একটি গণবিজ্ঞপ্তি ও দেয়ালসুরত

রাজধানীর বিভিন্ন ফ্লাইওভারের পিলারে নানা ধরনের পোস্টার ও বিজ্ঞাপনে ঢেকে থাকে। ছবি: দীপু মালাকার
রাজধানীর বিভিন্ন ফ্লাইওভারের পিলারে নানা ধরনের পোস্টার ও বিজ্ঞাপনে ঢেকে থাকে। ছবি: দীপু মালাকার

দৃষ্টিতে যা ধরা পড়ে সেটাই দৃশ্য। যে দৃশ্যে চোখ আরাম পায়, তা ‘দর্শনীয়’। যা চোখের আরাম নষ্ট করে, মনের শান্তি ধ্বংস করে এবং তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় শরীর অসুস্থ হয়, সেই দৃশ্য দৃষ্টিকটু। অস্বস্তিকর। অস্বাস্থ্যকর।

কপাল খারাপ, এই দেশে দৃশ্যদূষণ নিয়ে কথা বললে যে কেউ বলে বসে, ‘ধুর মিয়া!, পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, খাদ্যে ভেজাল-এই সবের ঠেলায় জান বাঁচে না। আপনি আসছেন দৃশ্যদূষণ নিয়ে!’

কোটি কোটি টাকা খরচা করে বানানো উড়ালসেতুর নয়নাভিরাম পিলারগুলো দিন দশেকের মধ্যে শত শত পোস্টার, শত শত চিকা, অসংখ্য ব্যানার, অগণিত সিল-ছাপ্পড়ে আমরা ভরিয়ে দিতে পারি। সেই পোস্টারে ‘অবাধ্য স্বামী/স্ত্রী বাধ্য করার’ কায়দা বাতানো বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে ‘ব্যথামুক্ত’ খতনা করতে সক্ষম হাজামের নামসহ মোবাইল নম্বর থাকে। আয়ুর্বেদিক ও ইউনানি দাওয়াখানার বিজ্ঞাপনও থাকে। রাস্তার পাশে দেয়ালে ভুল বানানে যে জায়গাটায় ‘এখানে প্রস্রাব করিবেন না’ লেখা থাকে, সেই লেখার ওপরেই সাধারণত লোকজনকে অবলীলায় মূত্রপাত করতে দেখা যায়। হাঁটতে হাঁটতে মাটির দিকে তাকালে দেখা যায়, ‘আমের খোসা ও আঁটি, কাঁঠালের ভূঁতি, মাছের কানকা, মরা বিড়ালের ছানা-ছাইপাঁশ আরও কত-কী যে!’ ওপরে তাকালে দেখা যায়, হাজার পদের তার প্যাঁচানো। টাঙানো দড়িতে ঝোলা নানা কিসিমের পোস্টার। এগুলো নিয়ে এত দিন ঢাকা মহানগর কর্তৃপক্ষের মাথা ব্যথা ছিল না। যানজট, আবর্জনা, মশা, ধূলা, জলাবদ্ধতা, দ্রব্যমূল্য, করোনা ভাইরাসসহ কতকিছু নিয়ে ভীত ও পেরেশান ঢাকাবাসী। রাস্তাঘাটে চলাচল করা আদমসুরতের দিকে তাকালে সেই ভয়, ক্লান্তি আর বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট।

তবে মহা আনন্দের কথা, ঢাকা সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। তারা আচমকা দেয়াল-সুরত নিয়ে সচেতন হয়ে উঠেছে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) শহরের সৌন্দর্য বাড়াতে সড়কের পাশের বাড়ি বা স্থাপনা, ফটক ও দেয়াল সংস্কার ও রং করার বিষয়ে উৎসাহী হয়ে উঠেছে। তারা জাতীয় দৈনিকে একটি গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে এবং বাড়ির মালিকদের নোটিশ দিয়ে বলেছে, ১৪ মার্চের মধ্যে বাড়ি বা স্থাপনার ফটক ও সীমানা দেয়াল সংস্কার ও রং করতে হবে। বিজ্ঞপ্তিতে এটিকে বাড়ির মালিকদের প্রতি ‘অনুরোধ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই অনুরোধের পাশাপাশি ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ মো. ইমদাদুল হক বলেছেন, ‘যারা বাড়িঘর রং করাবেন না, তারা জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী পালন করতে চান না বলে মনে করব।’ (প্রথম আলো, ৪ মার্চ ২০২০)।

কিছু কম বুঝদার লোক বলছে, যে মানুষটির জন্য বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়ে বিশ্বমানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে তাঁর জন্মশতবর্ষে নাগরিকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেবেন এবং সেই উদ্‌যাপনকে বর্ণাঢ্য করতে নিজের আবাসস্থলকে পরিচ্ছন্ন রাখবেন এর চেয়ে সুন্দর কথা আর কী হতে পারে? কিন্তু সিটি করপোরেশনের যে কর্মকর্তারা দিনের পর দিন দৃশ্যদুষণ উপহার দিয়ে যাচ্ছেন, সেই কর্মকর্তাদের এই ধরনের হুমকি ধামকি মেনে নেওয়া কঠিন। বিজ্ঞপ্তিতে রং করার ‘অনুরোধ’ করা হয়েছে। তবে ইমদাদুল হক সাহেব হয়তো মনে করেছেন, বাঙালিকে অনুরোধ করে কাজ হবে না, তাকে ভয় দেখাতে হবে। সম্ভবত সে কারণে তিনি বলেছেন, যাঁরা বাড়িঘর রং করাবেন না, তাঁরা জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী পালন করতে চান না বলে তিনি (বা তাঁর প্রতিষ্ঠান) মনে করবেন। তাঁর এই কথার মধ্য দিয়ে নাগরিকদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে এক ধরনের শাঁসানির সুর ঢেলে দেওয়া হয়েছে।

সিটি করপোরেশন যদি প্রত্যেক বাড়িওয়ালাকে রং করার খরচ পাঠিয়ে দিত তাহলেও হয়তো বাড়িওয়ালারা ‘বুঝ’ পেতেন। এখন ‘অপরিচ্ছন্ন’ বাড়িওয়ালারা মহা ফ্যাকড়ায় পড়েছেন। তাঁরা ভাবছেন, আমাকে আমার নিজের পয়সায় ১৪ মার্চের মধ্যে বাড়ি সংস্কার বা রং করতে হবে এবং তা না করতে পারলে আমি জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী পালন করতে চাই না বলে ধরে নেওয়া হবে—এ কোন বিপদ! ১৪ তারিখের মধ্যে দেয়াল রং না করা লোকদের জন্মশতবর্ষ উদযাপনবিরোধী হিসেবে ধরে নেওয়ার পর তাঁদের অবস্থা কী হবে তা অবশ্য ইমদাদুল হক সাহেব বলেননি। তবে তাঁর কথা আন্দাজ করা যায়, ওই ব্যক্তিদের গায়ে অন্তত ‘সরকারবিরোধী’ তকমা লাগিয়ে দেওয়া হতে পারে।

সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা ঢাকা শহরের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য বছরের পর বছর কী মারাত্মক কষ্ট করেন তা এই সব বাড়িওয়ালা ভালো করে জানেন। পোস্টার অপসারণ, জলাবদ্ধতা দূর করা, ডেঙ্গু ঠেকাতে মশা মেরে সাফ করা—এই রকমের হাজার কাজ কর্মকর্তাদের করতে হয়। মশা মারার নামে দুই নম্বর ওষুধ ছিটিয়ে কোটি কোটি টাকা নয়ছয় করার কথা কাগজে আসলে সেগুলো সম্ভবত সত্যি খবর না। সত্যি হলে বহু কর্মকর্তাকে জেল-হাজতে থাকতে হতো।

ভারতে গত মাসে এসেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আহমেদাবাদে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। সেখানে তাঁর যাওয়ার পথে একটি বস্তি পড়েছিল। ট্রাম্পের নজরে যাতে বস্তিটি না পড়ে সে জন্য বস্তির পাশ ঘেঁষে সাত ফুট উঁচু দেয়াল তোলা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর প্রাণপ্রিয় গরিব চাষাভুষা ও তাদের সন্তানেরা কায়োমনে প্রার্থনা করে এই ধরনের মেকি শান-শওকত প্রদর্শনের প্রবণতা থেকে বাংলাদেশ রক্ষা পাক। ঢাকা সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা এই প্রার্থনার ভাষা বুঝবেন?

সারফুদ্দিন আহমেদ: লেখক ও সাংবাদিক।