলা একেক কারণে বিখ্যাত। কৃষ্ণনগরের বারদোল মেলা মৃৎশিল্পের জন্য, চিলমারীর অষ্টমীর মেলা দই ও মাছের জন্য। কিন্তু দেশজুড়ে অনুষ্ঠিত বইমেলা নিজস্ব চেহারা এখনো অর্জন করতে পারেনি। যেন ঢাকার ছায়ায় ঢাকা। ঢাকার বিভিন্ন প্রকাশনীর বই স্থানীয় সংগঠকেরা কিনে এনে বিক্রি করেন মাত্র। রংপুর, সিলেট ও রাজশাহীর মতো বড় শহরে স্থানীয় লেখকদের ভরসায় কিছু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কোনোটি রংপুরের ‘ডাকঘর’–এর মতো অনুবাদ ও ক্ল্যাসিক বই প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু নিজ অঞ্চলের ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতিনির্ভর প্রকাশনা এখনো খুব কম।। রাজবংশী, গারো, সাঁওতাল, ওঁরাওসহ অন্যান্য জাতির ভাষাভিত্তিক প্রকাশনা নেই। বইমেলাগুলো স্থায়ী রূপ পেলে ধীরে ধীরে তা বিকশিত হবে। সব হবে।

নব্বইয়ের দশকেও মফস্বলগুলোতে ছোটকাগজের গ্রুপ ছিল। বগুড়ার পড়ুয়া, রংপুরের পাঠকের মতো বইয়ের দোকানগুলোতে আড্ডাগুলো বসত। নিসর্গ, ক্যাথারসিস, ছাপাখানা, একবিংশ, লিরিক–এর মতো ছোট কাগজগুলো মর্যাদা নিয়ে ছিল। পত্রিকার নামেই বই বেরোত। আজ আড্ডাগুলোও গেছে। সম্পাদকেরাও বদলে গেছেন। নতুন সময়কে বুঝতে পারেননি বলে হারিয়ে গেছেন। পত্রিকাগুলোর সংখ্যা বেরোয়, কিন্তু সাড়া জাগায় না।

সুদূর চিলমারীতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে পণ্ডিত বইমেলা। গত বছর উদ্বোধক ছিলেন সাহিত্যিক ও কবি আনিসুল হক। এবার কথাসাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবের। আমেরিকাপ্রবাসী আবু রায়হানসহ স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় মেলাটি হচ্ছে। টাঙ্গাইলের অর্জুনা পাঠাগার বইমেলা, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বইমেলা একেবারে কম খরচে উৎসবে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় ২০-৩০টি হাইস্কুল-মাদ্রাসা ও কলেজ আছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ও আছে দুই–তিন শ। প্রতিটি স্কুল যদি ফেব্রুয়ারি মাসে স্কুলের উন্নয়নের অংশ হিসেবে ৫ হাজার টাকার বই কেনে, তাহলে প্রতিটি উপজেলায় অর্ধ কোটি টাকার বই লাগবে শুধু প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যই। তা ছাড়া, ব্যক্তিপর্যায়ে বই কেনা তো আছেই। অথচ কোনো উপজেলার একটি প্রতিষ্ঠানেও বইয়ের র‍্যাক নেই। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়ও বই উপহারের নির্দেশনা পালিত হয় না। শিক্ষা অফিসারদের রুমগুলোতেও বইয়ের তাক নেই। প্রতিটি অফিস কক্ষে বইয়ের র‍্যাক থাকা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।

মফস্বলের বইমেলাগুলো হয় মূলত বেসরকারি উদ্যাগে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এর প্রসার ঘটতে পারে। আশা করি, সরকার ভেবে দেখবে।

নাহিদ হাসান: রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সভাপতি
[email protected]