করোনা মোকাবিলায় ট্রাম্পই বড় বাধা

একজন শিক্ষক হিসেবে আমি সব সময়ই ‘শিক্ষাদানের উপযোগী মওকা’ খুঁজি। আমি আমার লেকচারের মধ্যে চলমান ঘটনাবলি থেকে এমন কোনো বিষয়কে তুলে আনতে চাই, যে বিষয়টি নিজেই আমাকে তার বিষয়ে বলার জন্য প্ররোচিত করতে থাকে। এ মুহূর্তে মারি-মড়কের চেয়ে সেই ধরনের দৃষ্টি আকর্ষক বিষয় আর নেই। 

কোভিড-১৯ সংকট এই মুহূর্তে সবার জন্য, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুবই শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে রাখা দরকার, ভাইরাসের কোনো ভিসা পাসপোর্ট লাগে না, সে কোনো সীমান্ত চেনে না, সে কোনো জাতীয়তাবাদী ভাষণও মানে না। আজকের এই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ সূত্রে গাঁথা পৃথিবীতে যেকোনো দেশে একটি রোগের উৎপত্তি হওয়ার পর তা খুব দ্রুত অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এটিকে বিশ্বায়নের নেতিবাচক দিকগুলোর একটি বলে ধরা যেতে পারে। 

সীমান্ত অতিক্রম করতে সক্ষম কোনো সংকটের উদ্ভব যখনই হয়, তখনই সেটি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটের মতো বৈশ্বিক বিষয় হয়ে ওঠে এবং তা মোকাবিলার জন্য সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

ভাইরাসের মতোই গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বৈশ্বিক সংকট তৈরি করেছে। উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় বহু দেশকে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ খরচ করে যেতে হচ্ছে। 

বিভিন্ন দেশের এক হয়ে বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলার আন্তর্জাতিক চেষ্টাকে ট্রাম্প প্রশাসনের মতো আগেকার কোনো মার্কিন প্রশাসন খাটো করে দেখেনি। তারপরও মহামারি বা ঘূর্ণিঝড়ের মতো সংকটের মুখে পড়লে আমরা ট্রাম্প সরকারের মুখের দিকেই চেয়ে থাকি। কারণ, আমরা জানি, এ ধরনের সংকট মোকাবিলা করতে গেলে সব দেশের সমন্বিত উদ্যোগ দরকার হয়। কারণ, বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভর করে এ ধরনের সংকট সামাল দেওয়া সম্ভব হয় না।

অদ্ভুত ব্যাপার হলো, মুনাফা অর্জনকেই চূড়ান্ত বিষয় হিসেবে মনে করা প্রতিষ্ঠানগুলো এই সব মহাসংকটকেও তাদের মুনাফা বাড়ানোর সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। সর্বশেষ ঘটনায় আমরা করোনাভাইরাসের সংক্রমণকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে ফেস মাস্কের অস্বাভাবিক দাম বাড়া দেখলাম।

‘আমাদের সমস্যার সমাধান সরকার নয়, বরং সরকার নিজেই একটি সমস্যা’—মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের আমল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে এই মন্ত্র জপ করে যাওয়া হচ্ছে। এই মন্ত্র ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে যতটা পোক্ত হয়েছে, তা আগের যেকোনো আমলের তুলনায় বেশি মজবুত।

আমেরিকায় কোভিড–১৯ আক্রমণ চালানোর পর ভাইরাসটি মোকাবিলায় দেশটির সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও ঝানু বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরিচালিত প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসিপি) অসহায়ত্ব দেখা যাচ্ছে। এসব বিশেষজ্ঞ হঠাৎ করে রাজনীতিতে আসা ট্রাম্পের জন্য সাংঘাতিক সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছেন। কারণ, ট্রাম্প যখনই তাঁর নিজের স্বার্থে কোনো উদ্যোগ নিতে যাবেন, তখনই তাঁরা তাঁর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা শুরু করবেন। 

কোভিড-১৯ হানা দেওয়ার পর খুবই দ্রুততার সঙ্গে বিজ্ঞানীরা তাকে শনাক্ত করতে পেরেছেন এবং এখন এর প্রতিষেধক বানানোর চেষ্টা চলছে। গবেষকেরা যদি এত তাড়াতাড়ি ভাইরাসটিকে শনাক্ত করতে এবং এর সম্পর্কে জানাতে না পারতেন, তাহলে বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক আরও ছড়িয়ে পড়ত।

এ ধরনের গবেষণার জন্য প্রচুর অর্থের দরকার হয়। কিন্তু আমাদের ট্রাম্প প্রশাসন ও ট্রাম্পের মালিকানাধীন বড় বড় করপোরেশন এই খাতে খরচ করতে চায় না। গবেষণা খাতে আমেরিকার বরাদ্দ ক্রমেই কমে আসছে। 

ট্রাম্প প্রশাসন এই খাতে বরাদ্দ ২০১৮ সালে ১০ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে ১৯ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। সবচেয়ে ভয়ের কথা হলো, এ বছরের শুরুতেই সংক্রামক ব্যাধি মোকাবিলা খাতে ২০ শতাংশ বরাদ্দ কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। 

অবাক হওয়ার কিছু নেই, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তুতি পর্যাপ্ত নয়। যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড-১৯–এর আগমন ঘটেছে কয়েক সপ্তাহ আগেই। কিন্তু এরপরও এখনো দেশটির অনেক জায়গায় ভাইরাসটি শনাক্ত করার পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি নেই। বিদেশ থেকে আসা লোকজনকে ঠিকমতো পরীক্ষা–নিরীক্ষা করার প্রক্রিয়াও যথাযথভাবে সম্পন্ন হচ্ছে না বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। 

সংক্রমণ মোকাবিলায় ট্রাম্প প্রশাসন বরাদ্দ কমিয়ে যে অর্থ সাশ্রয়ের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তার চেয়ে বহুগুণ আর্থিক ক্ষতি হয়ে যাবে। বড় বড় সাপ্লাই চেইনে ব্যাঘাত ঘটা শুরু করেছে। এতে কোটি কোটি ডলারের ক্ষতি হচ্ছে। 

এই ভাইরাসের সংক্রমণে যুক্তরাষ্ট্র কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। এই সংক্রমণ দেশটিতে কী মাত্রায় বিস্তার লাভ করবে, তার ওপর এটি নির্ভর করবে। বহু লোকের স্বাস্থ্যবিমা না থাকায় তারা স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসার বিষয়ে উদাসীন আছে। ট্রাম্পের আমলে মৃত্যুহার বেড়েছে এবং ৩ কোটি ৭০ লাখ লোককে নিয়মিত ক্ষুধা নিবারণের জন্য রীতিমতো লড়াই করতে হচ্ছে।

কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে ট্রাম্প বা তাঁর প্রশাসনকে তেমন একটা গা করতে দেখা যাচ্ছে না। অথচ সরকারভিত্তিক গবেষণা ছাড়া এ ধরনের মহামারি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এখন একটা আশা আছে, সেটি হলো, এখনো আমেরিকায় কিছু নিবেদিতপ্রাণ আমলা ও বিজ্ঞানী সরকারের মধ্যে আছেন, যাঁরা হয়তো আমাদের ট্রাম্প এবং করোনা থেকে উদ্ধার করতে পারেন। 

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জোসেফ ই. স্টিগলিৎস নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক