তিনজন সচিব ও একজন সাংসদ

কাজী মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন, শেগুফতা বখত চৌধুরী, চৌধুরী এ কে এম আমিনুল হক, মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান
কাজী মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন, শেগুফতা বখত চৌধুরী, চৌধুরী এ কে এম আমিনুল হক, মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে আমার তিনজন কিংবদন্তিতুল্য চেয়ারম্যান (সচিব) ও একজন ব্যতিক্রমী সাংসদের সান্নিধ্যলাভের সুযোগ হয়। তাঁদের নিয়েই আজকের লেখা।

কাজী মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন

১৯৭৯ সালে আমি সরকারি চাকরিতে যোগদান করি, তখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন কাজী মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন সিএসপি। তিনি আমার নানা হতেন এবং ঢাকার ইস্কাটনে টেনামেন্ট হাউসে থাকতেন। আমাদের সময় দুবার চাকরির অগ্রাধিকার চাওয়া হয়। তাঁর পরামর্শেই আমি ও বন্ধু জাহিদ (বর্তমানে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে অবসরপ্রাপ্ত) দ্বিতীয়বার অগ্রাধিকার পরিবর্তন করে সহকারী কমিশনারের পরিবর্তে শুল্ক ও আবগারি বিভাগে যোগ দিই।

শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে আমাদের কাজ ছিল পুরোনো নথি দেখা। একটা নথি দেখতে গিয়ে গোলাম রহমান নামের তেজগাঁও বিমানবন্দরের একজন সহকারী কালেক্টরের বিরুদ্ধে অভিযোগে খোদ চেয়ারম্যানকে জড়ানো হয়েছে। অভিযোগ করা হয়, অভিযুক্ত সহকারী কালেক্টর চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ। এবং অভিযুক্ত সহকারী কালেক্টর চেয়ারম্যানকে সিন্ধি গাই উপহার দিয়েছেন। যত দূর মনে পড়ে, অভিযোগপত্রের ওপর চেয়ারম্যান ইংরেজিতে নির্দেশ দিয়েছেন। অভিযোগটিতে আমাকে জড়ানো হয়েছে। অভিযোগের একটি অনুলিপি মন্ত্রিপরিষদ সচিব বরাবর প্রেরণ করা হয় আমার বিষয়ে তদন্ত করার জন্য। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সর্বাপেক্ষা জ্যেষ্ঠ সদস্য সহকারী কমিশনারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করবেন এবং প্রয়োজনবোধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আমি পুরো প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন থাকব। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব সংস্থাপনসচিব বরাবর উপস্থাপন করতে হবে।

একদিন বাসায় পেয়ে তাঁকে নথির বিষয়টি নিয়ে জিজ্ঞাসা করি। সিন্ধি গাইয়ের প্রসঙ্গ টেনে তিনি নানিকে ডেকে বলেন, ‘তোমার নাতি আখতারকে (আমার ডাকনাম) আমাদের সিন্ধি গাই দেখিয়ে দাও।’ নানি বিরক্ত হয়ে বসার ঘরে ঢুকে বলেন, কী আবোল–তাবোল বলছ? কিসের সিন্ধি গাই? কোথাকার সিন্ধি গাই? নানা হাসতে হাসতে নানিকে অভিযোগের বর্ণনা দিয়ে আমাকে বললেন, অভিযোগের একটা কথা ঠিক। আমি অবাক হই। তিনি বলেন, মাস ছয়েক আগে তাঁর ছোট ছেলে হারিয়ে যায়। তোমার নানি পুত্র হারানোর শোকে শয্যাশায়ী হয়ে যান। দিন পনেরো পরে সহকারী কালেক্টর গোলাম রহমান মিরসরাই থেকে তাকে খুঁজে পান। সে থেকেই গোলাম রহমানের প্রতি তাঁর একটা দুর্বলতা আছে।

চট্টগ্রাম শুল্ক ভবনে পদস্থ হওয়ায় তাঁর সঙ্গে কাজ করার আর সুযোগ হয়নি। তবে পরবর্তী সময়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে কাজ করতে গিয়ে দেখি, একটি নথিতে ইংরেজিতে তিনি লিখেছেন, ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতির তার ওপরের আদেশ অনুগ্রহ করে দেখতে পারেন। আদেশটির বাস্তবায়ন একটি খারাপ নজির ও রাজস্ব আহরণে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও আইনি জটিলতা সৃষ্টি করবে। তাই মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাঁর আদেশ নিম্নরূপ সংশোধন করতে পারেন...।’ মহামান্য রাষ্ট্রপতি চেয়ারম্যানের প্রস্তাব অনুমোদন করে স্বাক্ষর করেন!

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে থাকাকালেই দুর্ভাগ্যবশত তিনি হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন ও কিছুদিন পরেই বিদেশ সফরকালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর সন্দ্বীপ অ্যাসোসিয়েশন শোকসভা করবে কি না, এ নিয়ে এক বিতর্ক হয়। আমি এ ধরনের একটি আলোচনায় উপস্থিত ছিলাম। একজন বললেন, সন্দ্বীপের এত বড় একজন সিএসপি অফিসার, তাঁর জন্য শোকসভা করা দরকার। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন প্রতিবাদ করে উঠলেন। বড় অফিসার মানলাম। কিন্তু উনি সন্দ্বীপের জন্য কী করেছেন?

একজন যোগ করলেন মোশাররফ মিয়া একজন বেইমান। এবার তিনি বেইমানির ফিরিস্তি দিলেন। সেবার তাঁরা সন্দ্বীপের বন্যানিরোধক বেড়িবাঁধের ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছিলেন। তখন চেয়ারম্যান তাঁদের বলেন, সে বছরের সব বাঁধের বরাদ্দ চূড়ান্ত হয়ে গেছে। তবে ওপরের থেকে কেউ বললে তিনি সাহায্য করতে পারবেন। তখন তাঁরা চেয়ারম্যানকে বলেন, মোশাররফ সাহেব বললে কি কিছু হবে? চেয়ারম্যান তাঁদের বললেন, ওনাকে আমরা সবাই মানি। উনি বললে তো আমাকে একটা কিছু করতেই হবে।

সবাই মিলে তাঁরা মোশাররফ সাহেবের অফিসে যান। তাঁদের প্রয়োজন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানের পরামর্শ বলেন। তিনি বক্তব্য শুনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানকে ফোন করলেন। সন্দ্বীপের বেড়িবাঁধের প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন। চেয়ারম্যান তাঁকে বললেন বেড়িবাঁধের সব টাকা বরাদ্দ হয়ে গেছে। তবে তিনি বরগুনার বরাদ্দ থেকে কেটে কিছু টাকা সন্দ্বীপের বেড়িবাঁধের জন্য দিতে পারেন। কিন্তু মোশাররফ মিয়া রাজি হলেন না। টেলিফোনে চেয়ারম্যানকে বললেন, ‘সন্দ্বীপও আমার দেশ, বরগুনাও আমার দেশ। বরগুনার বরাদ্দ কেটে সন্দ্বীপের জন্য বরাদ্দ দিতে আমি আপনাকে অনুরোধ করব না।’

দেখ, কত বড় বেইমান, সন্দ্বীপে জন্মগ্রহণ করে বলে বরগুনাও আমার দেশ! একজন টিপ্পনী কাটলেন।

আমি এরপর চট্টগ্রামে চলে যাই। জানি না তাঁর জন্য শোকসভাটি হয়েছিল কি না।

শেগুফতা বখত চৌধুরী

তিনি যখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান (পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর), আমি তখন ঢাকা বিমানবন্দরে এয়ারফ্রেট ইউনিটে কর্মরত অতি কনিষ্ঠ কর্মকর্তা। একসময় আমার কালেক্টর (নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা) পরিবর্তন হয়। আগের কালেক্টরের সঙ্গে আমার কাজের সম্পর্ক ছিল চমত্কার। নতুন কালেক্টর এসে আমাকে মৌখিক নানাবিধ নির্দেশ দিতে থাকেন, যা আইনগতভাবে বৈধ ছিল না। আমি সে নির্দেশগুলো লিখিত আকারে দেওয়ার অনুরোধ পালনে অপারগতা জ্ঞাপন করি এবং উপায়ান্তর না দেখে অগ্রাহ্য করি। আমার কিছু সিদ্ধান্তে তাঁর কিছু ব্যবসায়ী বন্ধুর স্বার্থহানি ঘটে। তাই নতুন কালেক্টর আমার প্রতি নাখোশ হন। তিনি আমাকে শাসাতে থাকেন। আমি তাতে গা না লাগিয়ে আইন, বিধি ও আমার বিবেক ও বিবেচনা অনুযায়ী কাজ করতে থাকি। অতঃপর নতুন কালেক্টর আমাকে তাঁরই অধীনে নারায়ণগঞ্জে বদলি করে দেন। আমি কিছুটা হতাশ হলেও দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে নতুন কর্মস্থলে যোগ দিই।

কিছুদিন পর আমি তিনটি সামরিক (তখন সামরিক শাসন ছিল) ও বেসামরিক তদন্তকারী সংস্থা থেকে হাজিরা ও আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের জবাব দেওয়ার নোটিশ পাই। অভিযোগগুলোর মধ্যে ছিল আমি দুর্নীতিপরায়ণ, অদক্ষ ও অবাধ্য। আমার বিরুদ্ধে আনীত মূল দুর্নীতির অভিযোগটি আমার সরকারি চাকরিতে যোগদানের আগেই সংঘটিত ও নিষ্পন্ন হয়েছিল! অভিযোগকারী কর্মকর্তা কালেক্টর বাহাদুর স্বয়ং। আমি যথারীতি জবাব দিই ও শুনানিতে হাজির হই। তদন্তকারী কর্মকর্তারা আমার জবাব পড়ে ও শুনানি শেষে আমার কাছে জানতে চান, আমার বিরুদ্ধে কালেক্টরের অভিযোগের আসল কারণ কী। আমি বলি, স্যার, আপনারা তাঁকে জিজ্ঞেস করুন।

যাহোক, ইতিমধ্যে আমি বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য নির্বাচিত হই। শৃঙ্খলা কার্যক্রম চলমান থাকায় এত দিন তা প্রক্রিয়া করা হচ্ছিল না। একদিন শুনলাম আমার উচ্চশিক্ষার নথিটি চেয়ারম্যানের কক্ষে আছে। ক্লাস শুরু হতে আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। তাই আমি তৎকালীন চেয়ারম্যান শেগুফতা বখত চৌধুরীর সাক্ষাৎকার প্রার্থনা করি। পিএস জানান, তিনি আমার সঙ্গে দেখা করবেন না। ভগ্ন মনোরথ হয়ে বাসায় চলে যাই। মনে মনে বলি, উচ্চশিক্ষা বা বিদেশযাত্রা আমার কপালে নেই! বাসায় ফিরে আমার পিএস রিজওয়ানের ফোন পাই। স্যার, আপনার নথিটা চেয়ারম্যান সাহেবের রুম থেকে বের হয়েছে। তবে সিলগালা করা। মন্ত্রী সাইদুজ্জামান সাহেবের কাছে যাচ্ছে। আমি এবার মনে করলাম চাকরি বুঝি গেল!

আমার পিএস রিজওয়ান নথিটি অনুসরণ করতে থাকেন। একসময় জানালেন নথিটি আবার সিলগালা হয়ে এনবিআরে ফিরে যাচ্ছে। যাহোক, আমার বিদেশে উচ্চশিক্ষার নথিটি অনুমোদন লাভ করে।

বহুদিন পর অন্য আর একটি বিষয়ের তদন্ত প্রসঙ্গে নথিটি আমার দেখার সুযোগ হয়। দেখলাম, শেগুফতা বখত চৌধুরী নিজের সুন্দর হস্তাক্ষরে ফুল স্কেপ কাগজে আড়াই পাতা নোট লিখেছেন। আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ, তদন্ত বিবরণ, এর অসারতা বিষয়ে লিখেছেন ও আমার অন্যায় বদলির জন্য কালেক্টরকে ভর্ৎসনা করেছেন। অভিযোগ প্রত্যাহার করে আমাকে বিদেশে উচ্চশিক্ষার অনুমতি দিয়েছেন।

ভাবলাম, বিদেশ যাওয়ার আগে ধন্যবাদ দিয়ে যাই। আবার সাক্ষাৎপ্রার্থী হলাম। এবারও পিএস জানালেন, স্যার বলেছেন দেখা করার প্রয়োজন নেই।

আমাদের সঙ্গে সভায় তাঁর দাপ্তরিক আলোচনা শুনেছি। তিনি সবার কথা শুনেছেন। ব্যাখ্যা চেয়েছেন। কিন্তু তিনি কী সিদ্ধান্ত দেবেন, কেবল তিনিই তা জানতেন!

এমন নির্লিপ্ত অথচ বস্তুনিষ্ঠ এবং প্রশংসাবিমুখ কর্মকর্তা চাকরিজীবনে আর কখনো পাইনি!

চৌধুরী এ কে এম আমিনুল হক

ওপরে যে দুজন চেয়ারম্যানের কথা লিখলাম, তাঁদের সঙ্গে আমি প্রত্যক্ষভাবে কাজ করিনি। এখন যাঁর কথা বলব, তাঁর সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। আমি বিদেশে উচ্চশিক্ষা শেষ করে এসেই চৌধুরী এ কে এম আমিনুল হককে চেয়ারম্যান (পরবর্তী সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা) হিসেবে পাই। তাঁর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে অফিসেও পিতৃস্নেহ অনুভব করতাম।

এনবিআরে তখন আমাকে অনেক সারসংক্ষেপের খসড়া লিখতে হতো অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর জন্য। হ্যাঁ, এনবিআরে সিদ্ধান্তের জন্য অর্থমন্ত্রীর জন্যও সারসংক্ষেপ পাঠাতে হয়। স্যার খুব কাটাকাটি ও পরিমার্জনা করতেন। প্রথম দিকে মাঝেমধ্যে এমন হতো যে আমি নিজে কী লিখেছি, তা খুঁজেই পেতাম না। পরিমার্জনাকালে তাঁর পিএ ও স্টেনোগ্রাফার নুরুল আমিনকে ডিকটেশন দিতেন। নুরুল আমিনকে পুরোটা নতুন করে টাইপ করিয়ে আবার কাটাকুটি করে চূড়ান্ত করতেন। প্রথম প্রথম বিরক্ত হতাম। পরে দেখলাম, আমার দেওয়া খসড়ার তুলনায় চূড়ান্ত সারসংক্ষেপটি অনেক স্পষ্ট ও সাবলীল। অথচ এনবিআরে এমন চেয়ারম্যানও পেয়েছি, যাঁরা পরিমার্জনা করতে গিয়ে ভুল করতেন অথবা কেবল কোথায় সই করতে হবে, তা জিজ্ঞেস করতেন!

এমনই একদিন, তাঁর কক্ষে খসড়া চূড়ান্ত হচ্ছে। এর মধ্যে লাল টেলিফোনে ফোন। ওপারের কথা শুনতে পাচ্ছি না। স্যার যা বললেন তা এ রকম। জি, আমি জানি আপনি কে বলছেন। তাঁর মুখে বিরক্তির ছাপ। আবার বললেন, আমি বিষয়টা সম্পর্কে জেনে, বুঝে, বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত দিয়েছি। এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার কোনো কারণ দেখি না। ওপাশে যিনি, তিনি ক্ষমতাবান। না শুনতে অভ্যস্ত নন। স্যার বললেন, আমার জায়গায় নতুন সচিব এলে কী সিদ্ধান্ত দেবেন, তা অনুমান করা আমার জন্য ঠিক হবে না। আমার সিদ্ধান্ত আমি দিয়েছি। আপনার যা মেহেরবানি আপনি তাই করবেন। বিনীত অথচ দৃঢ় উচ্চারণ। নির্বিকারভাবে সিগারেটে টান দিতে দিতে আবার পরিমার্জনা চলল। শেষ করে বললেন, আগামীকাল চেয়ারম্যানকে (আমাকে দিয়ে বললেন না) দিয়ে সই করিয়ে মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে পাঠাবেন।

পরদিন সকালেই সংবাদপত্রে দেখলাম তাঁকে পরিকল্পনাসচিব হিসেবে বদলি করা হয়েছে!

ক্ষমতার কী নির্মম পরিহাস, কয়েক মাস পরেই তাঁকে আবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে ফিরিয়ে আনতে সরকার বাধ্য হয়!

মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান

আমি তখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে বাজেট প্রণয়নের কাজের সঙ্গে জড়িত। সবে সংসদে বাজেট পেশ করা হয়েছে। দুই দিন পরেই ফোন, স্যার, আমার নাম খালেকুজ্জামান। আমাকে একটু সময় দেবেন? আপনারা কীভাবে বাজেট করেন, তা আমি একটু বুঝতে চাই। অদ্ভুত অনুরোধ। রাজি হই। নির্ধারিত সময় ও দিনে তিনি হাজির হন। বাজেটের কাগজপত্র সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন: এটা কেন করলেন? এটা কীভাবে করলেন? আমার দেওয়া জবাবের নোট নিলেন।

আমার কৌতূহল বাড়তে থাকে। এত সব জেনে কী করবেন? আপনার পড়াশোনা কোথায়? অনেক জেরার পর জানতে পারি, তিনি একজন সংসদ সদস্য, আইবিএর গ্র্যাজুয়েট। বন্ধু জাহিদের কাছ থেকে (বর্তমানে বিশ্বব্যাংক থেকে অবসরপ্রাপ্ত) থেকে পরে জেনেছি, তিনি ছিলেন তাঁর ব্যাচের সেরা ছাত্র। এতক্ষণ তিনি আমাকে স্যার সম্বোধন করছিলেন। এবার আমার স্যার বলার পালা। তিনি বিব্রত। বললেন, আপনি বয়সে বড়। আমি তাঁকে বলি, আমি সরকারি কর্মচারী। প্রটোকল মানতে বাধ্য।

সব সাংসদই জোর গলায় নিজের পরিচয় প্রচার করেন। জিজ্ঞেস করলাম, আপনি করেন না কেন? তিনি বললেন, আপনাকে একটা গল্প বলি। আমার নির্বাচনী এলাকার পাশে এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছি। ঘরে ঢুকতেই বন্ধু তাঁর স্ত্রীকে বললেন, এমপি সাহেব এসেছেন। বন্ধুর স্ত্রী কোন এমপি জানতে চাইলে বন্ধু আমার নাম বললেন। বন্ধুর স্ত্রী বললেন, ও, খালেক ভাই। উনি তো ভালো মানুষ, এমপি হতে যাবেন কোন দুঃখে! আমাদের দেশে এমপি পরিচয়টি নানা কারণে সম্মানজনক নয়। তাই একটু ইতস্তত করি। বললেন, হয়তো একদিন বড় গলা করে পরিচয় দিতে পারব আমি একজন এমপি।

আমাদের আলোচনা এগোতে থাকে। বাজেটের বিষয়ে সংসদে কিছু বলবেন, তাই বিষয়টা সম্পর্কে জানতে এসেছেন। প্রায় সাত বছর বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। সেই প্রথম ও সেই শেষ। আর কোনো জনপ্রতিনিধি আমার কাছে বাজেট প্রণয়ন বিষয়ে কিছু জানতে চাননি।

তখন পালা করে আমাদের সংসদে যেতে হতো। সংসদ সদস্যদের বাজেটবিষয়ক বক্তৃতার নোট নিতে হতো। সেখানে আমার সাংসদ খালেকুজ্জামানের বাজেটসম্পর্কিত বক্তব্য শোনার সৌভাগ্য হয়। সেই পুরো বাজেট সেশনে এই একটিমাত্র বক্তৃতাই আমার মনে দাগ কাটে। শ্রদ্ধায় আনত হই। এ ধরনের ব্যক্তি সাংসদ হয়েছেন জেনে দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী হই।

তার কিছুদিন পরে সংবাদপত্রে তাঁর অকালমৃত্যুর কথা জানতে পারি।

হঠাৎ করে তাঁর কথা মনে হওয়ার কারণ হলো, বন্ধু সৈয়দ মাহমুদুল হকের শেয়ার করা এক ফেসবুক পোস্ট থেকে জানতে পারলাম যে রামুর বাইপাসে অবস্থিত তাঁর নামফলক রাতের আঁধারে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবাদ ও নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। সবকিছুই এখন নষ্টদের অধিকারে চলে গেছে!

আলোচিত চার কৃতী মানুষের মধ্যে শেগুফতা বখত চৌধুরী এখন অসুস্থ। আমি তাঁর আরোগ্যলাভ কামনা করি। বাকিরা তিনজনই পরপারে। আমি তাঁদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি ও স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব