বিষবৃক্ষের ফল পাপিয়া

দলে ন্যূনতম শৃঙ্খলা থাকলে পাপিয়াদের এমন হয়ে ওঠার কথা না
দলে ন্যূনতম শৃঙ্খলা থাকলে পাপিয়াদের এমন হয়ে ওঠার কথা না

ইয়াবা ও পাপিয়ারা (ব্যক্তির মন্দকর্মের বিবেচনায়) সংখ্যায় কী পরিমাণ বেড়েছে? ২০১১ থেকে ২০১৮ সময়ে ইয়াবার ‘উপস্থিতি’ বেড়েছে ৩০ ভাগ। এটা অনুমান করা সম্ভব হয়েছে ইয়াবা ‘উদ্ধার’ দিয়ে। কিন্তু পাপিয়া ‘উদ্ধার’ কাণ্ড নেই বললেই চলে। এক-আধজন সম্রাট উদ্ধার দিয়েও সম্রাটদের সংখ্যা আন্দাজ করা যাবে না। তারা সংখ্যায় বাড়ছে। 

ধরা যাক, এ ধরনের মানুষের সংখ্যা কত, সেটা চিহ্নিত করতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ আন্তরিক হলো। তাহলেও তারা কি পারবে? এবং কী সেই পথ, যার মাধ্যমে কার্যকরভাবে তাদের চিহ্নিত করা যাবে? বন্ধ করা যাবে সম্রাট-পাপিয়াদের দৌরাত্ম্য? 

অনেকে মনে করেন, মেগা উন্নয়ন ও ধনী রাষ্ট্রের পথে উত্থানপর্বে কিছু দুর্নীতি, কিছু ক্যাসিনো, আর কিছু পাপিয়ার অনভিপ্রেত উপস্থিতি মানতে হবে। এই মত আসলে যথাযথ নয়। বিষয়টিকে এই অর্থে বিবেচনায় নেওয়া যায় যে অপরাধ সব সমাজে সব সময় থাকবে। কিন্তু এসব যারা করে বেড়াবে, তারা নেতার আসনে থাকবে না। লুকিয়ে কেউ করতে পারে, ফাঁস হলে তার দ্রুত বিচার হবে। এখন দ্রুত রিমান্ড চলে, দ্রুত বিচার
চলে না। 

শেখ আবদুল হাই বাচ্চু, সম্রাট, পাপিয়া বা দুই ভাইয়ের বসতব্যাংকের জানাজানি হওয়া কাহিনিগুলো দলের করোনাভাইরাসের মতো বিপজ্জনক ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার প্রাথমিক বা মধ্যম পর্যায়ের লক্ষণ প্রকাশ করছে। পাপিয়ার কল লিস্ট স্পর্শকাতর হলে তা প্রকাশ পাবে না। যদিও বলা হচ্ছে, কেউ পার পাবে না। সবাই নজরদারিতে আছে। কিন্তু মানুষের তা বিশ্বাস করার কারণ নেই। ঐতিহ্যগতভাবে ‘রাজনীতির’ কারণে কোনো তালিকাই আমরা ঠিকঠাক করতে পারিনি। না মুক্তিযোদ্ধার তালিকা, না রাজাকারের তালিকা। পুলিশ বা প্রশাসনিক কোনো সংস্থা বা দলীয় সংগঠনগুলো, কারা বেশি দক্ষতা ও সততার সঙ্গে এসব করার সামর্থ্য রাখে, সেই প্রশ্নের উত্তর ভীষণ গোলমেলে। 

কী ধরনের গণতন্ত্র চাই বা চাই না, তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হতে পারে। নানা বিকল্প আলোচনায় আসতে পারে। কিন্তু নেতৃত্বে ভালো মানুষেরা থাকবেন—এ নিয়ে কোনো বিতর্ক বা এর কোনো বিকল্প থাকার সুযোগ নেই। সবাই একবাক্যে বলবেন, আমরা নেতৃত্বে ভালো মানুষ দেখতে চাই। এই দেখতে চাওয়া ও নিশ্চিত করা একটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। এটা কোনোক্রমেই প্রশাসনিক নয়। এখানে ঘাটতি রাখা হলে কোনো বিশেষ বাহিনী বা আদালত, সেই শূন্যতা পূরণ করতে পারে না। 

যেহেতু আওয়ামী লীগ দীর্ঘ মেয়াদে শাসন করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছে, তাই নেতৃত্বের গুণাবলি আমরা আর বিএনপির সঙ্গে তুলনা করে পেতে চাইব না। চাইলেও সেটা দিয়ে চলবে না। আওয়ামী লীগের একজন নীতিনির্ধারকের সঙ্গে কথা হয়েছে। ইদানীং তিনি কম গুরুত্ব পাচ্ছেন। জানতে চাই, বছরে আওয়ামী লীগের যেখানে যত স্তরের কমিটি আছে, তাতে ভোটাভুটির দরকার পড়ে কতটিতে। বছরে গড়ে ১০টি কিংবা ২০টি? উত্তর পাই, এতটা হবে না। 

বলি, এই অনুমান কি ঠিক যে আওয়ামী লীগ আগে যে সমঝোতার ভিত্তিতে জেলা-উপজেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি করত, সেই শক্তি তার এখন সব থেকে কম? শক্তিশালী সরকার, দুর্বল দল। পরামর্শ বা সমঝোতা করে কমিটি করার দিন প্রায় শেষ। সফল হবে না জেনে সমঝোতার খুব চেষ্টাও করা হয় না। কমিটিগুলো হুটহাট চাপিয়ে দেওয়া হয়। তাঁকে আরও বলি, শুনেছি আগে সভাপতি ও সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হতো, তাঁরাই পরে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করে নিতেন। কিন্তু সেটাও ধসে যাচ্ছে। কারণ, এখন সভাপতি ও সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ব্যতিক্রম বাদে তাঁদের ওপর আস্থা থাকে না। পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেন না। একটা অচলাবস্থা চলছে। 

এ কথায় তিনি সায় দেন। তারপর নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সাম্প্রতিক কালের ট্রেন্ড বলতে পারি। কাউন্সিলের জন্য কমবেশি সবাই তাকিয়ে থাকে। তিন বছর অন্তর কাউন্সিল হয়। তিন বছর মেয়াদে কমিটি হয়। তো বাস্তবতা মোটামুটি এ রকম যে কোথাও আহ্বায়ক কোথাও সভাপতি ও সম্পাদকের নাম ঘোষণা করে কমিটি হয়। সভাপতি ও সম্পাদকেরা কমিটি করে অনুমোদনের জন্য তা কেন্দ্রে পাঠান। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পাল্টা কমিটি যায় কেন্দ্রে। কেন্দ্র তখন তা ধরে রাখে দীর্ঘ সময়। কাউন্সিলের আগে আগে নতুন কমিটি ঘোষিত হয়। এভাবেই চলছে। 

যদি নরসিংদীর আওয়ামী লীগ ও দায়িত্বশীলদের মধ্যে ন্যূনতম গণতন্ত্রচর্চা থাকত, তাহলে পাপিয়া-সুমন হয়তো তৈরি হতো না। গণতন্ত্র বিষয়টি বড় কথা শোনাতে পারে। কিন্তু দল পরিচালনায় ন্যূনতম শৃঙ্খলা থাকলে পাপিয়াদের আজকের পাপিয়া হয়ে ওঠার কথা নয়। স্বাধীনতার পর দুই সাংসদসহ এক ডজনের বেশি রাজনৈতিক নেতা খুন হয়েছেন যে জনপদে, তার নাম নরসিংদী। এক-আধটা বাদে এসব হত্যাকাণ্ডের কোনোটিরই বিচার হয়নি। নির্বাচিত বা নেতার মুখোশের আড়ালে খুনিরা রাজনীতির মাঠ দাপায়। নরসিংদীকে নর-সংহারী করেছে কোটারি, ঢাকার চাপানো রাজনীতি। পাপিয়া-সুমন সেই খুনপিয়াসী রাজনীতির উত্তরাধিকার বহন করছে। 

কে এই মতি সুমন? ২০১১ সালে নিহত মেয়র লোকমান হোসেনের ক্যাডার হিসেবে তাঁর উত্থান। শুধু ক্যাডার বলেই আগে কোনো পদে না থাকা সুমনকে ছাত্রলীগ সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছিল। ২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি এক লেখায় (নরসিংদীর ভোট, লোকমান হত্যা ও কিছু প্রশ্ন) বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন চেয়েছিলাম। পাপিয়ার ঘটনা তার প্রয়োজনীয়তাকে আবারও সামনে নিয়ে এল। ওই কলামে লিখেছিলাম, ‘আজ ভোট। মেয়র প্রার্থী কামরুল দুই দিন আগেই ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মানিক কমিশনার হত্যা মামলায় হাজিরা দিয়েছেন বলেও জানলাম। এই হত্যা মামলা প্রত্যাহারে কার কী ভূমিকা ছিল, তা তদন্তের দাবি রাখে।’ 

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, লোকমানের ভাই কামরুল দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগের টিকিটে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগ কর্মী মানিক কমিশনার খুনের ১ নম্বর আসামি লোকমান, ২ নম্বর আসামি কামরুল ও ৩ নম্বর আসামি মতি সুমন। সুমনকে বিয়ের তিন বছর পর পাপিয়া ২০১২ সালে রহস্যজনক কারণে গুলিবিদ্ধ হন। কেন্দ্রীয় কমিটি জানতে চায়নি, তার কারণ কী ছিল। সেদিন জানতে চাইলে এদিন হয়তো দেখতে হতো না। বরং তখন ঢাকায় নির্বাসিত সুমন দম্পতি আরও শক্তি সঞ্চয় করেন। ‘স্থানীয়’ থেকে ‘কেন্দ্রীয়’ হয়ে ওঠেন। এরই ফল হিসেবে ২০১৪ সালে পাপিয়া আকস্মিকভাবে জেলা মহিলা লীগের সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হন এবং স্থানীয় সাংসদ ও মেয়রের সম্মিলিত বিরোধিতার মুখে পড়েন। হতাশ অপু উকিলরা কমিটি ঘোষণা না করেই ঢাকায় ফেরেন। সপ্তাহ দুয়েক পর গায়েবি কমিটি ঘোষিত হয়। সেই থেকে, ছয় বছর ধরে পাপিয়া কার্যত দলীয় সংবিধানের চেতনাবিরোধী একটি অবৈধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। অবৈধ সাধারণ সম্পাদক তাঁর অবৈধ ক্ষমতা ও মর্যাদা ব্যবহার করে সংশ্লিষ্টদের আশীর্বাদধন্য থেকেই ওয়েস্টিনের মতো পাঁচ তারকা হোটেলকে বাড়িঘর বানিয়ে ফেলেছেন। কল লিস্ট খোঁজাটা তাই লোকদেখানো, দরকার গঠনতন্ত্রবিনাশী গলিত সিস্টেমকে বাতিল করা। 

নরসিংদীতে রাজনীতির পক্ষ-বিপক্ষ বদলেছে। স্থানীয় সাংসদ ও মেয়র দা-কুমড়া সম্পর্ক। জামিনে থাকা অভিযোগপত্রভুক্ত লোকমান খুনের মূল আসামিরা, যাঁরা একদা একজন ক্যাডার লোকমানের সঙ্গী ছিলেন, তঁারা আওয়ামী লীগেরই একাংশের ছত্রচ্ছায়ায় ঘুরে বেড়ান। অথচ লোকমান হত্যার পর খুনিদের দ্রুত বিচারের মাতম উঠেছিল। বিচার না দিয়ে সংসদের আসন দেওয়া হয়েছে। তাই লোকমানপত্নী বুবলী সংসদে এলেন। পরীক্ষা কেলেঙ্কারির পরও সংসদে তাঁকে টিকিয়ে রাখতে হয়। ভাই-ভাবি তুষ্ট। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ও তাঁর গঠনতন্ত্রের শুদ্ধতা কোথায় রইল? সাম্প্রতিক সময়ে স্থানীয় সাংসদের বা দলীয় সভা-সমাবেশে সুমন-পাপিয়ার বর্ণাঢ্য উপস্থিতির আলোকচিত্রগুলো অনেক কথাই বলছে। 

ক্ষমতাসীন দলের হাইকমান্ড তা পাঠ করতে চাইছে কি না, সেটাই এখন সবচেয়ে দামি প্রশ্ন। 

মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]