করোনাভাইরাসের কথা: সমস্যার নানা দিক

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধের অংশ হিসেবে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বেইজিং থেকে আসা একজন যাত্রীকে পরীক্ষা করা হচ্ছে
করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধের অংশ হিসেবে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বেইজিং থেকে আসা একজন যাত্রীকে পরীক্ষা করা হচ্ছে

সংক্রামক রোগবালাই, মহামারি বলেকয়ে আসে না। তবে দুর্দৈবের ফলে যদি তা দোরগোড়ায় এসেই পড়ে, সক্ষমতার সঙ্গে তা মোকাবিলা করলে ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব। এই পৃথিবী গ্রহটিতে জীবনের ওপরে কিছুই নাই। যুদ্ধবিগ্রহ হোক, মহামারি হোক, যেকোনো কারণেই সেই জীবন যখন হুমকির সম্মুখীন হয়, তার চেয়ে বিষম বিপদ আর হয় না।

করোনাভাইরাসে আতঙ্কিত এখন সব বড় বড় দেশও। চীনে যখন মৃতের সংখ্যা জনা তিরিশ, তখন এই কলামে লিখেছিলাম কাছাকাছি দেশ হিসেবে আমরাও বিপদমুক্ত নই। সর্বোচ্চ সতর্কতার প্রয়োজন। তখন সংশ্লিষ্ট উঁচু আসন থেকে আশ্বস্ত করে বলা হলো, বাংলাদেশের ‘ভয়’ নেই। কী কারণে আমাদের ভয় ছিল না, সে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। এমন নয় যে বাঙালির রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা পৃথিবীর যেকোনো জাতির চেয়ে বেশি।

মোহাম্মদ নাসিম তখন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী। চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিলে তিনি নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের লোকদেরও পরামর্শের জন্য ডেকেছিলেন। দুর্যোগ মোকাবিলায় সবার সহযোগিতা চেয়েছিলেন। ওই সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও ডাক্তারদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, তাঁরা নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। গত বছর ডেঙ্গু রোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স ও অন্য কর্মচারীরা ঈদের ছুটি পর্যন্ত ভোগ করেননি। শুধু তা-ই নয়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ডাক্তার, নার্স অনেকে মারাও গেছেন।

ডেঙ্গু ছোঁয়াচে ও সংক্রামক নয়। এডিস মশা কামড়ালেই কেবল ডেঙ্গু হতে পারে। তাই ডেঙ্গুর প্রকোপের দায় সিটি করপোরেশনের ওপরও বর্তায়। মশা নিধনে তারা ব্যর্থ হওয়ায় মশাই মানুষকে নিধন করেছে। গত বছর সরকারি হাসপাতালগুলোর বারান্দা পর্যন্ত সয়লাব হয়ে গিয়েছিল ডেঙ্গু রোগীতে। এ বছর ডেঙ্গু রোগের মৌসুম সামনে রেখে অনেক বিশেষজ্ঞই এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছিলেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং সিটি করপোরেশন সমন্বয় করে কাজ করলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে। কিন্তু এর মধ্যেই দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ায় জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি নতুন করে মহাসংকটের মুখোমুখি।

হঠাৎ কোনো দেশে সঞ্চালনযোগ্য রোগের প্রাদুর্ভাব হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সে বিষয়ে সচেতন। জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল হেলথ রেগুলেশন ২০০৫-এর অধীনে বিভিন্ন দেশকে ৯টি অ্যাজেন্ডা নিয়ে কাজ করতে হয়। সঞ্চালনযোগ্য কোনো রোগ পার্শ্ববর্তী এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাতে না ঢুকতে পারে, সে জন্য বিশেষ ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ। যদি আসে তাহলে প্রথমেই ওই রোগীকে আইসোলেশনে বা পৃথক রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, যাতে তার থেকে অন্যদের মধ্যে সংক্রমিত না হতে পারে। তাতে রোগ বিস্তার রোধ করা সম্ভব।

সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, ২০১৭ সাল থেকে ইন্টারন্যাশনাল হেলথ রেগুলেশনের অধীনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ৩৫ কোটি টাকা খরচ করেছে। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অভিজ্ঞতা অর্জন করতে বিদেশ সফর করেছেন। গেছেন ভারতের দিল্লি, থাইল্যান্ডের ব্যাংকক এবং আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে। ওই কর্মসূচিতে দেশের সব স্থল ও বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্যানার বসানোর কথা ছিল, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের কথা ছিল, নতুন নতুন রোগ নির্ণয়ের জন্য ল্যাবরেটরি স্থাপনের নির্দেশ ছিল, নতুন যন্ত্রপাতি কেনার কথাও ছিল। ৩৫ কোটি টাকা বাজেটে সেসবের কতটা হয়েছে তা অবশ্য আমাদের জানা নেই। তবে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে জানা গেল থার্মাল স্ক্যানারের অনেকগুলোই ছিল অকেজো। উল্লেখ্য, থার্মাল স্ক্যানারের ভেতর দিয়ে জ্বরের রোগী হেঁটে গেলে লাল সংকেত দেখা দেয়।

চীন চিকিৎসাব্যবস্থায় বাংলাদেশের চেয়ে বহু উন্নত। তারাও এই নতুন রোগ নিয়ে দুই-আড়াই মাস ধরে নাস্তানাবুদ হচ্ছে। এই রোগে রোগী বোঝার আগেই অর্থাৎ রোগ শনাক্ত হওয়ার আগেই জীবাণু ছড়াতে শুরু করে। অন্যান্য দেশে দেখা গেছে, একজন রোগী থেকে চার-পাঁচজন সংক্রমিত হয়েছে। আমাদের ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এখানে এই রোগের বিস্তার ঘটলে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। বহুসংখ্যক রোগীর সেবা দেওয়ার সক্ষমতা আমাদের সরকারি হাসপাতালগুলোর নেই। বেসরকারি হাসপাতালগুলো হয়তো আইসোলেশনের রোগী নেবেই না।

