আমি যতটা সঠিক কথা বলেছি

সালমান এফ রহমান। ছবি: সংগৃহীত
সালমান এফ রহমান। ছবি: সংগৃহীত

৫ মার্চ আমি বণিক বার্তা আয়োজিত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে উপস্থিত ছিলাম। ওই অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও আমার বক্তব্যের সূত্র ধরে ১১ মার্চ প্রথম আলো পত্রিকায় খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ‘মন্ত্রী ও উপদেষ্টা কতটা সঠিক বলেছেন?’ শীর্ষক একটি মতামত প্রবন্ধ লিখেছেন। আমি মনে করি, তিনি আমার বক্তব্যের খণ্ডিতাংশ প্রসঙ্গ–বহির্ভূতভাবে উল্লেখ করে মনের মতো করে ব্যাখ্যা করেছেন।

তিনি লিখেছেন, ‘...সালমান এফ রহমান বলেছেন, উন্নয়ন হলে বৈষম্য বাড়বে।’ শ্রদ্ধেয় ইব্রাহিম খালেদ যেভাবে আমার পুরো বক্তব্যের সারাংশ একটিমাত্র বাক্যে প্রকাশ করেছেন, তা নিয়ে বিভ্রান্তির অবকাশ রয়ে যায়। আমি বলেছিলাম, ‘বলা হচ্ছে যে [বাংলাদেশের] প্রবৃদ্ধি অসম। আমার কথা হলো, যেই দেশেই প্রবৃদ্ধি হবে, উন্নত দেশ হোক আর উন্নয়নশীল দেশ হোক, অসমতা থাকবেই। অসমতা বা বৈষম্য মূলত প্রবৃদ্ধির স্বাভাবিক ধর্ম। আপনি যদি চান, বৈষম্য ছাড়া প্রবৃদ্ধি হবে, এটা কিন্তু সম্ভব না। আপনাকে দেখতে হবে যে নিম্ন পর্যায়ে বৈষম্য ভালোর দিকে যাচ্ছে কি না। আর এ ক্ষেত্রে আপনারাই তো স্বীকার করেছেন যে দারিদ্র্যের হার কমেছে।’

ইব্রাহিম খালেদ এ বিষয়ে অবতারণা করতে গিয়ে সুইডেন নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। পুরো লেখা পড়ে মনে হলো, তিনি বলতে চেয়েছেন যে বাংলাদেশ উন্নয়ন করছে—এই কথা বলতে হলে বাংলাদেশকে আগে সুইডেন বানিয়ে দেখাতে হবে। সন্দেহ নেই যে আমাদের কাছ থেকে জনাব খালেদের প্রত্যাশার পারদ একটু আকাশচুম্বী। তারপরও তাঁর কিছু কথা নিয়ে কৌতুক বোধ না করে পারা গেল না।

তিনি সুইডেন ও বাংলাদেশের আয়বৈষম্য পরিমাপ করতে জিনি সহগের কথা বলেছেন। বলেছেন এই সহগে সুইডেনের অবস্থান ০.৩-এর আশপাশে, বাংলাদেশের ০.৫-এর কাছাকাছি। প্রথমত, আয়বৈষম্য পরিমাপের কোনো সর্বজনস্বীকৃত মানদণ্ড নেই। জিনি সহগের বড় দুর্বলতা হলো, এটি কেবল সামগ্রিক চিত্র পরিমাপের মানদণ্ড; জনসংখ্যার কোনো বিশেষ শ্রেণির (ধনী হোক বা দরিদ্র) জীবনের উন্নয়ন বা অবনমনের চিত্র এখানে ফুটে ওঠে না। ফলে জিনি সহগে আমাদের অবস্থান যদি আমি মেনেও নিই, তাহলেও আমার বক্তব্য ভুল প্রমাণিত হয় না। আমি বলেছি, উত্তরবঙ্গে এখন আর মঙ্গা দেখা যায় না। দেশে দারিদ্র্য কমেছে। নিম্ন আয়ের মানুষ হয়তো ধনী বা মধ্যবিত্তদের মতো দ্রুতহারে জীবনমান উন্নত করতে পারেনি। কিন্তু তাদের অবস্থা যে অতীতের চেয়ে ভালো, তা বোঝা যায় বাংলাদেশের অভাবনীয় দারিদ্র্য হ্রাসের পরিসংখ্যান থেকে।

শ্রদ্ধেয় খালেদ নিজেই স্বীকার করেছেন যে সুইডেনকে ব্যতিক্রম মনে হতে পারে। এ কথা বলেই তিনি আরও গোটা কয়েক স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ ও নিউজিল্যান্ডের উদাহরণ টেনে আনলেন! আমার সমালোচনার জন্য তাঁকে এত দূরে যেতে হলো ভেবে দুঃখ লাগছে। তবে আশপাশের দেশগুলোর দিকে যদি একটু তাকাতেন, তাহলে হয়তো কিছুটা ভিন্ন চিত্র দেখতে পেতেন। ইব্রাহিম খালেদ কোনো তথ্যসূত্র উদ্ধৃত করেননি। ধরে নিচ্ছি তিনি বহুল-ব্যবহৃত অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) উপাত্ত ব্যবহার করেছেন। অপরদিকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হয়তো বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) উপাত্ত ব্যবহার করেছেন, কেননা ওইসিডি বাংলাদেশ নিয়ে উপাত্ত প্রকাশ করে না। তা ছাড়া, বিবিএস–এর বিভিন্ন পরিসংখ্যান অপছন্দ করলেও বৈষম্যের পরিসংখ্যান জনাব খালেদদের মতো অনেকের কাছে খুবই প্রিয়।

ওইসিডি আয়কর হিসাবের আগে ও পরে দুই ধরনের জিনি সহগ পরিমাপ করে। আয়কর ধরা না হলে, বেশির ভাগ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ও ইউরোপিয়ান দেশের জিনি সহগ ০.৫-এর কাছাকাছি বা বেশি। তৎক্ষণাৎ নিশ্চিত হতে পারিনি যে বিবিএস–এর জিনি সহগের হিসাবে আয়কর ধরা হয়েছে কি না। তাই আমি বিশ্বব্যাংকের ‘বিশ্ব উন্নয়ন নির্দেশক’ সংগ্রহ করেছি, যেখানে জিনি সহগ দিয়ে একই মানদণ্ডে (১-১০০-এর স্কেল) সব দেশের আয়বৈষম্য পরিমাপ করা হয়েছে। এতে দেখা যায় যে জিনি সহগ অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সবকটি দেশ ও মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, থাইল্যান্ডের মতো উন্নয়নশীল দেশ এবং যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার মতো উন্নত দেশের চেয়ে আমাদের দেশে আয়বৈষম্য কম।

সুইডেন এখন অনেক পরিণত অর্থনীতির দেশ। ফলে সেখানে প্রবৃদ্ধির হার কম। দেশটি আমাদের মতো বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মতো প্রবৃদ্ধির হার বাড়িয়ে উন্নত হয়নি। নয়তো উন্নয়নশীল অবস্থায় সুইডেনের প্রবৃদ্ধি ও বৈষম্যের হিসাব কষে বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করা যেত। কিন্তু সম্প্রতি যেসব দেশেরই প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৈষম্য বেড়েছে। একে প্রবৃদ্ধির একধরনের বৈশিষ্ট্য বলা যেতে পারে। ফরাসি বামপন্থী অর্থনীতিবিদ থমাস পিকেটি তাঁর আলোড়ন সৃষ্টি করা বই ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরিতে ১০০ বছরের অর্থনৈতিক উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, উন্নত দেশগুলোতেও বৈষম্য স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ছিল। তিনি দেখিয়েছেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় প্রায় একই হারে আয়বৈষম্য কমেছে ও বেড়েছে। ১৯১০-১৯৭০/৮০ পর্যন্ত বৈষম্য কমেছে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত কেবল বাড়ছেই। পিকেটি বলেছেন, এই বৈষম্য আবার কমবেও।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বৈষম্য বাড়তে পারে বলে কি আমরা প্রবৃদ্ধি বাড়াতে চাইব না? বিশ্বব্যাংকের ২০১৩ সালের সর্বশেষ উপাত্ত অনুযায়ী, আফগানিস্তান (২৭.৮) ও সুইডেনের (২৫) আয়বৈষম্যের পার্থক্য অনেক কম। খালেদ সাহেবদের কাছে কি তাহলে বাংলাদেশের চেয়ে আফগানিস্তানের উন্নয়নই বেশি আকাঙ্ক্ষিত? আবার ২০১০-২০১৬ সালে আমাদের জিনি সহগ বেড়েছে ০.৩ (৩১.১ থেকে ৩১.৪)। অপরদিকে ২০১০-২০১৫ সালে সুইডেনের জিনি সহগ বেড়েছে ১.৫ (২৭.৭ থেকে ২৯.২)। সুতরাং, কোন দেশে বেশি হারে আয়বৈষম্য বাড়ছে?  ইব্রাহিম খালেদ বারবার ভারতের উদাহরণ দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯০-২০১৬ পর্যন্ত ভারতের আয়বৈষম্য বাংলাদেশের চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে। এসবই সর্বশেষ উপলভ্য উপাত্ত।

শ্রদ্ধেয় খালেদ এরপর লিখেছেন, ‘সালমান এফ রহমান আরেকটি ধোঁয়াশা কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, কর ছাড় প্রদানের জন্য বাংলাদেশের কর জিডিপি অনুপাত কম।’ প্রথমত, আমাদের আয়কর-জিডিপি অনুপাত যে কম, তা আমরা স্বীকার করি। আমি ওই অনুষ্ঠানেই বলেছি যে এটি আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। দ্বিতীয়ত, আমি ওই কথা বলিনি। আমার আগে মাননীয় অর্থমন্ত্রী বলেছেন যে বাংলাদেশে এখন অসংখ্য মেগা উন্নয়ন প্রকল্প হচ্ছে। এসব প্রকল্প দ্রুত শেষ করার জন্য আমরা কর ছাড় দিয়েছি। না হলে আমাদের কর-জিডিপি হার আরও বাড়ত। আমি এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেছি যে এই কর ছাড় দেওয়া প্রয়োজনও ছিল। নয়তো এসব বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে যেত। কর নিলে হয়তো কর-জিডিপি হার বাড়ত, কিন্তু নিট কর সংগ্রহ কমই রয়ে যেত। এ জন্য আমি আয়কর জালে আরও বেশি মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করার ওপর গুরুত্ব দিতে বলেছি।

ইব্রাহিম খালেদ জবাবে ভারতের উদাহরণ টেনে বলেছেন, ভারতে ৫ লাখ রুপি পর্যন্ত আয়কর ছাড় দেওয়া হয়। প্রথমত, ভারতে এখন বাংলাদেশের মতো বাৎসরিক ২.৫ লাখ রুপির বেশি আয়ের ওপর ৫ শতাংশ করারোপ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, তিনি বলেছেন আয়করসীমা কমাতে। তিনি কি জানেন যে ডেনমার্কের মতো দেশে জাতীয় গড় আয়ের ১.৩ গুণ যাঁরা আয় করেন, তাঁদের ওপর ৫৫.৯ শতাংশ কর আরোপ করা হয়? অর্থাৎ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২ লাখ ১৫ হাজার টাকা যাঁদের বার্ষিক আয়, তাঁদের ওপর ৫৫.৯ শতাংশ করের কথা কি তিনি ভাবতে পারেন? তৃতীয়ত, তিনি বলেছেন, ভারত বাংলাদেশের চেয়ে শিল্পায়নে বেশি কর ছাড় দেয়। এই তথ্যের সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে আমি শিল্পায়নে কর ছাড়ের কথা বলিনি। অর্থমন্ত্রী মূলত বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পের কথা বলেছিলেন। চতুর্থত, তিনি বলেছেন, ভারতের কর-জিডিপি হার ২০ শতাংশ, আর বাংলাদেশের নিচে। প্রকৃতপক্ষে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভারতের কর-জিডিপি হার ছিল ১০.৯ শতাংশ!

আমাদের কাছে জনাব খালেদ ‘সঠিক তথ্য’ চেয়েছেন। এই প্রত্যাশা অবশ্যই যৌক্তিক। কিন্তু তিনি নিজে কি সঠিক তথ্য ও চিত্র তুলে ধরেছেন? আমরা সমালোচনা অপছন্দ করি না। কিন্তু কেবল সমালোচনা করতে হবে, সে জন্য সমালোচনা করাটাও অনভিপ্রেত। আমরা আশা করব যে বাংলাদেশের অগ্রগতির যথার্থ স্বীকৃতি দিতে কেউ কার্পণ্য করবেন না। উন্নত দেশে এখনো পরিণত হতে পারিনি বলে এই উন্নয়ন কোনো উন্নয়নই নয়, এই ধরনের বক্তব্য অত্যন্ত ক্ষুদ্র মানসিকতার পরিচায়ক। অবশ্য আমি মনে করি, সমালোচনার জন্য হলেও আমাদের সঙ্গে যখন সুইডেন বা উন্নত দেশের তুলনা করা হয়, তখন এটি প্রকারান্তরে আমাদের সাফল্যেরই স্বীকৃতি।

সালমান ফজলুর রহমান: সংসদ সদস্য ও  প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা