নারী স্থপতি ও প্রকৌশলীর আগামী: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

>
গোলটেবিল বৈঠক। ছবি : প্রথম আলো
গোলটেবিল বৈঠক। ছবি : প্রথম আলো
নারী দিবস সামনে রেখে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, প্রথম আলোর আয়োজনে ও সেভেন রিংস্ সিমেন্টের সহযোগিতায় ‘নারী স্থপতি ও প্রকৌশলীর আগামী: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস সামনে রেখে  আজকের আলোচনা। প্রথম আলো নারী ইস্যুতে সব সময় গুরুত্ব দেয়। সেভেন রিংস্ সিমেন্টও এ বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে। আজকের আলোচনার শিরোনাম, ‘নারী স্থপতি ও প্রকৌশলীর অাগামী: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’।

বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতি অনেক বেশি। এখন নারীরা সমাজের প্রায়    প্রতিটি ক্ষেত্রে সফলতার সঙ্গে কাজ করছেন। আজকের আলোচনা হবে মূলত নারী স্থপতি ও প্রকৌশলীর আগামী দিনের সমস্যা, প্রতিবন্ধকতা ও সম্ভাবনা নিয়ে।

রাশেদা কে চৌধূরী
রাশেদা কে চৌধূরী

রাশেদা কে চৌধূরী
বিশ্ববিদ্যালয়জীবন থেকেই আমি নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। আজকের আলোচনার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমন একটি বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করার জন্য প্রথম আলো ও সেভেন রিংস্ সিমেন্টকে ধন্যবাদ।

আমি পুরুষকে দায়ী করছি না। কিন্তু আমরা যা–ই বলি না কেন, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে আজও আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। নারীর সম্ভাবনা বিশাল। কিন্তু তাঁদের চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় নিয়ে সবাইকে কাজ করতে হবে।

ভাষার মাসে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। তাঁরা সেদিন জীবন দিয়েছিলেন বলেই আজ বাংলা ভাষায় আলোচনা করতে পারছি। আলোচনায় সরকারি প্রতিনিধি, পেশাজীবী ও একজন শিক্ষার্থী আছেন।

সবাইকে স্বাগত জানাই। বিমান চালনা, প্যারাসু্যট দিয়ে নেমে আসা, পাহাড়ে ওঠা, স্থপত্য, প্রকৌশলসহ সব ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। কিন্তু অংশীদারত্ব কি বেড়েছে? নারী কি সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন? এখানে আমাদের মূল আলোচনা। নারীর ক্ষমতায়ন ও সম–অধিকার বিষয় তো আরও পরে।

গৌতম চ্যাটার্জি
গৌতম চ্যাটার্জি

গৌতম চ্যাটার্জি
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে ২০২০ সালের থিম—‘ইচ ফর ইক্যুয়াল’ সমতার জন্য সবাই। বাংলাদেশে দ্রুত অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আরও বেশি করে নারীর অংশগ্রহণের বিকল্প নেই। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। পেশার ক্ষেত্রে যদি নারী-পুরুষের সমতা থাকে, তাহলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে। আমরা চাই সব পেশায় নারীরা যেন বেশি করে অংশগ্রহণ করেন।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বিশ্বের প্রায় ২০টি দেশ নারী দিবসকে সম্মান করে এদিন ছুটি ঘোষণা করেছে।

বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যদি আরও বেশি নারী স্থপতি ও প্রকৌশলী এগিয়ে আসেন, তাহলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাবে।

সীমিতা রায়
সীমিতা রায়

সীমিতা রায়
২০১৬ সালে গ্র্যাজুয়েশন করি। কয়েক বছর আগে আমিও শিক্ষার্থী ছিলাম। আমার বিভাগে তখন ৫০ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী ছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটা ৫০ শতাংশের বেশি। কিন্তু তারা যখন পড়ালেখা শেষ করে, তখন দেখা যায়, ৮ থেকে ১০ শতাংশ পেশাগত কাজ করছেন। অন্যরা শিক্ষকতাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চলে যাচ্ছেন।

আমার মা বলেছিলেন, আমি যদি স্থপতি হই, তাহলে ঘরে বসেও কাজ করতে পারব, আবার প্রয়োজনে বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারব।