জটিল রোগীকে শুধু আইসোলেশনে দিলেই হবে না, তার উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য আইসিইউতে রাখতে হবে। ফুসফুসে আক্রান্ত রোগীকে অক্সিজেনসহ আধুনিক চিকিৎসা দিতে হবে। বড় সরকারি হাসপাতালগুলোতে সে ব্যবস্থা থাকলেও জেলার হাসপাতালে সে ব্যবস্থা অপ্রতুল।

রোগটি যেহেতু নতুন, সুতরাং রোগীকে যথাযথভাবে টেস্ট করার অভিজ্ঞতা আমাদের ডাক্তারদের থাকার কথা নয়। এখনো তাঁরা
যেভাবে রোগীকে পরীক্ষা করছেন তা কতটা নির্ভুল, তা বলা সম্ভব নয়। এখন আমেরিকাতেও প্রচলিত পদ্ধতিতে নয়, নতুনভাবে রোগীকে টেস্ট করা হচ্ছে। রোগীকে সঠিকভাবে শনাক্ত করাই জরুরি। তা না হলে উপযুক্ত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে না।

করোনাভাইরাসের মতো মারাত্মক সংক্রামক রোগীর চিকিৎসা ও সেবা যাঁরা দেবেন সেই সব ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য কর্মীর জীবনের নিরাপত্তা কে দেবে? তাঁদেরও মানুষের শরীর। রোগী থেকে তাঁরা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। পরিস্থিতি যদি জটিল আকার ধারণ করে, তাঁরা ডিউটি করতে চাইবেন না। চাকরির চেয়ে জীবন বাঁচানো জরুরি।

চীন কমিউনিস্ট পার্টি–শাসিত দেশ। জরুরি পরিস্থিতিতে বন্দুকের নলের মুখে ডাক্তার-নার্সদের দিয়ে ডিউটি করাতে পারত। তা সত্ত্বেও করোনাভাইরাসের রোগীদের চিকিৎসা দিতে যাঁদের নিযুক্ত করা হয়, তাঁদের বিশেষ প্রণোদনার কথা ঘোষণা করেছে। কোনো ডাক্তার, নার্স মারা গেলে তাঁদের সন্তানদের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর ব্যবস্থা করবে, পরিবারের সদস্যদের ভালো চাকরি দেবে ইত্যাদি। বিশেষ ভাতা তো আছেই।

চীনের উন্নত ব্যবস্থায় করোনাভাইরাসের রোগীদের চিকিৎসক ও সেবকদের যে উন্নত ধরনের বিশেষ ইউনিফর্ম বা কাপড়চোপড় দেওয়া হয়, তা আমাদের দেশে নেই। ওই ধরনের পোশাক বাংলাদেশে তৈরি হয় না। তা না হওয়ায় প্রয়োজনে সেসব কোন দেশ থেকে আমদানি করা হবে, তা সরকারের মাথায় আছে কি না জানি না। পেঁয়াজ আমদানি যত সহজ, তাতেও আমরা সফল হইনি, সংক্রামক রোগের চিকিৎসকদের ও নার্সদের বিশেষ পোশাক-আশাক দ্রুত আমদানিতে দক্ষতা দেখাতে পারব, সে ভরসা কম।

সব দেশেই পেশাজীবী হিসেবে চিকিৎসকদের সংগঠন রয়েছে। তবে দলাদলি ও বিভক্তি নেই। স্বাচিপ বা ড্যাব বলে কোনো কিছু অন্য দেশে নেই। দলীয় রাজনীতিতে সময় দেওয়ার চেয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন নৈতিক কর্তব্য—তার প্রমাণ আমরা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের থেকে খুব বেশি পাই না। দুই মাস যাবৎ করোনাভাইরাস নিয়ে এত আলোচনা ও লেখালেখি, বিএমএর নেতাদের এ ব্যাপারে কী করণীয় ছিল তা জানা যায়নি।

করোনাভাইরাস বাংলাদেশে ব্যাপক আকার ধারণ করেনি, তা সত্ত্বেও নানাভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত। মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের যেসব শ্রমিক যাবেন তাঁদের স্বাস্থ্য সার্টিফিকেট নিতে বলা হয়েছে। কুয়েত বলেছে, বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) থেকে এই সনদ নিতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ছাড়পত্র নেওয়া যে কী হয়রানির ব্যাপার, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না। কাতার, কুয়েত প্রভৃতি দেশে যাওয়ার শ্রমিকদের বিড়ম্বনার শেষ নেই।

ইবোলা ভাইরাস বা সার্স ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুহার অনেক বেশি। ইবোলায় ৩৫-৪০ ভাগ, সার্সেও ৩০ শতাংশের মতো। করোনায় ২ শতাংশের কম, কিন্তু দ্রুততম সময়ে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা তাই আতঙ্কিত না হয়ে সাবধানতার সঙ্গে চিকিৎসা গ্রহণের কথা বলেছেন। আমাদের মতো নাগরিকদের প্রত্যাশা, সরকার দেবে বিচক্ষণতার পরিচয় এবং জনগণ হবে দায়িত্ববান ও সচেতন। এই দুর্যোগে আর কোনো উপায় নেই।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক