করোনায় নির্বাচনের বিপজ্জনক পাগলামি

কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন করোনার মধ্যে নির্বাচন করার মরিয়াপনা দেখে সেই পুরোনো বাংলা প্রবাদটির কথাই মনে পড়ল—কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ। সারা দেশ যখন করোনাভাইরাসের আতঙ্কে ভুগছে, জনজীবন, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগযোগব্যবস্থা সব স্থবির হয়ে পড়ছে, তখন তাঁরা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও তিনটি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনকে সুযোগ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। কিন্তু নিজের এবং পরিবার-পরিজনের মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে কেন ভোটারেরা সেখানে যাবেন? নির্বাচনী কর্মকর্তারা কোন গণতান্ত্রিক মহার্ঘ পেতে নিজেদের ঝুঁকিতে ফেলবেন? আর এ নির্বাচন পেছালেই বা জগতের কোন ক্ষতি হয়ে যাবে?

২১ মার্চ ঢাকা-১০, গাইবান্ধা-৩ ও বাগেরহাট-৪ আসনে উপনির্বাচন এবং ২৯ মার্চ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন, বগুড়া-১ ও যশোর-৬ উপনির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। সিইসিকে সাংবাদিকেরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি কি নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার চিন্তা করছেন?’ জবাবে তিনি বলেছেন, ‘এখনো সে রকম চিন্তা করিনি। আমরা নির্ধারিত তারিখে নির্বাচন করার উদ্দেশ্য নিয়েই কাজ করছি।’ তাঁর কথা থেকে প্রথম আলো বুধবারের দিনের উক্তি করেছে, ‘বাঙালি নেশন অব টলারেন্স, এর চেয়ে বড় বড় দুর্যোগ সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করেছে’।

আগুনে কোনো প্রতিবেশীর বাড়ি পুড়ে গেলে তখন দুষ্ট লোকেরা সেটিকে আলু পোড়ানোর সুযোগ হিসেবে বেছে নেয়। কেননা, তাতে আলু পোড়ানোর জন্য কাঠ বা খড় ব্যবহার করতে হবে না। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের এমনই কারিশমা যে তারা একটি নির্বাচনও সুষ্ঠু করতে পারেনি। যে দেশে মানুষ ভোটকে উৎসব হিসেবে নেয়, সেই দেশে ভোটারদের কেন্দ্রবিমুখ করার বিরল কৃতিত্ব দাবি করতে পারে হুদা কমিশন।

এই নির্বাচনের তফসিল যখন দেওয়া হয়েছিল, তখন দেশের অবস্থা দুর্যোগময় ছিল না। করোনাভাইরাসে তখন কেউ মারা যাননি। বাংলাদেশে এর প্রাদুর্ভাবও ঘটেনি। কিন্তু অভূতপূর্ব এই সংক্রমণ ব্যাধি গত দুই সপ্তাহে বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। বিদেশ থেকে আসা সব মানুষকে বাধ্যতামূলক দুই সপ্তাহের জন্য স্বেচ্ছাবন্দী থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পর্যটন কেন্দ্র এবং হোটেলগুলো ফাঁকা হয়ে গেছে। বিমান, নৌ ও ট্রেন-বাসে যাত্রীসংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে গেছে। শপিং মলগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এককথায়, জনজীবন হয়ে পেড়েছে স্থবির। এ অবস্থায় কোনো নির্বাচন হতে পারে না।

আমরা ধরে নিলাম, হুদা কমিশন ভোটার ছাড়াই আরেকটি নিয়মরক্ষার নির্বাচন করতে চাইছে। কেননা, তাদের নির্বাচনে কতজন ভোটার কেন্দ্রে এসেছেন, কতজন প্রার্থী এজেন্ট দিতে পেরেছেন, কতজন পারেননি, সেটি নাকি দেখার বিষয় নয়। কিন্তু নিয়মরক্ষার ভোট করতেও তো কিছু মানুষ দরকার। প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তা দরকার। কেন্দ্র পাহারা দেওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য দরকার। তাঁরা কোন ভরসায় আসবেন? ইতিমধ্যে এক আনসার সদস্য এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।

২০১৮ সালের সালের নির্বাচনে কত শতাংশ ভোটার কেন্দ্রে গিয়েছেন, সেটি মানুষ দেখেছে, ভোটারশূন্য অনেক কেন্দ্রের ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, টেলিভিশনেও দেখানো হয়েছে। তারপরও নির্বাচন কমিশন প্রজ্ঞাপন জারি করে বলেছে, ওই নির্বাচনে গড়ে ৮০ শতাংশেরও বেশি ভোট পড়েছে। কথায় বলে, গাঁজার নৌকা পাহাড় ডিঙায়। কিন্তু নূরুল হুদা কমিশনের ভোটের হিসাব গাঁজার নৌকাকেও ছাড়িয়ে গেছে। তারা এটিকে মঙ্গল গ্রহে নিয়ে গেছে। এ রকম নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশের ইতিহাসে তো নয়ই, বিশ্ব ইতিহাসেও দ্বিতীয়টি এসেছে কি না সন্দেহে আছে। নির্বাচন নিয়ে কোনো আন্তর্জাতিক ইনস্টিটিউট হলে তার নেতৃত্ব হুদা কমিশনের হাতে ন্যস্ত করার জোর সুপারিশ করছি।

অনেক করপোরেট অফিস কর্মীদের বাসায় বসে অনলাইনে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা গণজমায়েত ও গণসমাবেশ এড়ানোর কথা বলছেন। এই অবস্থায় নির্বাচন কমিশন কেন ভোট করতে চাইছে, তা উপলব্ধি করা কঠিন নয়। স্বাভাবিক অবস্থায়ই যখন তারা ভোটারদের কেন্দ্রে টানতে পারছে না, তখন অস্বাভাবিক অবস্থায় ভোট করলে অজুহাত দাঁড় করা যাবে। অর্থাৎ করোনাভাইরাসকে নির্বাচন কমিশন সুযোগ হিসেবে নিয়েছে। এ সময়ে নির্বাচন হলে দেশের মানুষকে বোঝানো যাবে যে নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করতে তাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে ভোটাররা না এলে তারা তো হাসপাতাল কিংবা কোয়ারেন্টাইন সেন্টার থেকে মানুষকে ধরে নিয়ে আসতে পারে না।

কিন্তু মহাবিজ্ঞ কমিশন এ কথা ভাবছেন না যে ভোটানুষ্ঠানটির আয়োজন করবেন কারা। পাঁচ কমিশনার নিশ্চয়ই শত শত কেন্দ্রে গিয়ে ভোট তদারক করবেন না। ভোট গ্রহণের জন্য নির্বাচনী কর্মকর্তার প্রয়োজন হবে। তাঁদের সহকারীর প্রয়োজন হবে। ভোটারদের চিহ্নিত করতে পোলিং এজেন্টদের প্রয়োজন হবে। কেন্দ্র পাহারার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশ, আনসার, বিজিবি সদস্যের প্রয়োজন হবে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন আবার সেই শিক্ষকদের ভোটের জন্য তলব করা কতটা সমীচীন?

কে এম নূরুল হুদা কমিশন এর আগে যতগুলো নির্বাচন করেছে, রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে নির্বাচন হলে সেটি শুধু প্রসহন হবে না, জনগণের সঙ্গে তামাশা হবে। নির্বাচন কমিশন এর আগে অনেক তামাশার জন্ম দিয়েছে। নতুন করে তামাশার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।

সহকর্মী ফারুক ওয়াসিফ করোনাভাইরাসের দিনে মানুষের মধ্যে মানবিকতা বোধ জাগ্রত করার কথা বলেছিলেন। সেটি কতটা হয়েছে জানি না, তবে নির্বাচন কমিশনকে এখনো যে তা স্পর্শ করতে পারেনি, তার প্রমাণ তাঁদের এই খামখেয়ালি ভাব। নির্বাচনের নামে এই প্রহসন বন্ধ হোক। স্বাধীন নির্বাচন কমিশনকে স্বেচ্ছাচারিতার স্বাধীনতা কেউ দেয়নি।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan 55 @gmail. com