নারীর সমতা ও গণতন্ত্রের উল্টো যাত্রা

নারীর ক্ষমতায়ন ও সমতা অর্জনের লক্ষ্যে সবচেয়ে জোরালো একটি বৈশ্বিক চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার ২৫ বছর পর জাতিসংঘ মহাসচিব অান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, বিশ্বে এখন সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা। জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বেইজিং ঘোষণার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে এক বিশেষ আলোচনায় তিনি বলেছেন, নারী অধিকারে অবনতি, উদ্বেগজনক হারে নারী হত্যা, নারী অধিকার কর্মীদের ওপর হামলা এবং তাঁদের বঞ্চিত করা অথবা বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করার মতো আইন ও নীতি বজায় থাকায় তিনি উদ্বিগ্ন।

ওই একই অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান মিশেল ব্যাশেলেট নারী-পুরুষের সমতার প্রশ্নে প্রাচীন বৈষম্যভিত্তিক ভাষ্যগুলোর পুনরুত্থান ঘটার উল্লেখ করে বলেছেন, নারী অধিকার এখন হুমকি ও আক্রমণের মুখে। তাঁর ভাষায়, নারী অধিকার রাজনীতির হাওয়া বদলের সঙ্গে তাল মেলানোর বিষয় নয়। আলোচনায় মূল কথা যা উঠে এসেছে, তা হলো বেইজিং ঘোষণায় যেসব অধিকারের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকারের
প্রতিফলন ঘটেছিল, ২৫ বছর পর তা অনেকটাই বদলে গেছে।

মঙ্গলবার ৩ মার্চ জাতিসংঘ শিশু তহবিল, ইউনিসেফ, ইউএন উইমেন এবং প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল এক যৌথ প্রকাশনায় বলেছে, নারী ও মেয়েশিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা শুধু স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা-ই নয়; বরং তা এখন ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। ভয়াবহ সব পরিসংখ্যান তুলে এনেছে তাদের এই গবেষণা। বিশ্বে যত মানব পাচার ঘটছে, তার ৭০ শতাংশই নারী ও বালিকা। ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের প্রতি ২০ জনে একজন তাদের জীবনে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। প্রতিবছর ১ কোটি ২০ লাখ নাবালিকার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। আরও বিস্ময়কর হচ্ছে, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েরা ছেলেদের বউ পেটানোকে যৌক্তিক বলে গ্রহণ করতে প্রস্তুত বলে সমীক্ষায় আভাস মিলেছে।

বৃহস্পতিবার, ৫ মার্চ জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, ইউএনডিপি প্রথমবারের মতো প্রকাশ করেছে নারী-পুরুষের সামাজিক রীতিনীতির সূচক (জেন্ডার সোশ্যাল নর্ম ইনডেক্স)। সূচকটির জন্য তারা ৭৫টি দেশে জরিপ চালায়, যাতে বিশ্বের ৮০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের প্রতিফলন ঘটে। এতে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই নারীর বিরুদ্ধে কোনো না কোনো ধরনের পক্ষপাত ধারণ করেন। নারীদের বিরুদ্ধে পক্ষপাত পুরুষদের মধ্যে ৯১ শতাংশ। কিন্তু নারীদের মধ্যেও এই পক্ষপাতের হার ৮৬ শতাংশ। এই জরিপে দেখা যাচ্ছে, অর্ধেকের বেশি মানুষ মনে করে, রাজনৈতিক নেতা হিসেবে পুরুষেরা অপেক্ষাকৃত ভালো। ৮০ শতাংশ মনে করে, পুরুষেরা ব্যবসায়ে মেয়েদের চেয়ে ভালো। বউ পেটানোকে গ্রহণযোগ্য মনে করে এক-তৃতীয়াংশ নারী-পুরুষ। ইউএনডিপির নির্বাহী পরিচালক পেড্রো কনচিয়াকো বলছেন, ‘আমরা জানি যে বিশ্বে পুরুষের প্রাধান্য আছে, কিন্তু এই জরিপে এসব পক্ষপাতের সংখ্যাগত ধারণা পাওয়া গেল।’ বিশ্বে মাত্র ছয়টি দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নারীর বিরুদ্ধে পক্ষপাতমুক্ত। এগুলো হচ্ছে অ্যান্ডোরা, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে ও সুইডেন। জরিপে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত ছিল না বলে আমাদের দেশের আসল চেহারাটা এখানে মিলবে না। 

তবে সংবাদপত্রের পাতাগুলোয় নারীর প্রতি যেসব সহিংসতার চিত্র উঠে আসে, তা ভয়াবহ। এক দিকে যেমন সহিংসতা বাড়ছে, অন্য দিকে প্রকট হচ্ছে বিচারহীনতা। আরও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, নারী নির্যাতনের ঘটনায় এখন অতীতের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জড়িয়ে পড়ছেন বলে অভিযোগ উঠছে। মানবাধিকার সংস্থা, অধিকারের হিসাবে গত বছর বাংলাদেশে গড়ে দৈনিক তিনজন নারী বা শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। মোট ১ হাজার ৮০ জনের মধ্যে ৭৩৭ জনের বয়স ছিল ১৮–এর নিচে। গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৫০ জন নারী। গণপরিবহনে নারীদের যৌন হয়রানি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। কর্মস্থল এবং বাড়িতেও হয়রানি ও বৈষম্যের ঘটনা বেড়ে চলেছে।

ইউনিসেফের জরিপে অবশ্য ইতিবাচক চিত্রটিও আছে, আর তা হচ্ছে বৈশ্বিক পরিসরে শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। আইন তৈরির ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে ইতিবাচক অগ্রগতি ঘটেছে। পার্লামেন্টে অংশগ্রহণ বেড়েছে। তবে তা এখনো ২৫ শতাংশের কম। ১৯৯৫ সালের তুলনায় তা দ্বিগুণ। অর্থাৎ, ২৫ শতাংশে পৌঁছাতে ২৫ বছর সময় লেগেছে। পার্লামেন্টারিয়ানদের বৈশ্বিক সংগঠন ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) হিসাবে বিশ্বে চারটি দেশে এই প্রতিনিধিত্ব ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। সেই চারটি দেশ হচ্ছে রুয়ান্ডা, কিউবা, বলিভিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। অবশ্য পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব ৫০ শতাংশ হলেই যে নারীর ক্ষমতায়ন বা সমতা অর্জিত হয়, সে কথা এই চারটি দেশের সবার ক্ষেত্রে বলা যাবে, তা নয়। মাত্র গত বৃহস্পতিবারই খবর বেরিয়েছে, ব্রিটেনের হাইকোর্টের এক মামলার রায়ে বলা হয়েছে যে দুবাইয়ের শাসক তাঁর ১১ বছরের কন্যাকে সৌদি যুবরাজের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য যুক্তরাজ্য থেকে অপহরণের চেষ্টা করেছিলেন বলে বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ রয়েছে।

নারী অধিকার ও সমতা বিষয়ে বিশ্বের এই যে উল্টোমুখী যাত্রা, তার কারণ কী? প্রশ্নটি সবারই গুরুত্বের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করা প্রয়োজন। অনেকেই এর একটি সম্ভাব্য কারণ হিসেবে বিশ্বজুড়ে ডানপন্থী রক্ষণশীল রাজনীতির উত্থানকে চিহ্নিত করছেন। এই রক্ষণশীল রাজনীতির উত্থানের পুরোভাগে আছে যুক্তরাষ্ট্র। গর্ভপাতের অধিকার বিষয়ে সেখানে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকে উল্টে দেওয়ার জন্য রিপাবলিকান পার্টির তোড়জোড় এখন তুঙ্গে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনাসহ আরও কয়েকটি দেশে রক্ষণশীল রাজনীতিকেরা ক্ষমতায় এসে ওই একই পথে হাঁটছেন। রক্ষণশীল রাজনীতির ঢেউ ইউরোপেরও উপকূল ছুঁয়েছে এবং নারী অধিকার কর্মীরা হুমকির ভয়াবহতা উপলব্ধি করছেন।

রক্ষণশীলতার নব-উত্থানের পাশাপাশি আরেকটি বড় হুমকির উৎস হচ্ছে গণতন্ত্রের ক্ষয়প্রাপ্তি। বিশ্বজুড়ে যেভাবে গণতন্ত্র দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে, তাতে সমাজের কোনো গোষ্ঠীর অধিকারই নিরাপদ নয়।  ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউসের সর্বসাম্প্রতিক প্রতিবেদন ‘ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ২০২০’-এ বলা হয়েছে, বৈশ্বিকভাবে গণতন্ত্রের পশ্চাৎযাত্রা ১৪ বছর পার করেছে। এ ক্ষেত্রেও সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছেন যুক্তরাষ্ট্রের জনতুষ্টিবাদী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আইনের শাসন এবং জবাবদিহির ক্ষেত্রে যেসব বড় ধরনের বিচ্যুতি
এবং লঙ্ঘনের নজির তৈরি হচ্ছে, তা বিশ্বের কর্তৃত্ববাদী শাসকদেরই উৎসাহ জোগাচ্ছে। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশেও গণতন্ত্রের ক্ষয়প্রাপ্তির চিত্রই উঠে এসেছে।

মোদ্দা কথা হচ্ছে, নারীর ক্ষমতায়ন এবং সম–অধিকার অর্জন গণতন্ত্রের সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। বৈশ্বিক পরিসরে গণতন্ত্রের ধারায় যে ক্ষয়প্রাপ্তির প্রবণতা, তার প্রতিফলন নারী অধিকারের ক্ষেত্রে বরং একটু বেশি প্রকট। তাই নারী অধিকারের প্রশ্নে উল্টোমুখী যাত্রা ঠেকাতে গণতন্ত্রের সংগ্রামে মনোযোগী হতে হবে।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক