ডিসির দাপট ও সাংবাদিকের দণ্ড: কুড়িগ্রাম স্টাইল

সুলতানা পারভিন ও আরিফুল ইসলাম
সুলতানা পারভিন ও আরিফুল ইসলাম

জেলা প্রশাসকের (ডিসি) অনিয়ম নিয়ে সংবাদ লেখার দায়ে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভিন সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে প্রথমে কারাগারে পাঠালেন। এরপর তাঁরই ইঙ্গিতে তিনি জামিন পেয়ে এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। একজন মানুষকে বাসা থেকে সুস্থ অবস্থায় ধরে নিয়ে গেলেন ডিসির লোকজন। একদিন পরই তিনি কারাগার থেকে বের হলেন মারাত্মক অসুস্থ হয়ে। তাঁর ওপর কী ধরনের নির্যাতন হয়েছে, অনুমান করা কঠিন নয়। একজন সাংবাদিকের ওপর ডিসি যে এ রকম আক্রোশ ও প্রতিহিংসা দেখাতে পারেন, তা ভাবতেও অবাক লাগে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এটি ডিসির প্রশাসনিক কার্যালয় নয়, টর্চার সেল। যিনি বা যাঁরাই ডিসি সম্পর্ক লিখবেন, তাঁদের ওপর নির্যাতন নেমে আসবে।

আইনের রক্ষকেরাই এভাবে নিয়ত আইনকে হত্যা করে চলেছেন।

প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে জানা যায়, গত শুক্রবার মধ্যরাতে আরিফুল ইসলাম যখন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখনই ঘরে ডাকাত পড়ার মতো একদল লোক এসে দরজায় প্রচণ্ড আঘাত করতে থাকে। তারা হুমকি দেয়, দরজা না খুললে ভেঙে ফেলা হবে। এর কিছুক্ষণ পর সত্যি সত্যি দরজা ভেঙে সাত-আটজন ঘরে ঢুকে আরিফুলকে পেটাতে থাকে আর বলে, ‘তুই খুব জ্বালাচ্ছিস।’ স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তানের সামনেই তাঁকে মারতে মারতে তারা বাইরে নিয়ে যায়। স্ত্রী বাধা দিলে তাঁকেও ধাক্কা দেয়।

আরিফুল কাকে ‘জ্বালাচ্ছেন’, সেটি জানা গেল আরও পরে। তাঁকে বাসা থেকে বের করে দুই চোখ কাপড় দিয়ে বেঁধে সোজা নিয়ে যাওয়া হয় ডিসি অফিসে। সেখানে একটি কক্ষে তাঁকে রাখা হয়। এরপর প্যান্ট ও গেঞ্জি খুলে তাঁকে বিবস্ত্র করে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। আর এই কাজে নেতৃত্ব দেন ডিসি অফিসের কর্মকর্তারাই।

কুড়িগ্রাম ডিসির প্রযোজনা ও ডিসি অফিস ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের অভিনয়ের এটি ছিল প্রথম পর্ব। দ্বিতীয় দৃশ্যে দেখানো হয়, আরিফুলের কাছ থেকে তাঁরা ৪৫০ গ্রাম দেশি মদ ও ১০০ গ্রাম গাঁজা উদ্ধার করেছেন। এমন একটি অভিযান তো এখানেই থেমে থাকতে পারে না। পরের দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই, কথিত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রাতেই তাঁকে এক বছরের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কে বলে বাংলাদেশে দ্রুত বিচার পাওয়া যায় না? বিচার দূরের কথা, ডিসিরা চাইলে বাঘ ও মহিষকে এক ঘাটে পানি খাওয়াতে পারেন।

আইন অনুযায়ী ভ্রাম্যমাণ আদালত রাতে বসতে পারেন না। কিন্তু জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা আরিফুলকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, তিনি কেন জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। কুড়িগ্রামের পানিতে কুমির আছে কি না জানি না, তবে স্থলভাগে যে কুমির আছে, তার প্রমাণ পাওয়া গেল মধ্যরাতে বেআইনি ভ্রাম্যমাণ আদালত বসানোয়।

যাঁরা আরিফুলের বাসায় গিয়েছিলেন, তাঁরা দাবি করেননি বাসা থেকেই এসব গাঁজা ও মদ উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে এটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে উদ্ধারপর্বটি সাজানো হয়েছে ডিসি অফিসেই। এর অর্থ কি তাহলে আরিফুলকে ফাঁসাতে ডিসি অফিসে গাঁজা ও মদ আগে থেকে মজুত করে রাখা হয়েছিল? কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন একটি মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হাজারটা মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে।

আরিফুলের ওপর ডিসির আক্রোশের কারণ গত বছরের ১৯ মে ‘“কাবিখা”র টাকায় পুকুর সংস্কার করে ডিসির নামে নামকরণ’ শিরোনামে তিনি বাংলা ট্রিবিউনে একটি সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন। সংবাদটি ভুল হলে ডিসি প্রতিবাদ জানাতে পারতেন। তা না করে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাঁকে ফাঁসিয়ে দিলেন। স্ত্রী ও শিশুসন্তানদের সামনে তাঁকে মারধর করলেন।

ভ্রাম্যমাণ আদালত হলো একটি সংক্ষিপ্ত বিচারপদ্ধতি। এই আদালতে বিচারক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে তাঁর বিচারিক এখতিয়ার অনুযায়ী উপস্থিত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তাৎক্ষণিকভাবে দোষীকে দণ্ড দিয়ে থাকেন। আইনের ৭ ধারায় বলা আছে, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সময় কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে আনার পরপরই আদালত পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সংক্ষিপ্ত অভিযোগ লিখিতভাবে গঠন করে তা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পাঠ ও ব্যাখ্যা করে শোনাবেন এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি গঠিত অভিযোগ স্বীকার করেন কি না, তা জানতে চাইবেন। অভিযুক্ত ব্যক্তি স্বীকার না করলে তিনি কেন স্বীকার করেননি, এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানতে চাইবেন। এরপর অভিযুক্ত ব্যক্তি অভিযোগ স্বীকার করলে তাঁর স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ করে অভিযুক্ত ব্যক্তির স্বাক্ষর নিতে হবে এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর বিবেচনায় যথোপযুক্ত দণ্ড আরোপ করে লিখিত আদেশ দেবেন। তবে যাঁরা রাতের বেলায় ভ্রাম্যমাণ আদালত বসাতে পারেন, স্বীকারোক্তি আদায় করার কৌশলও জানেন বটে। না হলে আরিফুল এক দিন পরই হাসপাতালে ভর্তি হবেন কেন?

ডিসি যা করলেন, তা কেবল প্রতিশোধস্পৃহা নয়, জনগণকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করা হয়েছে। সমাজের প্রতিচ্ছবি যাঁরা তৈরি করেন, স্বচ্ছতার সঙ্গে দেখার চেষ্টা করেন, সেই সাংবাদিককে যখন বেআইনিভাবে রাত দুটোয়, পরিবারে অন্য কোনো পুরুষ মানুষের অনুপস্থিতিতে, প্রতিবেশীকে সাক্ষী না রেখে জেলা প্রশাসকের অফিসে তুলে আনা হয়, তখন এর মধ্য দিয়ে ডিসি জনগণকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন, এটাই প্রমাণিত হয়।

সর্বশেষ খবর হলো, যখন আরিফুলকে কারাগারে পাঠানো নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড়, তখন ডিসি অফিস থেকেই উদ্যোগ নিয়ে তাঁর জামিনের ব্যবস্থা করা হলো। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ডিসিকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন। প্রত্যাহার কোনো শাস্তি নয়। ওই ডিসি আরেক জেলায় গিয়ে একইভাবে সাংবাদিকের ওপর অত্যাচার করবেন। তাঁর বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

ডিসি বলেছেন, আইনকানুন মেনেই নাকি ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করেছেন। কিন্তু মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছেন, এখানে স্পষ্ট আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদেরও সেবক হিসেবে কাজ করার সদুপদেশ দেন। কিন্তু প্রশাসনের কর্মকর্তারা যে নিজেদের আইনকানুনের ঊর্ধ্বে ভাবেন, কুড়িগ্রামের ডিসির দৌরাত্ম্যই তাঁর প্রমাণ। এর শেষ কোথায়?

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক