করোনা, আমাদের একটু সভ্য করো না!

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকাকালীন আমার এক রুমমেট বাইরে থেকে রুমে ঢুকে শাড়ি বদল করে (তখন আমরা বেশির ভাগই শাড়ি পরতাম) প্রথমেই শাড়ির নিচের পাড়ের অংশ ধুয়ে মেলে দিত। কেন? না, সে ছিল একটু শুচিবায়ুগ্রস্ত। থুতু, কফ, প্রস্রাব, ময়লায় সয়লাব রাস্তাঘাটে শাড়ি পরে বেড়িয়ে এসে তার নাকি গা ঘিনঘিন করত। রাস্তাঘাটের চিত্র তিন-চার দশক আগে যা ছিল, এখনো অবিকল তা-ই আছে। শাড়ির প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখিয়ে যাঁরা সালোয়ার-কামিজ বা জিনস পরিহিতাদের বাঙালি সংস্কৃতির শত্রু মনে করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে বিষয়টি নিয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে।

করোনাভাইরাস বিশ্বকে তোলপাড় করে দিচ্ছে। একেক দিন একেক বয়ান আসছে বিভিন্ন দেশের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো থেকে। একদিন শোনা যাচ্ছে মাস্ক অপরিহার্য তো আরেক দিন বলা হচ্ছে, মাস্ক ভাইরাস প্রতিরোধে কোনো কাজ করে না। একদিন বলা হচ্ছে, গরমে এ ভাইরাস মরে ভূত হয়, আবার নাকি অতিরিক্ত ঠান্ডায় মরে। তাবিজ-কবচ, গরুর চোনা-গোবর, ঝাড়-ফুঁক, দোয়া-কালামের বন্যা বয়ে যাচ্ছে গ্রামেগঞ্জে। ঘোলা পানিতে মাছ ধরা একদল অসাধু ব্যবসায়ী মাস্ক-স্যানিটাইজার বাজার থেকে উধাও করে দিচ্ছে। পেঁয়াজের লাভ শেষ হয়ে গেছে মনে হয়। তবে হাঁচি-কাশি-থুতু থেকে যে করোনা ছড়াচ্ছে, এ ব্যাপারে বিশ্বের সবাই একমত। 

ভেবেছিলাম মাস্ক পরে রাস্তাঘাটে থুতু-কফ ফেলায় একধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে। করোনা আমাদের সভ্য করবে। ওম্মা! মাস্ক নাকের ওপর তুলে দিব্যি থুতু-কফ ফেলে হেঁটে যাচ্ছেন মহানগরের নাগরিকেরা। একজনকে দেখলাম, এক অভিনব কায়দায় নাকে হাত না দিয়ে মাস্ক তুলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফ্যাচত করে নাক ঝাড়লেন। পাশাপাশি হাঁটার সময় এক ভদ্রলোক বারবার কেশে রাস্তার ওপরেই থুতু ফেলছিলেন। বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘রাস্তায় এত থুতু ফেলেন কেন?’ তিনি রাজ্যের বিস্ময় চোখে নিয়ে উত্তর দিলেন, ‘রাস্তায় ফেলব না তো কি নিজের ঘরে গিয়ে ফেলব? আজব!’ বললাম ‘জি। ঘরে গিয়েই ফেলবেন। জায়গামতো।’ রাস্তাঘাট তো বটেই, অফিস-আদালতেও অনেককে দেখেছি, মুখে হাত না দিয়েই অনবরত হাঁচি-কাশি-হাই তুলছেন। এগুলো যে পরিবেশ ও প্রতিজনের জন্য মারাত্মক দূষণের শামিল, তার কোনো ধারণাই যেন নেই তাঁদের। উপরন্তু সজোরে অপ্রতিরোধ্য হাঁচি-কাশি বিচ্ছুরিত হওয়ার পর অনেকেরই ‘দুঃখিত’ শব্দটি উচ্চারণের ভব্যতাটুকুও নেই। কেউ কেউ আবার সশব্দে হাঁচি-কাশি-বাতকর্ম সম্পাদন করাকে পৌরুষও ভাবেন। 

পবিত্র রমজান মাস সমাগতপ্রায়। কেনাকাটার ধুম লাগবে কদিন পরেই। বাজারঘাটে থুতু-কফে পা ফেলার জায়গা থাকবে না। কার ঘাড়ে কটা মাথা আছে যে জিজ্ঞাসা করে, ‘এত থুতু ফেলছেন কেন?’ পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে প্রথম আলোয় এর আগে লিখেছিলাম, আমাদের স্বভাব হচ্ছে বারান্দা বা জানালা দিয়ে নোংরা-আবর্জনা ছুড়ে ফেলে শুধু নিজের বাসার অভ্যন্তরটুকু পরিষ্কার রাখা। অনুরূপভাবে নিজের মুখ গহ্বরটুকু পরিষ্কার রাখার জন্য রাস্তা-হাট-বাজার থুতু-কফে ভরে দেওয়া। সেই সত্তরের দশকে আমাদের উপজেলা শহরের কলেজে পৌরনীতির এক শিক্ষক ছিলেন। তিনি প্রতিদিন প্রাতর্ভ্রমণ করতেন। একদিন হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়ালেন। দেখলেন, পথের মাঝখানে মনুষ্যবিষ্ঠা। তিনি আপনমনে বলে উঠলেন, ‘এখানে এ কর্ম কে সম্পাদন করেছে? তার নিশ্চয় পৌরনীতি পড়া নাই।’

কবে হবে আমাদের ন্যূনতম সামাজিক জ্ঞান? তাই করোনাভাইরাস আসাতে আতঙ্কের সঙ্গে সঙ্গে একটু আশাবাদীও হয়ে উঠেছিলাম। ভেবেছিলাম স্বাস্থ্য সংস্থা, চিকিৎসক, সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে মানুষ সচেতন হবে। হাঁচি-কাশি-থুতু-কফ সামলিয়ে পরিবেশে সভ্যতার ছোঁয়া লাগবে। আশা হারানো পাপ। এই প্রাণঘাতী ভাইরাস আমাদের প্রাণ সংহার না করে অন্তত আমাদের বদভ্যাসগুলো পরিবর্তনের শুভ সূচনা করে দিয়ে যাক। 

উম্মে মুসলিমা কবি ও কথাসাহিত্যিক