বিমূঢ় হয়ে গেছে বিলাত

কোভিড-১৯ ভাইরাসের জন্য সারাক্ষণই ব্রিটিশ সরকার বলছে, দরকার না হলে বাড়ি থেকে বেরিয়ো না। ছবি: রয়টার্স
কোভিড-১৯ ভাইরাসের জন্য সারাক্ষণই ব্রিটিশ সরকার বলছে, দরকার না হলে বাড়ি থেকে বেরিয়ো না। ছবি: রয়টার্স

বিলাত থেকে বিলাতি হ্যান্ডশেক উঠে গেছে। আলিঙ্গন, ঠোঁটে চুম্বন, গালে চুম্বন, কাঁধে ঝুঁকে থাকা, হাতে হাত আংটার মতো আটকে রাখা, আলতো করে গালের পাশে স্পর্শ করা, সব বন্ধ হয়ে গেছে। লন্ডনের রাস্তায় আমি আর মানুষের স্বাভাবিক শুভেচ্ছা, ভালোবাসার শারীরিক প্রকাশ দেখতে পাচ্ছি না। আমি নিজেও কারও করমর্দন করছি না। চেনা কাউকে দেখলে কাছে না গিয়ে দূর থেকে বলছি হাই এবং সে–ও তাই করছে। এতে কেউ অপমানিত হচ্ছে না, বরং খুশি হচ্ছে। এ নিয়ে রেডিও–টিভিতে কমেডি–কৌতুক হচ্ছে, ই–মেইল বিনিময়ে ভিডিও ক্লিপ পাঠাচ্ছে, টেলিফোনে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা নিয়ে লেকচার হচ্ছে। কিন্তু মজার কথা হলো, তার কিছু বিকল্পও বেরিয়ে গেছে। এখন সেটাই চলছে এবং এ নিয়ে পরে বলছি।

আগে বলি আজ আমি সাবান জলে হাত ধুতে ধুতে কী ভাবছি। ভাবছি আগামীকালের মিটিংয়ে যাব কি না। ভাবছি, সঙ্গে করে হাত মোছার অ্যালকোহলিক ওয়াইপ নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে সত্যি সত্যি একাত্তরের যুদ্ধের সময় যেভাবে চাল, ডাল, আলু, লবণ ও তেল কিনে সঞ্চয় করব কি না। ই-মেইলে নরউইচের আগামী অনুবাদ আসরটা বাতিল করব কি না। মুশকিল হলো, আমাদের এই ফ্রিল্যান্সারদের। কাজ না করলে ফিও পাব না।

আমার পুত্র সজীব কাজ শেষে নিউইয়র্ক থেকে ফেরার পথে প্লেনের ভেতরের ছবি পাঠিয়েছে—সে এবং আরেকজন মানুষ ছাড়া পুরো বিজনেস ক্লাস খালি। যুক্তরাষ্ট্রে এখন জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। সেন্ট্রাল লন্ডনে অল্ডগেটে ও লিভারপুলের মাঝামাঝি স্থানে এক আত্মীয়ের অফিস। সে আন্ডারগ্রাউন্ডে মানুষ চলাচলের সবচেয়ে ব্যস্ততম অফিস সময় সকাল সাড়ে আটটায় ছবি পাঠিয়েছে। দেখে মনে হলো সায়েন্স ফিকশনের বিরান কোনো স্টেশনের ছবি দেখছি।

হাত ধুয়ে খাব বলে কাঁটাচামচ বের করেছি। ঠিক এ সময় ঠোঁটের কাছাকাছি, মুখে একটু চুলকানোর দরকার হলো। কিন্তু চুলকালাম না। উসখুস করতে করতেই জাম্পারের হাতা দিয়ে সে জায়গাটা ডলে দিলাম। কিন্তু দিয়েই মনে হলো, এই জাম্পারটা না পরে আজ ভোরে টেস্কো সুপার মার্কেটে গিয়েছিলাম! দৌড় দৌড় জাম্পার খোল। এ সময় নিজেকে ভরসা দিই আমার হাতের মুঠোয় ময়নামতির মতো এক টুকরা অ্যালকোহল–বেইজড ভেজা টিস্যু পেপার তো ছিলই। টেস্কোতে স্বয়ংক্রিয় দরজা দিয়ে প্রবেশ করেছি বলে দরজায় হাত দিতে হয়নি। আর প্রবেশ করেই শপিং বাস্কেটের হাতল মুছে নিয়েছি। আমার হাতে শীতে পরার চামড়ার গ্লাভস। সুতরাং আমি নিরাপদ ছিলাম। তা ছাড়া আমাদের দালানের অভ্যর্থনা ডেস্কের কর্মী আগেই আমাকে বুদ্ধি দিয়েছিলেন, এখন তোমার ছেলেমেয়ে, নাতনি কেউ লন্ডনে নেই। কী এমন বাজার লাগবে যে একা খেতে পারবে না? ঘরে যা আছে, তাই খেয়ে বাঁচো। আর যদি যেতেই হয়, তবে দোকান খোলার সঙ্গে সঙ্গে সকাল আটটায় চলে যাও। আমি ভাবলাম, ক্যানের ভারি বুদ্ধি তো! লন্ডনের মানুষ অত সকাল বাজারে আসবে না। ভিড় কম থাকবে। শুনে ক্যান বলল, আর দোকান পরিষ্কার করে খুললে প্রথম দিকের কাস্টমার হবে।

যে হাউজিংয়ে থাকি তার কর্তৃপক্ষ চিঠি দিয়েছে, দুজন ইতালিফেরতকে ১৪ দিনের মতো ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। এখানেই নার্স এসে দেখে যাচ্ছেন। আমি আসলে সেই গ্রুপের, যারা করোনায় সহজেই মরে যেতে পারি। ষাটের ওপরের মানুষের জন্য যা ভয়ংকর, এর নিচের সবার কাছে তা ফ্লু ব্যাপারটা মুজতবা আলীর কথা স্মরণ করাল—ওষুধ খেলে সাত দিন, আর না খেলে এক সপ্তাহ। তো বিলাতে ভাইরাস যে কদিন থাকার থাকবে। বলা হচ্ছে, ৭০ শতাংশ লোক আক্রান্ত হবে। বুড়োরা মরে সাফ হয়ে যাবে। তবে তাঁদের মধ্যে যাঁরা অন্যান্য নানা অসুখে কাবু, তাঁদেরই করোনা কামড়ে ধরে জোরে। সুতরাং সরকার যদি চৈনিকদের মতো শক্তভাবে এক্ষুনি ঘরে ঢুকিয়ে দিতে পারত, তাহলে হয়তো তিন সপ্তাহে আমাদের দুর্যোগ কেটে যেত।

কোভিড-১৯ ভাইরাসের জন্য সারাক্ষণই ব্রিটিশ সরকার বলছে, দরকার না হলে বাড়ি থেকে বেরিয়ো না। এই কোরো না, ওই কোরো না, না হলে হয়ে যাবে করোনা। আর করবে না কেন, যখন স্বয়ং পিএম এমন করে ভয় পাইয়ে দেন। কথা কি জানেন, বিলাতের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন নামের এই লোকটা আসলেই কথা বলতে জানেন না। করোনার শেষ আপডেট হচ্ছে—কানাডার প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী লন্ডন থেকে করোনাভাইরাস নিয়ে ফিরেছেন এবং তার জন্য স্বামী-স্ত্রী দুজনেই গৃহবন্দী হয়েছেন। ব্রিটেনে এ যাবৎ মৃত্যু হয়েছে ৮ জনের, আর সংক্রমণ হয়েছে ৪৬০ জনের। আর্সেনাল ফুটবল ক্লাবের ম্যানেজার ও একজন খেলোয়াড় করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। এপ্রিল পর্যন্ত সব প্রিমিয়ার লিগ ফুটবল বাতিল করা হয়েছে। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ ইতালির সব ফ্লাইট বাতিল করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপের সব দেশ যাঁদের ভিসাবহির্ভূত আসা-যাওয়া আছে, তাঁদের আমেরিকায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। এর সবই আতঙ্কিত হওয়ার মতো সংবাদ। এ সময় কোথায় তিনি সাহস জোগাবেন, তা না করে উপরন্তু আমাদের আরও দুর্বল করে দিলেন। দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দিতে এসে উষ্কখুষ্ক চুলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গম্ভীর মুখে বললেন, ব্রিটেনের ইতিহাসে বহু প্রজন্মের মধ্যে এমন মহামারি হয়নি। দুঃখজনক হলেও অনেককেই তাঁদের প্রিয়জনকে চলে যাওয়ার সময়ের আগেই হারাতে হবে। বুঝুন কেমন লাগে! আর তারপর থেকে বারবার তাঁর সেই ভয়াবহ বাণীই বিভিন্ন গণমাধ্যমে সব সংবাদে চালাচ্ছে।

আমি সেদিন নিউক্রসে আমার ওয়ার্কশপে গিয়ে দেখি টাকা দিয়ে ইভেন ব্রাইটের মাধ্যমে বুকিং থাকলেও অর্ধেক কবি–সাহিত্যিক আসেননি। এমনিতেই অনুবাদ কর্মশালার স্থান মাত্র ১২ জনের। তো সে ছয়জনকেই হ্যালো করলাম হেলতে হেলতে। সবাই সবার সামনের জায়গা ওয়েট ওয়াইপ দিয়ে মুছলাম। কফি কাপ ধরলাম হাতল মুছে। টেবিলে আঙুর পড়ে আছে, বিস্কুট পড়ে আছে ছুঁলামও না। আগে তো বাঁচি। আর যাওয়ার সময় তরুণেরা হ্যান্ডশেকের বদলে লেগশেক করল, কনুইয়ে কনুইয়ে মোলাকাত করাল। আর বেরিয়ে যাওয়ার আগে আমাকে ছুড়ে দিল উড়ন্ত চুমু!

মানুষের ভালোবাসা কি ঠেকিয়ে রাখা যায়? যেসব স্কুল বন্ধ অথচ মা–বাবাদের অফিস খোলা, সেই মা–বাবার বাচ্চাদের লেখা–শোনা করছেন ওই বুড়োরাই।

শামীম আজাদ: কবি। লন্ডন থেকে