করোনাভাইরাসে কঠোরভাবে যা করা উচিত

জীবাণু রোধে ব্যবহার্য মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও হেক্সিসল বাজার থেকে প্রায় নাই হয়ে গেছে। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ
জীবাণু রোধে ব্যবহার্য মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও হেক্সিসল বাজার থেকে প্রায় নাই হয়ে গেছে। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

অবশেষে বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হলেন। বৈশ্বিক এবং করোনাভাইরাসের প্রকৃতিগত কারণে এটি স্বাভাবিক ব্যাপারই ছিল।

করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুটি ব্যাপার ঘটে গেছে বাংলাদেশে। এর প্রথমটি হলো ব্যাপক পরিমাণে গুজব ও ভুয়া খবরের ছড়াছড়ি। আর দ্বিতীয়টি হলো মজুতদারি। এমন নয় যে এ বিষয় দুটি আমি অনেক গবেষণা করে বের করেছি। পথে নামলে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খুললে দুটি ব্যাপারই চোখে পড়ছে। আবার এটিও চোখে পড়ছে, সচেতন মানুষ সচেতনভাবেই করোনাভাইরাস নিয়ে চলমান স্রোতে না ভিড়ে সচেতন করছেন লোকজনকে। তবে তাঁদের সংখ্যা খুব বেশি নয় বলে অবস্থা নাজুক।

এই মুহূর্তে আসলে আমাদের করণীয় কী? সাধারণ মানুষের করণীয় তেমন কিছু নেই, যথাযথ কর্তৃপক্ষের সতর্কীকরণ নির্দেশনা মেনে চলা ছাড়া। যা করার সেটা করতে হবে সরকারকে। তবে আমরা যেটা বলতে পারি, সম্ভব হলে সরকারের উচিত একটি মনিটরিং সেল তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়াতে থাকা ভুয়া খবর, গুজব এবং অপপ্রচারকে কঠোরভাবে বন্ধ করা। অবশ্যই সেটি কঠোরভাবে হতে হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ‘কেরালা ফর্মুলা’ গ্রহণ করতে পারে। এক মাসের কিছু বেশি আগে ভারতের কেরালায় করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয়। প্রস্তুত ছিল কেরালার রাজ্য সরকার। তারা দ্রুততার সঙ্গে স্বাস্থ্যগত সমস্ত বিষয় গুছিয়ে ফেলে। ঘটনা সেটা নয়। ঘটনা হলো কেরালা সরকার একটি মনিটরিং সেল তৈরি করে। করোনাভাইরাস বিষয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে ভুয়া সংবাদ ছড়ানো কঠোরভাবে বন্ধ করেছিল সেই সেল। শুধু তা–ই নয়, তারা রোগীদের সমস্ত সাধারণ তথ্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিল, যাতে সুযোগসন্ধানীরা কোনো সুযোগ না পায়। এর পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়ানোর কাজে কেরালার রাজ্য সরকার কাজে লাগিয়েছিল তাদের মাঠপর্যায়ের সব প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানকে। সম্ভবত সবচেয়ে বেশি কাজে লাগিয়েছিল গ্রাম পঞ্চায়েতকে। তারা সফল হয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে, সেখানে কোনো আতঙ্ক নেই, সতর্কতা আছে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, সঠিক তথ্যের অভাবে ভুয়া সংবাদ, গুজব, অপপ্রচারের মতো বিষয়গুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এসব ছড়ানো মানুষ দুই ধরনের—অতি ধুরন্ধর ও অবোধ। প্রথম শ্রেণির মানুষ বিভিন্নভাবে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফায়দা তুলে নিতে চায় বলে দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষের ওপর ভর করে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংবাদেও আমরা সেটা দেখছি।

সংবাদমাধ্যমগুলো সংবাদ প্রকাশ করেছে যে আতঙ্কের কারণে মানুষ বাজার করছে বেশি বেশি। আর সে কারণে ইতিমধ্যে সাধারণ মাস্ক, জীবাণুনাশক ইত্যাদি বাজার থেকে উধাও অথবা উধাও হওয়ার উপক্রম। ১৫ টাকার মাস্ক এখন ১৫০ টাকাতেও পাওয়া যাচ্ছে না। কারওয়ান বাজারে কানাঘুষো শোনা গেল, বিক্রি ভালো। কারণ মানুষ কিনছে বেশি বেশি, যাতে বিপদের দিনে খাবারের অভাবে পড়তে না হয়। কিন্তু কেউ বুঝতে পারছে না বিপদটা কেমন, কীভাবে আসতে পারে। মানুষের এই আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার বড় কারণ ভুয়া খবর, গুজব ও অপপ্রচার। কিছুদিন আগে পেঁয়াজের দাম যখন আকাশছোঁয়া, তখন হঠাৎ লবণ নিয়ে এমন গুজব শোনা গিয়েছিল।

করোনাভাইরাসের আতঙ্কে মাস্কের বিক্রি বেড়েছে। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাসের আতঙ্কে মাস্কের বিক্রি বেড়েছে। ছবি: রয়টার্স

ভুয়া খবর ছড়িয়ে এই বিভ্রান্তি সৃষ্টির নেতিবাচক দিক প্রচুর। মানুষ ক্রমে করোনাভাইরাস নিয়ে এসব খবর, গ্রাফিকস, ভিডিও দেখতে দেখতে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে কী করবে ভেবে না পেয়ে ট্রেন্ড ফলো করছে। একজন কোনো কারণে স্যানিটাইজার কিনলে আরও পাঁচজন কিনছে। একজন মাস্ক কিনলে আরও দশজন কিনছে। ফলে যাদের জিনিসটির আসলেই দরকার, তারা পাচ্ছে না বা তাদের বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এ ব্যাপারটা যে শুধু শহরকেন্দ্রিক, তা নয়; এটি ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামের দিকেও, ক্রমাগত আমরা সেই খবর পাচ্ছি। আমাদেরও ইউনিয়ন পরিষদ আছে একেবারে গ্রাম পর্যায়ে। এই মাঠপর্যায়ের প্রতিষ্ঠানটিকে কর্মক্ষম করে তোলা হোক। এই প্রতিষ্ঠানটি বাস্তবিক অর্থে শক্তিশালী। যাঁরা এই ইউনিয়ন পরিষদ বিষয়ে ন্যূনতম খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা জানেন, একজন চেয়ারম্যান কিংবা মেম্বার কত দ্রুত এবং কার্যকরভাবে কাজ করতে পারেন।

সরকারকে আমরা এসব বলতে পারি, চাপ প্রয়োগ করতে পারি। করোনাভাইরাস নিয়ে ভুয়া খবর, গুজব আরও ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ার আগে, মানুষের মধ্যে আরও আতঙ্ক চেপে বসার আগে, তারা কার্যকর পদক্ষেপ নিক। কারণ, করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য চিকিৎসাব্যবস্থা এবং সতর্কতার দিকে জোর দিলেই এখন আর হচ্ছে না। ভুয়া খবর, গুজব কিংবা অপপ্রচার বন্ধ করুন, মানুষের আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে কেনাকাটা এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে।

রজত কান্তি রায়: লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]