আগাম প্রস্তুতির সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে

মো. রিদওয়ানউর রহমান।
মো. রিদওয়ানউর রহমান।
>

অধ্যাপক মো. রিদওয়ানউর রহমান। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান হিসেবে এক যুগ দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৭ সালে অবসর নেন। বর্তমানে ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজের রিসার্চ সেন্টারের প্রধান। প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি ও সামর্থ্য নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো: করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশের সামর্থ্য কতটুকু?

মো. রিদওয়ানউর রহমান: উহানে আঘাত হানার পর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হিসেবে আমাদের কার্যকর প্রস্তুতি নেওয়ার সময় ছিল। এখনো তা শেষ হয়ে যায়নি। তবে ব্যাপকভিত্তিক যে প্রস্তুতি, সেটা থেকে বাংলাদেশ পিছিয়ে। এ বিষয়ে যা যা বলা হচ্ছে, তা থেকে বাস্তব প্রস্তুতিতে ঘাটতি আছে বলে মনে হয়। কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা ও আইসোলেশন আলাদা। ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দূর করতে আইসোলেশনে রাখার মতো যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করাটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি। রোগীদের দ্বারা স্বাস্থ্যকর্মীরা যাতে আক্রান্ত না হন, সেটা দেখতে হবে। যাঁরা সেবা দেবেন, তাঁরা কারা হবেন, তার তালিকা দরকার। এবং তাঁদের এখনই উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। হজ ক্যাম্পে বড়জোর ১ হাজার লোককে কোয়ারেন্টাইনে রাখা সম্ভব।

প্রথম আলো: নিজেদের আক্রান্ত হওয়ার ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে স্বাস্থ্যকর্মীরা সেবা দিতে কতটুকু প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকবে বলে আপনি মনে করেন?

রিদওয়ানউর রহমান: সব রকম ঝুঁকি মনে রেখে প্রস্তুতি না নিলে এটা মোকাবিলায় বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। আমরা কেউ সেটা চাইব না। কিন্তু ধরে নিয়ে কাজ করাই সমীচীন হবে। কারণ, কোনো কারণে ছড়িয়ে গেলে তখন উপযুক্ত প্রস্তুতি নিতে গেলে তা খুবই কঠিন হতে পারে।

প্রথম আলো: বেসরকারি খাতের ওপর কতটা ভরসা করব? এই মুহূর্তে তাদের সক্ষমতা কী কী রকম?

রিদওয়ানউর রহমান: কার্যত তেমন কোনো সক্ষমতা নেই। আর সেটা প্রকৃতপক্ষে তাদের পক্ষে গড়ে তোলাও সম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে এর পুরোটাই সরকারি খাতকেই করতে হবে। কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন ও চিকিৎসা—সবটাই সরকারি খাতকে দিতে হবে। চীন যেভাবে দ্রুত সামর্থ্য গড়ে তুলছে, সেভাবে করা আমাদের পক্ষে নিশ্চয় দুরূহ। কিন্তু যতখানি সম্ভব, সেটাও কিন্তু এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়। পুনশ্চ বলব, সময় দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে। প্রতিটা মুহূর্ত আমাদের কাজে লাগানো দরকার।

প্রথম আলো: সরকার অনেকগুলো কমিটিসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

রিদওয়ানউর রহমান: এ বিষয়ে মন্তব্য করা রাজনৈতিক হয় কি না জানি না, তবে এসবের বাস্তব কার্যকরতা সন্তোষজনক পরিস্থিতি থেকে অনেক দূরে। কাগজে-কলমে আছে, মাঠে নেই। তাই মাঠ শক্তিশালী করতে হবে। কিছু জায়গায় কোয়ারেন্টাইন হচ্ছে, কিন্তু বড় আকারে আঘাত এলে কোয়ারেন্টাইন কোথায় কীভাবে হবে, তা ঠিক করা নেই। এ পর্যন্ত যে চারটি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের কারও সেভাবে আইসোলেশন সুবিধাদি রয়েছে বলে জানা যায় না।

প্রথম আলো: ধরুন ডেঙ্গুর মতো আকস্মিক সন্দেহভাজন করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেল। তখন মানুষ কোথায় যাবে? বঙ্গবন্ধু মেডিকেল নাকি ঢাকা মেডিকেল কলেজ?

রিদওয়ানউর রহমান: না। প্রশ্নই আসে না। আইসোলেশন আর সেপারেশন কিন্তু এক বিষয় নয়। সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের অন্য রোগীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু করোনায় তা চলবে না। কারণ, তা অত্যন্ত ছোঁয়াচে। তাই সরকারি হাসপাতালে কাউকে নেওয়া যাবে না। তাই এটা মোকাবিলায় একটা বিশেষ জরুরি ব্যবস্থাপনা দরকার।

প্রথম আলো: আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা নিয়মিত পরিস্থিতির বিষয়ে ব্রিফ করছেন। এর ফল ও কার্যকারিতা কী?

রিদওয়ানউর রহমান: এ বিষয়ে সমীক্ষা নেই। তাই রেফারেন্স বক্তব্য দেব না। তবে ব্যক্তিগতভাবে বলব, সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নগরবাসী করোনা সম্পর্কে জেনে গেছেন। এটা খুব দরকার ছিল। এই রোগ মোকাবিলায় মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। অবশ্য
গ্রামের মানুষ কতটা সচেতন জানি না। ১৯১৮ থেকে ২০ সালের মধ্যে ফ্লুতে উন্নত বিশ্বেরই কয়েক কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এই সময়টায় সৈন্যদের মনোবল ভেঙে যাবে, সেই ভয়ে এসব তথ্য লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। তাই এত বিপুল মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। স্পেন এটা প্রকাশ করে বেচেছিল। তাই এই ফ্লু স্প্যানিশ ফ্লু নামেও পরিচিত। সুতরাং মানুষকে সবটা বলতে হবে। তাই সর্বোচ্চ প্রস্তুতি দরকার। ৫০ থেকে ৭০ বছর বয়সীদের মৃত্যুঝুঁকি ৫ ভাগ। ৭০ বছরের বেশি হলে আরও ৯ ভাগ বেশি। বাচ্চাদের ঝুঁকি অবশ্য খুব কম।

প্রথম আলো: সরকারি প্রচার-প্রচারণা যা চলছে, সেটা যথেষ্ট কি?

রিদওয়ানউর রহমান: যা চলমান, সেটা খারাপ নয়। তবে একে আরও শক্তিশালী করার উপায় আছে। শুধু রাজধানীতে নয়, গোটা দেশে সমান প্রস্তুতি নিতে হবে। বিশেষ করে ছড়িয়ে পড়ার আগেই দেশের প্রতিটি বড় শহরে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়ে রাখতে হবে। এটা করতে হবে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আগে, পরে নয়। কারণ, তখন তা অনেক দেরি হয়ে যাবে। চীনে যে পদ্ধতিতে চিকিৎসা চলেছে, তার নাম ইসিএমও। এক্সট্রা কর্পোরিয়াল মেমব্রেন অক্সিজিনেশন। ওদের শুধু টিকা দিয়ে অক্সিজিনেশন রক্ষা করা হয়েছে। তা ছাড়া অনেক রোগীকে বাঁচানো যেত না। আমাদের কিন্তু ওই চিকিৎসাব্যবস্থা নেই। তবে এটা বলব, অর্থের কিন্তু সংকট নেই। প্রতিবছর আমাদের স্বাস্থ্য খাতের একটা বড় অর্থ ফেরত যায়। সুতরাং উপযুক্ত পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নটাই মুখ্য। কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন লোকবল দিয়ে এটা মোকাবিলা করতে হবে। যদি না পারি তাহলে কিন্তু বিপদ হতে পারে।

প্রথম আলো: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে গাইডলাইন দিয়েছে, তার কত শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে?

রিদওয়ানউর রহমান: এর অনেকটাই পূরণ হয়নি। অথচ তা করার সামর্থ্য রাখে বাংলাদেশ। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেই সব পূরণ করতে হবে। বাংলাদেশের প্রস্তুতির বিষয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত যে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন, সেটাই বাস্তবতা।

প্রথম আলো: চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং ৫ মার্চ প্রথম প্রকাশ্যে বলেছেন, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস স্ক্রিনিং পরীক্ষা পর্যাপ্ত নয়। এ জন্য বাংলাদেশের সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের ভিত্তি কী?

রিদওয়ানউর রহমান: প্রতীয়মান হয় যে তিনি বাংলাদেশের নেওয়া প্রস্তুতির বিষয়গুলো তাঁর নিজের দেশের নেওয়া প্রস্তুতির সঙ্গে তুলনা করেছেন। চীন করোনাবিরোধী লড়াইয়ে জিততে চলেছে। তো এ রকম একটি অবস্থা দেখে তিনি হয়তো মনে করছেন,
বাংলাদেশ উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। যদি একবার আসে এ দেশে, একটা বিপর্যয় হয়ে যাবে। বাংলাদেশ যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে, তা পর্যাপ্ত নয়। আমার এ কথাকে ষোলো আনা সত্যি ধরে নেওয়া যাবে না। বলতে পারেন, এটা আমার একটা আশঙ্কা। নভেল ভাইরাস সম্পর্কে অনেক কিছু আমাদের জানা নেই। তবে মার্স, সার্স, বার্ড ফ্লুর অভিজ্ঞতা আছে।

প্রথম আলো: তিনজন আক্রান্ত হওয়া কী ইঙ্গিত করে?

রিদওয়ানউর রহমান: এর অর্থ হলো আরও ১২ জন আক্রান্তের উপস্থিতি থাকতে পারে। তবে তাঁরা যদি নিজেদের সতর্কতার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন রাখেন, তাহলে সংক্রমণের হার কম হবে। যদি তাঁরা পাবলিক প্লেসে গিয়ে না থাকেন বা গণপরিবহনে চড়ে না থাকেন, তবে ভিন্ন কথা। ভয় হলো, অনেকে অসতর্কভাবে দেশে চলে আসতে পারেন। তাঁরাই ছড়ানোর কারণ হতে পারে বলে ধারণা করা চলে।

প্রথম আলো: একটি কাজ বলুন, যা এখনই করা দরকার।

রিদওয়ানউর রহমান: যে চারটি হাসপাতালকে (মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, মহানগর জেনারেল হাসপাতাল, সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল) চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলো এখনই খালি করা উচিত। সেখানে ডাক্তার, নার্সসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাঁদের মানসিক, শারীরিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে পুরো ফিট রাখতে হবে। এসবের অভাব বক্তৃতা-বিবৃতি পূরণ করতে পারবে না।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

রিদওয়ানউর রহমান: ধন্যবাদ।