নারী হলেই সবকিছু দ্বিগুণ, কষ্টটাও

আমার সেজ খালা লুৎফুন্নেসা। হারিকেন জ্বেলে পড়তে হয়—এমন গ্রামে বড় হয়েছিলেন তিনি। টিনের বেড়ার নিচের অংশ এতই ভাঙা যে স্কুলে টিকা দিতে এলে ওটার ফাঁক গলে দিব্যি পালিয়ে যাওয়া যেত। সেই রকম এক প্রাইমারি স্কুল থেকে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে ফেলেছিলেন। তাঁর পরিবার ও স্কুল—দুই–ই দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল তাঁকে নিয়ে।

আমার যে বছর জন্ম, তার পরের বছর এই কাণ্ড। ১৯৭৯ সাল। ফলে আমি এই ঘটনার সজ্ঞান সাক্ষী হতে পারিনি। পরে গল্প শুনেছি। কিন্তু তিনি ক্লাস এইটেও যখন একই কাণ্ড ঘটালেন, আমি তখন তার আঁচ স্পষ্ট টের পেলাম। খালা এত জোরে হাসতেন যে তিন বাড়ি দূর থেকেও শোনা যেত। তার পথ রোধ করে দাঁড়ায়—এমন সাহস কারও ছিল না—না পরিবারে, না গ্রামে। তার পরের কাণ্ড তাঁর সায়েন্স নেওয়া। এসএসসি ও আইএসসিতেও দারুণ রেজাল্ট করলেন। পরিবারের কপালে ভাঁজ, যে গতিতে তিনি এগোচ্ছেন, কলেজ পর্যন্ত তো বাড়ি থেকেই পড়া গেল, তারপর কী? আশপাশের দশ গ্রামের কেউ তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়নি। কিন্তু খালা নিজেই এই বিপদ থেকে সবাইকে উদ্ধার করলেন, বললেন, অনেক হয়েছে লেখাপড়া, এবার চাকরি করব। ফ্যামিলি প্লানিংয়ে চাকরি নিলেন। অনেক পরে আমি বুঝেছি, তিনি আসলে বুঝতে পেরেছিলেন, একা লেখাপড়া করে অনেক দূর হয়তো যাওয়া যায়, কিন্তু তাতে পরিবর্তন সামান্যই হয়। গ্রামের লোকেদের কাছাকাছি থাকতে হলে এর চেয়ে ভালো মাঠের চাকরি আর হয় না। চাকরির বাঁধাধরা জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি বাতলানোর পাশাপাশি বিপুল বেগে তিনি যে কাজটা করলেন, সেটা হলো পুষ্টিজ্ঞান নিয়ে যুদ্ধ। কয়েক বছরের মধ্যে এর ফলাফল চোখে পড়ল।

আর আমরা যারা সরাসরি তাঁর ছায়ায় বড় হচ্ছিলাম, তাদের জীবনবোধ বদলে যাচ্ছিল তাঁর কথায়।

আমি যখন গ্রামের প্রাইমারি স্কুল পাস করে থানা সদরের হাইস্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়তে গেলাম, তখন একদিন আমাকে ধরলেন, বললেন, বড় তো হচ্ছিস, চোখ–কান খোলা রাখতে হবে। বললেন, এই যে আমরা গরিব দেশে, গরিব পরিবারে জন্মেছি, এতে তো আমাদের হাত নেই, গরিব হওয়ার কারণে অনেক সমস্যা হবে আমাদের, সেটা সবারই হবে। কিন্তু শুধু মেয়ে হওয়ার কারণে বাড়তি কোনো বাধা কখনো মানবি না। তারপর গলা নামিয়ে বললেন, রাস্তাঘাটে ছেলে–ছোকরারা ঝামেলা করলে বুদ্ধি আর সাহস দিয়ে সামাল দিতে হবে, কথা বলবি গলার স্বর এক জায়গায় রেখে, ভয় এবং রাগ কন্ট্রোলে রেখে। কিন্তু যদি বাড়াবাড়ি করে, তাহলে মাইর দিবি, বাড়িতে বিচার এলে আমি সামলাব। তারপর গলা আরও নিচে নামিয়ে বললেন, রাস্তাঘাটে চলতে–ফিরতে একটা খোলা কলম অন্তত হাতে রাখবি, দেখবি দরকারের সময় কেমন কাজে লাগে। ধারণা করি, এই অমিয় বাণী তিনি আরও অনেককেই দিয়েছিলেন।

খালার এই সাহস জীবনে খুব কাজে লেগেছে। কিন্তু দেখেছি, অনেককে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার বুদ্ধি-সাহস-ধৈর্য-মমতার অধিকারী হওয়া ভীষণ দুরূহ।

এই দেশে খারাপ কাজ যত সহজে করা যায়, ভালো কাজে ততটাই বাধা। এখানে জন্মমুহূর্তে নিজের ঘর থেকেই শুরু হয় বৈষম্য ও নির্যাতন। ছেলেশিশু আর মেয়েশিশু ভিন্ন ভিন্নভাবে পরিবার থেকেই পায়ের নিচে অশক্ত মাটি নিয়ে বড় হয়। পরিবার তো ভালোবাসারই জায়গা, বিচ্ছিন্ন কোনো প্রতিষ্ঠান তো নয়। এই দেশে ক্ষমতা যাদের হাতে যখনই গেছে, কোনো দিন তারা পুরো দেশটাকে একসঙ্গে দেখতে পায়নি। তারা বেছে নিয়েছে একটা ক্ষুদ্র অংশ, তারাই ক্ষমতার ছায়ায় সব সুবিধা নিয়ে নিয়েছে। বাকি দেশ চলেছে তার খেসারত দিয়ে দিয়ে। যেন যাবতীয় সুবিধা মাথাকে দিয়ে, সেই জগদ্দল মাথা টানতে দেওয়া হয়েছে একটা পঙ্গু শরীরকে। এখানে শহুরে শিক্ষিত আর গ্রামীণ অশিক্ষিত, দরিদ্র আর আধা দরিদ্র নারী আর পুরুষ, শিশু আর বৃদ্ধ সবাই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এ অনিরাপত্তাবোধ বহুমাতৃক; অর্থনৈতিক, সামাজিক, লৈঙ্গিক। শিক্ষাব্যবস্থা এখানে কখনো সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারেনি। যত দিন যাচ্ছে আরও বেহাল হচ্ছে অবস্থা। নাগরিক অধিকারের সব শাখা এ দেশে বন্ধ। নারীর নিরাপত্তা নিয়ে কথা বললে সেটা বোঝার মতো মানুষই কম। প্রত্যেকে এখানে বিচ্ছিন্নভাবে ক্ষমতার দাবার ঘুঁটি। দেশের প্রকৃতি, দেশের সম্পদ এখানে ক্ষমতায় থাকার ঘুষ। শতকরা ২ ভাগ মানুষ সব খেয়ে ফেলছে, বাকিদের জন্য উন্নয়নের মুলা।

নারীর কথা আলাদা করে বলব বলে লিখতে শুরু করেছিলাম। নাগরিক নারী আর গ্রামীণ নারীর নানান অসুবিধা আর সমাধানের কথা অভিযোগ আকারে অথবা দাবি আকারে বলা তো যায়ই। কিন্তু নারীর নিরাপত্তা একটা অনেক বড় সূচক। একটা দেশে যাবতীয় অন্যায় অনায়াসে ঘটতে পারে, সেখানে শুধু নারী নিরাপদ থাকবে—এটা কীভাবে আশা করা যায়?

যে পুরুষ হয়তো রাষ্ট্র-সমাজে অত্যাচারিত, কিন্তু গৃহে তিনিই দাপুটে। এমন অত্যাচারিত আবার যখন অত্যাচারী হয়, তখন নারীকে বাড়তি লড়াই করতে হয়। নির্যাতনপ্রবণ পরিবার এবং সম্পর্ক নারীর পথ তুলনামূলক বেশি কঠিন করে। যখন বায়োলজিক্যাল মাতৃত্বের সঙ্গে সঙ্গে সিংহভাগ সামাজিক মাতৃত্বও নারীকেই বহন করতে হয়, তখন তার চলার গতি শ্লথ হয়ই। নারীর কোনো দায়িত্বের কারণে কোন সুবিধা তার অধিকারের মধ্যে পড়ে, সেই হিসাব করতেই হবে। কাজের ক্ষেত্রে কৃষক নারী, শ্রমিক নারী, উচ্চপদস্থ নারীর চার গুণ বাধা কমাতেই হবে। না হলে মৌলিক অধিকারের পথে যাত্রা শুরুই করা যাবে না।

আনোয়ারা আল্পনা: গল্পকার