একজন স্থপতি হিসেবে অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে কাজ করতে হয়। আমি মেয়ে বলেই আমাকে কেউ সহযোগিতা করছে না, বৈষম্য করছে, খারাপ আচরণ করছে—এমন কোনো কিছু কখনো মনে হয়নি।

পড়াশোনা শেষ করে চাকরি ও বিয়ে প্রায় একই সময়ে করেছিলাম। এ পর্যায়ে এসে কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমি ও আমার বন্ধুদের অভিজ্ঞতা হলো সংসার করে কোনো রোল মডেল হওয়া বা ক্যারিয়ারকে উজ্জ্বল করা একটা সংগ্রাম ও চ্যালেঞ্জ।

সামিয়া শারমিন
সামিয়া শারমিন

সামিয়া শারমিন
আমি স্থাপত্য বিভাগে পড়ি। কিন্তু পরিবার অনেক কিছু বুঝতে চায় না। বিভাগের বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে অনেক সময় রাতও হয়ে যায়। কখনো কখনো একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ধাপে ধাপে ড্রয়িং শিট প্রিন্ট করে বাসায় ফিরতে রাত হয়ে যায়। আবার নকশাসংক্রান্ত কাজের জন্য ছেলে–মেয়েদের অনেক ক্ষেত্রে দু–তিন দিন একসঙ্গে কাজ করতে হয়। কিন্তু পরিবারের সবাই এটা বুঝতে চায় না। অনেকে আবার এটা ভালোভাবেও নেয় না।

পড়াশোনা নিয়ে এত কষ্ট করা নিজের প্রতি সর্বোচ্চ সৎ থাকার পরও যদি সবার কথা শুনতে হয়, তখন এটা বড় ধরনের মানসিক চাপ তৈরি করে। আমার মা-বাবাসহ সবার এসব বিষয়ে আরও সচেতন হওয়া দরকার।

অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে বেশি করে আলোচনা হওয়া দরকার। এর ফলে অভিভাবকেরা বুঝতে পারবেন, স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের কেন বেশি সময় ধরে কাজ করতে হয়। এসব কারণে প্রথম বর্ষ থেকে তৃতীয় বর্ষে আসতে অনেক মেয়ে ঝরে যায়। এ বিষয়গুলো সবার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন।

শেখ নওরিন লায়লা
শেখ নওরিন লায়লা

শেখ নওরিন লায়লা
২০০৫ সালে বুয়েট থেকে পড়ালেখা শেষ করেছি। আমার বিভাগে ৩০ জন শিক্ষার্থী ছিল। তাদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ নারী। কিছু অ্যাসাইনমেন্ট  কম্পিউটারে করতে হতো। তখন সবার কম্পিউটার ছিল না। আমিও অ্যাসাইনমেন্ট করার সুযোগ তেমন একটা পেতাম না।

এখন এ সমস্যা নেই। কিছুদিন আগে দেখলাম, একজন মেয়ে একাই আমেরিকায় একটা প্রেজেন্টেশন করতে গেছে।

আমাদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক একজন চার্টার্ড ইঞ্জিনিয়ার। তিনি আমাদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য সব সময় উৎসাহিত করেন। পড়াশোনার ডিগ্রিটাই শেষ কথা নয়; নিজেকে বিভিন্নভাবে সমৃদ্ধ করার জায়গা আছে। নিজেকে একটা জায়গায় উপস্থাপন করা একটা শিল্প।

বিয়ের পর একটা নতুন জীবনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ও সন্তানের লালন-পালন একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ। এর জন্য অনেকের ক্যারিয়ারটা পেছনে পড়ে যায়।

সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাজ মানে নির্মাণ সাইটে দাঁড়িয়ে থাকা। এ জন্য অনেক মা–বাবা মেয়েদের এ পেশায় দেখতে চান না।

আমি একজন মেয়ের কথা জানি, তার বাবা বুয়েটে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তির কাগজ ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। বাবার ইচ্ছা ছিল, মেয়ে ডাক্তারি পড়বে।

গণমাধ্যমসহ সবাই যদি নারীদের এসব বিষয় আরও বেশি করে সামনে আনেন, তাহলে নিশ্চয়ই আরও পরিবর্তন আসবে।

খুরশীদ আলমেহের
খুরশীদ আলমেহের

খুরশীদ আলমেহের
আমার অভিজ্ঞতা হলো বাংলাদেশে প্রকল্প ব্যবস্থাপনার জায়গাটা অবহেলিত। প্রকৌশলীদের তিনটি ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ রয়েছে—উৎপাদন, নির্মাণ ও আইটি। আইটি খাতে শুধু সফটওয়্যার নয়, এখানে স্থপতি ও প্রকৌশলীর কাজও রয়েছে। আমি জাপানে সাত বছর চাকরি করেছি। একটি আইটি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখি প্রায় সব কর্মী অন্য দেশের, তাদের অধিকাংশই ইংরেজি জানে না।

প্রকল্প ব্যবস্থাপক সবকিছু চালিয়ে নিচ্ছে। তাই ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি একটি বিষয়। প্রকল্প ব্যবস্থাপনার অভাবে আমরা সামনের দিকে তেমন একটা এগোতে পারি না।

আমাদের অফিসে চারজন নারী আছেন। তাঁরা খুব ভালো কাজ করছেন। আমি কোনো পার্থক্য খুঁজে পাইনি। অফিসের একটা অলিখিত নিয়ম হলো, প্রতিদিনই ছুটির দিন, আবার প্রতিদিনই কাজের দিন।

আমি অফিস কলিগদের কাছ থেকে একটা নিশ্চয়তা চেয়েছি, আমাদের কোনো ক্লায়েন্ট যেন অভিযোগ না করেন, সেটা নিশ্চিত করা।

একজন প্রায় এক মাসের ছুটি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় গেছেন। সেখান থেকে কাজ করছেন। কোনো অসুবিধা নেই।

নন্দিনী আওয়াল
নন্দিনী আওয়াল

নন্দিনী আওয়াল
আমি শিক্ষার্থীদের পড়াই। কিন্তু শুধু এটাই আমার উদ্দেশ্য হতে পারে না। আমি গবেষণা করতে চাই। কিন্তু দেশে গবেষণার বিষয়টিও খুবই অবহেলিত।

এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম যদি আরও এগিয়ে আসে, তাহলে একটা পরিবর্তন আসবে বলে আশা করি। আমার জোর সুপারিশ হলো, সব ক্ষেত্রে যেন নারীদের গবেষণার সুযোগ থাকে।

আমি বুয়েটে ভর্তি হওয়ার পর পাঁচ বছর মা–বাবা, শ্বশুরবাড়িসহ প্রায় সবার সহযোগিতা পেয়েছি। কিন্তু এখন আমি সমস্যায় পড়ছি। কারণ, আমার একটি সন্তান আছে। আমি আমার সন্তানকে আলোকিত মানুষ করতে চাই। কিন্তু এখন তাকে লালন–পালন করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

সাইদা আক্তার
সাইদা আক্তার

সাইদা আক্তার
ছোটবেলায় মেয়ে হিসেবে কোনো বৈষম্য অনুভব করিনি। কোনো দিন মনে হয়নি যে আমি নারী, আমার এটা করা যাবে না। সব সময় আমি ভাবি, সবাই যা করতে পারে, আমিও তা করতে পারি।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। একদিন আমাকে একজন বলল, ‘স্থাপত্য বিভাগে ভর্তি হয়েছ। একটা আসন নষ্ট করেছ। বড় হয়ে তো সন্তানের কেকের ওপর ডিজাইন করবা।’ ওই দিনের পর থেকে আমি কোনো কেক উৎসব করি না। আমার একটা সন্তান আছে, তার বয়স দুই বছর। ওর জন্মদিনেও আমি কেক কাটিনি।

এটা চ্যালেঞ্জের শুরু। যদিও আমি চ্যালেঞ্জকে পাত্তা দিই না। সে জন্য ছোটবেলা থেকেই আমার তেমন কোনো চ্যালেঞ্জ নেই।

আমি পোশাকশিল্পের নকশা করি। মালিক অনেক টাকা বিনিয়োগ করবেন। প্রথমে তাঁর আস্থার জায়গাটা অর্জন করতে হয়। এ জন্য আমার স্বাভাবিক কর্মদক্ষতা থেকেও আরও বেশি দেখাতে হয়। আমি যখন নকশা করি, তখন একজন নারী কর্মী যেন তাঁর সন্তানকে রাখতে পারেন, সে জন্য ডে–কেয়ার সেন্টার করি। আমি জানি না একজন পুরুষ সেভাবে চিন্তা করেন কি না।

কর্মক্ষেত্রে সম্ভাবনার অভাব নেই। আমাদের প্রতিষ্ঠানে চারজন নারী স্থপতি আছেন। তাঁদের দুজনকে সাইটে পাঠাতে পারি না। কারণ, তাঁদের পারিবারিক সমস্যা আছে। অনেক সময় আমার নিজের গাড়ি দিয়ে পৌঁছে দিতে ও নিয়ে আসতে হয়। অনেক মেধাবী নারী আছেন, যাঁরা ভালো কাজ করতে চান। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ ও পরিবেশ থাকে না।

কাজী মোহাম্মদ শাহেদ
কাজী মোহাম্মদ শাহেদ

কাজী মোহাম্মদ শাহেদ
মেয়েদের চ্যালেঞ্জটা শুরু হয় পরিবার থেকে। একটা পরিবারে ছেলে যে সুযোগ পায়, মেয়ে সেটা পায় না। মেয়ে ও ছেলের মধ্যে পরিবারে অভিভাবকেরা যেন বৈষম্য না করেন, সে বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন করা দরকার। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। আমাদের দেশে অবস্থিত একটি বিদেশি  প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতাম। সেখানে মাত্র ১১ শতাংশ নারী। আমার মনে প্রশ্ন ছিল, কেন অর্ধেক নারী নন। সে প্রতিষ্ঠানে নারীর সংখ্যা অনেক বাড়াতে পেরেছিলাম।

বিভিন্ন পেশার নারীদের এনে তাঁদের সফলতার গল্প শোনার আয়োজন করেছিলাম। গণমাধ্যম, নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে উদ্যোগ নিলে ছোট প্রতিষ্ঠানেও এটা সম্ভব।

শিক্ষা কারিকুলাম এমন হওয়া দরকার, তা যেন জেন্ডার ফ্রেন্ডলি হয়। প্রকৌশল বলতে সেতু, দালান নির্মাণ মনে করি। এর বাইরেও অনেক প্রকৌশল আছে, যেখানে নারীরা কাজ করতে পারেন।

নারী প্রকৌশলীদের আরও বেশি করে সামনে আনতে হবে। ভবিষ্যতে আরও বেশি নারী প্রকৌশলী পেশায় আসবেন বলে আমার বিশ্বাস।

তাবাস্‌সুম মাহমুদ
তাবাস্‌সুম মাহমুদ

তাবাস্‌সুম মাহমুদ
সরকারি-বেসরকারি—দুই জায়গাতেই আমার কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। বেসরকারিতে বড় সমস্যা হচ্ছে একটা কঠিন টাইমফ্রেম থাকে। অনেক ক্ষেত্রে নারীরা মাতৃত্বকালীন ছুটি থেকে আসার পর চাকরিটা ফিরে পান না।

ব্যক্তিমালিক সবকিছু টাকার মাপে হিসাব করেন। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার একটা নিয়ম আছে। সেটা কাজের মানের ওপর নির্ভর করে না। এ জন্য সরকারিতে চাপ কিছুটা কম থাকে।

আমি নারী সহকর্মীকে সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যদি নারী কর্মীর সমস্যাগুলো মানবিকভাবে দেখেন বা নিজের সমস্যার মতো মনে করেন, তাহলে মেয়েদের জন্য অনেক সহজ হয়।

সরকারি ক্ষেত্রে বিধিমালা আছে, প্রতিটি অফিসে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার করতে হবে। মেয়েদের বিশ্রামের জায়গা থাকবে। পৃথক টয়লেট থকবে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে মেয়েরা তাঁদের সুযোগ-সুবিধা পুরোপুরি পান না।

আমি মনে করি, আরও অনেক বেশি নারী স্থপতি ও প্রকৌশলী প্রয়োজন। কারণ, তাঁরা নারীদের সমস্যার বিষয়গুলো চিন্তা করেই নকশা করবেন।

নাজনীন আরা কেয়া
নাজনীন আরা কেয়া

নাজনীন আরা কেয়া
১৯৯১ সালে খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। আমাদের বিভাগে ৬৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে আমরা মাত্র ছয়জন মেয়ে ছিলাম। আমি ছিলাম বিবাহিত। তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় গর্ভবতী হই। সন্তান হওয়ার পর ভাবলাম পড়াশোনা শেষ। কিন্তু আমার মা–বাবা, শ্বশুর–শাশুড়ি সবাই সহযোগিতা করেছিলেন। অনেক সংগ্রাম করে পড়াশোনা শেষ করতে হয়েছে।

১৯৯৬ সালে এলজিইডিতে যোগ দিয়ে অনেক ধরনের প্রকল্পে কাজ করেছি। ২০০১ সালে বিসিএস করে আমরা চারজন নারী রেলওয়েতে যোগ দিই। ১৮৬২ সালের পর থেকে রেলওয়ের আমরাই প্রথম নারী প্রকৌশলী।

গত বছর আমি বাংলাদেশ রেলওয়ের ইতিহাসে প্রথম চিফ ইঞ্জিনিয়ার হই। বর্তমানে রেলওয়ের ৩৯৫ জন কর্মকর্তার মধ্যে নারী কর্মকর্তা ২৭ জন।

আমার শাশুড়ি চাকরি করার জন্য উৎসাহিত করেছেন। সাইট থেকে রাতে ফিরলে পরীক্ষায় সন্তানের ফল খারাপ হলে সবাই চাকরি করাকে দোষারোপ করে। সংসারে নারী–পুরুষ সবাইকে সমানভাবে কাজ করতে হবে।

এখন নারীরা প্রকৌশল পেশায় আসছেন। রেলওয়েতে যেমন ২৭ জন নারী আছেন। অন্য ক্ষেত্রেও নারী স্থপতি ও প্রকৌশলী বাড়ছে। গত বছর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখি ১৫০ জন নারী প্রকৌশল বিভাগে পড়ছেন।

ফাহমিদা হক খান
ফাহমিদা হক খান

ফাহমিদা হক খান
২০৪১ সালে আমাদের উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন আছে। ২০২১ ও ২০৪১ সালের রূপকল্প বাস্তবায়নের যে পরিকল্পনা আছে, সেখানে নারী প্রকৌশলীরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবেন।

যত বেশি নারী প্রকৌশলী পেশায় আসবেন, তত বেশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে। দেশ উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে। একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমার উপস্থাপনা প্রথম হয়েছিল। সম্মেলনের সভাপতি অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। দেশের প্রায় অর্ধেক নারী। তাঁদের বাদ দিয়ে আমরা উন্নত দেশ হতে পারব না।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ৫-এ নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলা হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন না হলে আমরা এসডিজির কোনো লক্ষ্যই অর্জন করতে পারব না।

কারণ, এসডিজির অন্য সব লক্ষ্যের সঙ্গেই এসডিজি ৫–সম্পর্কিত। তাই প্রকৌশল পেশাসহ সব ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। ছেলেমেয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা যাবে না।

নারীদের কর্মক্ষেত্রে আবাসন ও নিরাপত্তাসংকট আছে। এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। বর্তমান সরকার নারীবান্ধব। এখানে নারীরা ইচ্ছা করলেই তাঁর জায়গা করে নিতে পারবেন।

তাহ্‌মিনা আহমেদ
তাহ্‌মিনা আহমেদ

তাহ্‌মিনা আহমেদ
সমাজ গঠনে নারী–পুরুষ দুজনেরই ভূমিকা রয়েছে। দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য নারী-পুরুষ  দুজনকেই ভূমিকা রাখতে হয়। আজ নারীরা কোনো মিথ্যা স্বপ্ন দেখছেন না। তাঁরা যে স্বপ্ন দেখেন, সেটা বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।

বিশ্বে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-সাহিত্য—সব ক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন। ইচ্ছা করলেও এখন আর কেউ তাঁদের পেছনে ফেলতে পারবে না।
আমি অন্তর্মুখী একজন মানুষ ছিলাম। আজ আপনাদের সঙ্গে যে কথা বলছি, সেটা একমাত্র আমার ও আমার পরিবারের ইচ্ছাশক্তির জন্য।

শিশুরা কিন্তু ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে পার্থক্য করে না। আমরাই তাদের মধ্যে এই পার্থক্য ঢুকিয়ে দিই। ছেলেদের সঙ্গে খেলে বলে স্কুলের সায়েন্স
ফেয়ারে আমার মেয়ের বান্ধবীরা তাকে নেয়নি। পরে সে ছেলেদের গ্রুপে অংশগ্রহণ করে প্রথম হয়েছে।

নারী দিবসের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত নারীর অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। ভবিষ্যতে তাঁরা আরও সমৃদ্ধ হবেন। একজন নারী কী করবেন, কত দূর যাবেন, সেটা তাঁর স্বপ্ন ও চেষ্টার ওপর নির্ভর করবে।

আমি মনে করি, আজকের এই গঠনমূলক আলোচনা থেকে নারীরা আরও উদ্বুদ্ধ হবেন। নারীদের জন্য সুন্দর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। দৃঢ় মানসিকতা, একাগ্রতা থাকলে যেকোনো নারী স্থাপত্য, প্রকৌশলসহ সব পেশায় সফল হতে পারেন।

শামীম জেড বসুনিয়া
শামীম জেড বসুনিয়া

শামীম জেড বসুনিয়া
মা-বাবা মনে করেন, তাঁদের সন্তান যদি চিকিৎসক, প্রকৌশলী হয়, তাহলে হয়তো ভালো চাকরি পাবেন। আবার নিজেও কিছু করতে পারবেন। ভবিষ্যৎ জীবনের আর্থিক সচ্ছলতা আসবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সবার আর্থিক নিরাপত্তার ভাবনাটা প্রাধান্য পায়। নারী স্থপতি ও প্রকৌশলীদের আগের থেকে অনেক বেশি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ এখন কতটা ভালো, সেটাও একটা প্রশ্ন। সেদিন একটা পত্রিকায় দেখলাম, এক রুমে অনেক শিক্ষার্থী চাপাচাপি করে থাকেন। আমাদের সময় বুয়েটে ছিল এক হাজার শিক্ষার্থী। এখন পাঁচ হাজার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল ৫ হাজার, এখন সেখানে ৪০ হাজার। এই ছাত্রছাত্রী কীভাবে নিশ্বাস নেন? তারপরও ঢাকায় বায়ুদূষণের ভয়াবহ অবস্থা। শুধু ইটের ভাটা বন্ধ করলেও বায়ুদূষণ অনেকটা কমে যেত।

প্রতিবছর কয়েক হাজার স্থপতি-প্রকৌশলী একাডেমিক শিক্ষা শেষ করছেন। তাঁরা সবাই চাকরি–ব্যবসাসহ কোনো না কোনো পেশার সঙ্গে যুক্ত। এ পেশায় কেন নারীরা আরও বেশি করে আসবেন না? আসা জরুরি।

তাঁদের সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্র রয়েছে। এখনে যাঁরা কথা বললেন, তাঁদের অনেকের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে অনেক নারী স্থপতি ও প্রকৌশলী কাজ করেন।

স্থাপত্য ও প্রকৌশলবিদ্যায় পড়ার জন্য মেয়েদের বেশি করে স্কলারশিপ দিতে হবে। সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।

রাশেদা কে চৌধূরী

আমি মনে করি, আজকের আলোচনার শিরোনাম শুধু নারীর ইস্যু নয়, এটা সমাজের ইস্যু। দেশ ও সব মানুষের ইস্যু। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেসব নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন নারী রয়েছেন, তাঁদের কথাও ভাবতে হবে।

সরকারি বাজেটে স্কুলের পর শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা, ছবি আঁকা, গান, আবৃত্তিসহ বিভিন্ন বিষয় শেখানোর উদ্যোগ নেওয়া খুব জরুরি। তবে কোনোভাবেই যেন কোচিং–বাণিজ্য না হয়।

গবেষণা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু খুব আশ্চর্য হতে হয়, দেশে কোথাও তেমন গবেষণা হয় না। এমনকি সঠিক তথ্য–উপাত্ত নেই। কৃষি গবেষণার বরাদ্দের জন্য কৃষিতে আমাদের বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে।

অনেক বিত্তহীন পরিবারের মেয়েরাও উচ্চশিক্ষায় আসছেন। তাঁরা যেন আরও ভালোভাবে টিকে থাকতে পারেন, রাষ্ট্রের সে ব্যবস্থা করতে হবে। প্রায় তিন দশক ধরে বাংলাদেশে নারীরা সরকার পরিচালনা করছেন। তারপরও কেন সর্বস্তরে নারীর রোল মডেল তৈরি হবে না।

স্বাধীনতার আজ প্রায় ৫০ বছরে গত কিছুদিন আগে মাত্র একজন নারী মৎস্য শিকারের সনদ পেয়েছেন। পাবেন কীভাবে? সনদে লেখা থাকে ফিশারম্যান। একজন নারী মাছ ব্যবসায়ী হতে পারেন—এ চিন্তাই করা হয়নি। আমি আবার শুরুর কথা বলে শেষ করতে চাই, এ ধরনের ইস্যু শুধু নারীর ইস্যু নয়, এটা সবার ইস্যু। সবার একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

ফিরোজ চৌধুরী

প্রকৌশল ও স্থাপত্যের মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় নারীর অংশগ্রহণ যত বাড়বে, দেশ তত এগিয়ে যাবে। আমরা প্রত্যাশা করি, সমাজের সব ক্ষেত্রেই নারী-পুরুষ সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।

আজকের আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

আলোচনায় সুপারিশ

*  সমাজে বেশি করে নারী স্থপতি ও প্রকৌশলী রোল মডেল নিয়ে আসতে হবে 

*  নারী স্থপতি ও প্রকৌশলীদের নিরাপদ বাসস্থান ও যোগাযোগ নিশ্চিত করা জরুরি

*  স্থাপত্য ও প্রকৌশলবিদ্যায় পড়ার জন্য মেয়েদের বেশি করে স্কলারশিপ ও গবেষণার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন

*  নারীরা যেন স্থাপত্য ও প্রকৌশল পেশায় আরও বেশি আসেন, এ জন্য ছোটবেলা থেকে অভিভাবক, শিক্ষকসহ সবার উৎসাহিত করা দরকার

*  নারী স্থপতি ও প্রকৌশলীদের পেশাজীবনে ভালো করতে সন্তানের জন্য ডে–কেয়ার সেন্টার খুবই জরুরি

*  অনেক ক্ষেত্রে অনেক রাত পর্যন্ত নারী প্রকৌশলী ও স্থপতিদের কাজ করতে হয়, এ ক্ষেত্রে পরিবারসহ সবার সহযোগিতা করতে হবে

যাঁরা অংশ নিলেন

রাশেদা কে চৌধূরী: নির্বাহী পরিচালক, গণসাক্ষরতা অভিযান

শামীম জেড বসুনিয়া: ইমেরিটাস অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) তাহ্‌মিনা আহমেদ:পরিচালক, সেভেন রিংস্ সিমেন্ট

ফাহমিদা হক খান:প্রকৌশলী; উপসচিব, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়

তাবাস্‌সুম মাহমুদ: নির্বাহী স্থপতি, স্থাপত্য অধিদপ্তর, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়

গৌতম চ্যাটার্জি: প্রধান বিপণন কর্মকর্তা, সেভেন রিংস্ সিমেন্ট

নাজনীন আরা কেয়া: প্রধান প্রকৌশলী, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প, বাংলাদেশ রেলওয়ে

নন্দিনী আওয়াল: সহযোগী অধ্যাপক, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি

সীমিতা রায়: লেকচারার, স্থাপত্য বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)

কাজী মোহাম্মদ শাহেদ: ম্যানেজিং পার্টনার, জুনক্স কনসালটিং

খুরশীদ আলমেহের: প্রধান নির্বাহী, কেইমন্টো অ্যান্ড পার্টনার্স

সাইদা আক্তার: প্রধান স্থপতি, মাত্রিক

শেখ নওরিন লায়লা: প্রকল্প সমন্বয়ক, ডিজাইন, প্ল্যানিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্স লিমিটেড

সামিয়া শারমিন: শিক্ষার্থী, স্থাপত্য বিভাগ, এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়

আতিক আকবর: উপমহাব্যবস্থাপক, ব্র্যান্ড অ্যান্ড কমিউনিকেশনস, সেভেন রিংস্ সিমেন্ট

আবু হায়াত মো. তৌহিদুর রহমান: সহকারী মহাব্যবস্থাপক, বিজনেস ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড টেকনিক্যাল সাপোর্ট, সেভেন রিংস্ সিমেন্ট

সূচনা বক্তব্য

আব্দুল কাইয়ুম: সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী: সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো