মন্ত্রী ও উপদেষ্টা কতটা সঠিক বলেছেন?

৫ মার্চ একটি অর্থনৈতিক সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, তিনি ঋণের সুদের হার কমিয়েছেন, কারণ ২৮-৩০ শতাংশ সুদ দিয়ে শিল্প বাঁচতে পারছে না। তাঁর এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলব, বাংলাদেশের কোনো ব্যাংকে ঋণের ওপর ২৮-৩০ শতাংশ সুদের হার কখনো ছিল বলে শুনিনি। এখনো আছে বলে দেখছি না। মন্ত্রী মহোদয় এ তথ্য কোথায় পেলেন?

ব্যাংকের সুদের হারের বিষয়টি তো আন্দাজ বা অনুমানের বিষয় নয়। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি ব্যাংকের সুদের হার নির্দিষ্ট করে, তা কোন তারিখ থেকে কার্যকর হবে, সে তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হয়। এই তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকে সংরক্ষিত রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কি জানাতে পারবে, কোন ব্যাংকে কবে থেকে ঋণের ওপর ২৮-৩০ শতাংশ সুদ ধার্য ছিল, বা আছে? মন্ত্রী মহোদয় নিজেও কি এ তথ্য দিতে পারবেন? একটি যুক্তিহীন কাজের সারবত্তা প্রমাণের জন্য ভিত্তিহীন তথ্য পরিবেশন করা কতটা শোভনীয়?

একই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেছেন, উন্নয়ন হলে বৈষম্য বাড়বে। কথাটি কি ঠিক? আমরা যদি ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব সেখানকার প্রাচীন সভ্য এবং উন্নত (অর্থাৎ বৃহৎ জিডিপি এবং বিরাট অঙ্কের মাথাপিছু আয়) একটি দেশ হলো সুইডেন। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের অনেক আগে প্রথম কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সুইডেনে। নোবেল প্রাইজের প্রতিষ্ঠাতা হলো ব্যাংক অব সুইডেন। আলফ্রেড নোবেল সে দেশেরই একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। সাম্প্রতিক কালে পরিবেশ আন্দোলনের বহুল আলোচিত কিশোরী কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ এই সুইডেনেরই এক বালিকা। সুইডেন হলো সমতাভিত্তিক বড় উন্নয়নের মানবিক মডেল।

আয়বৈষম্য পরিমাপের জন্য জিনি সহগ অর্থনীতিবিদদের স্বীকৃত একটি পন্থা। সহগটি দশমিক তিনের ওপর-নিচে হলে মানুষের আয়বৈষম্য স্বাভাবিক। দশমিক চারের আশপাশে হলে মোটাদাগে সহনীয়। কিন্তু দশমিক পাঁচে পৌঁছালে চরম বৈষম্য নির্দেশ করে। উন্নত দেশ সুইডেনে জিনি সহগ দীর্ঘকাল যাবৎ দশমিক দুই নয় থেকে দশমিক তিন দুইয়ের মধ্যে ওঠানামা করছে। অর্থাৎ দেশটি সম্পদশালী হলেও সম্পদের বণ্টনব্যবস্থা সবার জন্য উপযোগী। অনেকে বলতে পারেন, সুইডেন একটি ব্যতিক্রম। না, তা নয়। সুইডেনের মতো নরওয়ে, ডেনমার্ক, নিউজিল্যান্ড, সুইজারল্যান্ডও একই ধাঁচের উন্নয়ন মডেল অনুসরণ করছে। এসব দেশের জিনি সহগ দশমিক তিন থেকে দশমিক চারের মধ্যে অবস্থান করে। জার্মানিও সহনীয় আয়বৈষম্যের দেশ। এসব দেশে উন্নয়ন অর্থ ‘জনগণের উন্নয়ন’। উন্নয়ন মানে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের ফুলে-ফেঁপে ওঠা নয়।

ইউরোপের অধিকাংশ দেশই এখন আধুনিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি অনুসরণ করে, যার আরেক নাম হলো ‘ওয়েলফেয়ার ইকোনমি’ বা কল্যাণ অর্থনীতি। বাংলাদেশের সংবিধানে কল্যাণ অর্থনীতি অর্থে সমাজতন্ত্র সন্নিবেশিত। কমিউনিস্ট অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের সম্পদ শুধু রাষ্ট্রের কাছে থাকে। নাগরিকদের শুধু ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রের সম্পদ ব্যক্তি, রাষ্ট্র ও সমবায় অর্থাৎ তিন খাতে রাখার বিধান হয়েছে। অতএব বাংলাদেশের সমাজতন্ত্র কল্যাণ অর্থনীতির নির্দেশ করে। কল্যাণ অর্থনীতির প্রধান নির্দেশক হলো নাগরিকদের আয়-সম্পদবৈষম্যের সহনীয় অবস্থান অর্থাৎ জিনি সহগ দশমিক চারের আশপাশে থাকা। কিন্তু বাংলাদেশ এখন জিনি সহগ প্রায় দশমিক পাঁচ, যা চরম বৈষম্য নির্দেশ করে। এ ধরনের চরম বৈষম্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, সংবিধানবিরোধী এবং বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক নীতিবিরোধী। সালমান সাহেবরা চরম বৈষম্য সমর্থন করছেন। বুঝহে সে জন, যে জন জানো হে সন্ধান।

কথায় কথা আসে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, চরম বৈষম্য থেকে উত্তরণের উপায় কী? বঙ্গবন্ধুর কল্যাণ অর্থনীতিতে প্রত্যাবর্তনের পথ কী? উপায় সুইডেনকে অনুসরণ করা। সরকারের সেই সক্ষমতা নেই। অন্তত ভারতকে অনুসরণ করলেও কিছুটা অগ্রসর হওয়া সম্ভব। সুনির্দিষ্ট একটি সুপারিশ রাখছি।

বাংলাদেশে বাৎসরিক আয় আড়াই লাখ টাকা হলেই আয়কর দিতে হয়। অথচ বাংলাদেশের চেয়ে কম প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও ভারতে পাঁচ লাখ রুপি (অর্থাৎ ছয় লাখ টাকা) আয় না হলে আয়কর দিতে হয় না। বাংলাদেশ ও ভারতে দারিদ্র্য মোটামুটি একই পর্যায়ের। ভারত মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের নাগরিকদের আয়করমুক্ত রেখে ধনীদের কর ধার্য করছে এবং সেই টাকায় রাষ্ট্র চালাচ্ছে। বিপরীতে বাংলাদেশ গরিব মেরে আয়কর ধার্য করছে এবং গরিবের টাকায় সামরিক-বেসামরিক সব খরচ চালাচ্ছে। প্রণিধানযোগ্য, ভারতে পাঁচ লাখ রুপি পর্যন্ত আয়কর মওকুফ করা সত্ত্বেও ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত ২০; অথচ বাংলাদেশে মাত্র আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত আয়কর মুক্ত রাখার পর ও কর জিডিপি অনুপাত দশের নিচে।

এর সাদামাটা অর্থ হলো, বাংলাদেশের ধনীচক্র ট্যাক্স দেয় না অথবা ফকিরকে ভিক্ষা দেওয়ার মতো নামকাওয়াস্তে সামান্য কিছু প্রদান করে। দেশ চালানোর জন্য গরিব মেরে কর আদায় করা হয়। প্রস্তাব থাকবে, ভারতের মতো বা অন্তত পাঁচ লাখ টাকা বার্ষিক আয়কে করমুক্ত রাখা হোক। সেই সঙ্গে অর্থশালী লোকদের কাছ থেকে কর আদায়ে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে, যাতে করে কর জিডিপি অনুপাত অন্তত কুড়িতে উন্নীত হয়।

সালমান এফ রহমান আরেকটি ধোঁয়াশা কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, কর ছাড় প্রদানের জন্য বাংলাদেশের কর জিডিপি অনুপাত কম। সব দেশেই কিছু কর ছাড় থাকে। ভারতে তো বাংলাদেশি টাকার মূল্যমানে ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত আয়কর মুক্ত। এত বড় ছাড় তো আমাদের দেশে নেই। তা ছাড়া, শিল্পায়নের যে কর ছাড় দেওয়া হয়, ভারতে তার চেয়ে বরং বেশিই রয়েছে। কাজেই সালমান সাহেবের বক্তব্যও তথ্যনির্ভর নয়।

সবশেষে, বিস্মিত হয়েছি অর্থনৈতিক সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের বক্তব্যে। তিনি ভারতের উদাহরণ টেনে বলেছেন, বাংলাদেশে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ তেমন বেশি নয়। তিনি শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া বা ফিলিপাইনের সঙ্গে তুলনা না করে শুধু ভারতের উদাহরণ দিলেন কেন? ভারত ডুবেছে বলে কি বাংলাদেশকেও ডোবাতে হবে?

রাজনীতিকেরা অনেক কথাই বলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের কি এমন সাফাই বক্তব্য শোভা পায়? পৃথিবীর কোনো দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নররা এ ধরনের মেঠো বক্তব্য দেন না। গভর্নরের বক্তব্য হওয়া উচিত সরকারকে সতর্ক করার জন্য; তোষামোদ করার জন্য নয়।

আমরা আশা করব, যাঁরা সরকারের নীতিনির্ধারক, তাঁরা জনগণকে সঠিক তথ্যটিই দেবেন।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর