তাহলে উপায়?

এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে
মীরজাদী অবশেষে বলেছেন, ‘করোনাকে আর খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নাই’। আগে কীভাবে সে সুযোগ ছিল, কে সেই সুযোগ নিয়েছিল বা দিয়েছিল, তা নিয়ে বাহাস করার সময় এটা নয়। তাই বলে কুড়িগ্রামের সদ্য সাবেক ডিসির মতোও বলা যাবে না, যা হওয়ার হয়ে গেছে, এখন হাতমুখ ধুয়ে চুপচাপ থাকুন।

সাধ্যের মধ্যে করোনা সংকট মোকাবিলার সুষ্ঠু ব্যবস্থা গড়ে তোলার সময় আমরা পেয়েছিলাম। প্রথম চোটে চীন, জাপান, ভারত, কোরিয়ার উদাহরণ সামনেই ছিল। আমরা আমলে নিইনি। পরের ধাক্কায় ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের ব্যবস্থাপনার দিকেও আমরা ফিরে তাকালাম না। বন্দী থাকলাম মিডিয়া চর্চায় আর আলো-আঁধারির আপডেট আপডেট খেলায়। এই আছে এই নেই।

১, ২, মুক্ত, ৩ মুক্ত, ৪ সুস্থ, ২ আক্রান্ত, ১ মৃত, ৩ কাহিল ইত্যাদির নামতা ধারাপাত। ভুলেই গেলাম ১ দিয়েই শুরু হয়। চীন, কোরিয়া, জাপান, জাহাজ, সবখানেই এক দিয়েই শুরু। আপডেটবাজির সঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো গুজবের কানমলা, জেল-জরিমানার খাঁড়া, কিন্তু করোনার ভয়াবহতা নিয়ে বলাবলি–কানাকানি থামেনি। সরকারি আপডেটের দাবির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রশ্ন উঠেছে।

লুকোচুরি কৌশল বুমেরাং হচ্ছে
মেঘ জমছিল সেই ডিসেম্বর থেকে, আমরা দেখতে পাইনি। ভেবে দেখলাম না, সকল সক্ষমতা থাকার পরও চীন-জাপান, কোরিয়া-ইতালি পরিস্থিতি সামাল দিতে কেমন নাকানি-চুবানি খাচ্ছে। জনগণের প্রতি দায় ও দায়িত্ব থাকার পরও সব ধরনের কার্যকর উদ্যোগ নিয়েও তারা পেরে উঠছে না। সেখানে একটা আস্থাহীন (আস্থা থাকলে আমাদের লোকমান্য গণ্যমান্যরা কথায় কথায় বিদেশ যেতেন কি না)। চিকিৎসা-ব্যবস্থায় নিয়ে ঘনবসতি দেশে আমরা কীভাবে সামাল দেব। এখনো আমরা কোনো কর্মকৌশল ও পরিকল্পনা ছাড়াই আজ এটা কাল ওটা স্টাইলে চালাচ্ছি। এটাকে বলে ‘নো স্ট্র্যাটেজি’। বাংলায় এটা অনেকটা ‘ঝোপ বুঝে কোপ’ ধরনের কৌশল। অনেকে এটাকেই আবার বলে ঠ্যাকা কাম চালিয়ে নেওয়া বলেন।

আবার হতে পারে ‘লুকোচুরি স্ট্র্যাটেজি’। প্রথমেই আমাদের লুকোচুরি স্ট্র্যাটেজি বা ‘ঝোপ বুঝে কোপ মারা’ কৌশল ত্যাগ করতে হবে। লুকোছাপার গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

কোনো লুকোছাপা–কানামাছি করা যাবে না। কথায় বলে দরজি, উকিল, ডাক্তারদের কাছে কথা গোপন করতে হয় না। ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে দেশের জনগণ হবে দরজি, উকিল, ডাক্তার। জনগণকে আস্থার বাইরে রাখলে চলবে না। আগামী কয়েক দিনে যদি আক্রান্তের সংখ্যাটা বেড়ে যায় তখন কে অবহেলার দায়দায়িত্ব নেবে! মনে রাখতে হবে, ভাইরাস সংকট উত্তরণের চাবিকাঠি কোনো একক মন্ত্রণালয় বা কোনো একক ব্যক্তির হাতে নেই।

শ্রমজীবী, রোহিঙ্গা, দোকানপাট
ঢাকার ৩৫ শতাংশ মানুষ থাকে বস্তিতে বা প্রায় বস্তির অবস্থায়। প্রবাসীঘন জেলাগুলোর মধ্যে কক্সবাজার অন্যতম। সেখানে গায়ে গা ঘেঁষে বাস করছেন ১০ লাখ বর্মিজ মেহমান। তাদের শিবিরে ভাইরাসটা ছড়ালে কী হবে? কে কীভাবে দেখবে আক্রান্তদের? যখন, যেদিন দেশটা ‘সিঙ্গাপুর’ হবে, সেদিন দেখা যাবে। আজকের বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি এবং চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থা কোনটাই যে সিঙ্গাপুরের চেয়ে ভালো নয়, তা তো জনগণের অজানা নয়। তাহলে আমরা কিসের ভরসায় আছি?

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যা পারবেন
মন্দের ভালো পদক্ষেপ হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে, কিন্তু তারপর কী? কীভাবে ছাত্রছাত্রীরা সময় কাটাবে বাড়িতে। এই সময় শিক্ষকেরা কী করবেন, তাঁদের দায়িত্ব কী হবে? তাঁরা কি এখন একটা কোচিং সেন্টারের বদলে চারটি কোচিং সেন্টারের কোচিং টিচার হয়ে যাবেন? বাস্তবে তাই হচ্ছে। অভিভাবকদের অনুরোধে কোচিং খাঁচাগুলোয় আরও গাদাগাদি–ঠ্যাসাঠেসি করে বসানো হচ্ছে স্কুল ছুটির ছাত্রছাত্রীদের। বন্ধু হিরামতি মওলা ইরানের ছোট্ট শহর আরাকে থাকেন। তিনি জানালেন, ‘স্কুল বন্ধ ঘোষণা হয়েছে। বন্ধের পরই পরীক্ষা। মেয়ের স্কুল থেকে আজ ভাইবারে ভ্যাকেশন হোম ওয়ার্ক পাঠিয়েছে। লেসন প্ল্যান পাঠিয়েছে। শিক্ষক ফোন করে শিক্ষার্থীর খোঁজ নিচ্ছেন। অনলাইনে লেসন প্ল্যান শেয়ার, খোঁজখবর রাখার বিষয়টি ভালো লেগেছে।’ আমরা চাইলেই এটা করতে পারি, খাসলতে পরিবর্তন আনতে পারি।

জমায়েত মানেই বিপদ
অনেক দেরি হয়ে গেছে, তবু সব উপাসনালয়ের জন্য বিধিবিধান জারি করা খুবই জরুরি। বড় আর ঠ্যাসাঠেসি জমায়েত নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় সামাজিক মেলামেশার নামে জমায়েত বন্ধের কথা বলছেন। সংস্থাটি আমাদের অঞ্চল নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। এ অঞ্চলে এখন পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় সবচেয়ে বেশি মাত্রায় করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। কারণ, অনেক বেশি মানুষ আক্রান্ত হওয়ার আগপর্যন্ত তারা সামাজিক বিচ্ছিন্নতার ব্যাপারটিতে গা করেনি। এ দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়ার জায়গাটি ছিল এক তাবলিগ জামাত। ওই জামাতে প্রায় ১৬ হাজার মানুষ জমায়েত হয়েছিল। আর সেখান থেকেই করোনা ছড়িয়ে পড়ে। এত দিনে এসে মালয়েশিয়া সীমান্ত বন্ধ ও সব ধরনের পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। বন্ধ করেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দক্ষিণ কোরিয়ায় ভাইরাস ছড়ানো শুরু হয়েছিল খ্রিষ্টীয় সম্প্রদায়ের একটি বিশেষ গোষ্ঠির জমায়েত থেকে।

স্বার্থপর আচরণ বন্ধ হোক
বড় জমায়েত ছাড়াও কিছু কিছু সেবার দোকান আছে (যেমন চুল কাটার দোকান বা সেলুন কিংবা পারলার, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি) সেগুলোর প্রতিও আমাদের নজর রাখতে হবে। সেলুনের কর্মীদেরও ঝুঁকি আছে। চাদর, তোয়ালে, কাঁচি, চিরুনি—সবই সংক্রমিত হতে পারে।

আতঙ্ক কেনাবেচা ‘গো অ্যান্ড স্টক’ শুরু হয়ে গেছে। পাওয়া যাচ্ছে না দাম বেড়ে গেছে। সাবান, সোডা, নাক ঢাকনি ছাড়াও চাল–তেলের দাম বাড়ছে ক্রমশ। বিশিষ্ট চাল ব্যবসায়ী আমাদের খাদ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। এক বন্ধু প্রস্তাব করেছেন, একজন ক্রেতার কাছে সর্বোচ্চ কত একক পণ্য বিক্রয় করা যাবে, তা নিয়ে সরকারি নির্দেশনার সময় এসে গেছে। আতঙ্কিত ক্রেতা রুখতে শেষ পর্যন্ত জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদর্শনের দিকেও যেতে হবে।

স্বাস্থ্যব্যবস্থায় জরুরি অবস্থা?
অনেকেই বলছেন বর্তমানের লেজেগোবরে অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে সেনাবাহিনী তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসা হোক। সমন্বয় ও পরিকল্পনামাফিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার সেটা একটা সহজ পথ হতে পারে। তবে এই জরুরি মুহূর্তে দেশের সব সরকারি বেসরকারি স্বাস্থ্য খাত, স্থাপনা, হাসপাতাল আর ফার্মাসিউটিক্যালস একক তত্ত্বাবধানে (ভাইরাস ইমারজেন্সি অথোরিটি) নিয়ে আসা প্রয়োজন। জাতীয় সংসদের জরুরি অধিবেশন ডেকে বা অরডিন্যান্স জারি করে সেটা করা যায়।

খাদ্য নিরাপত্তা
এই শীত এক মাঘে যাওয়ার নয়। আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা একটা বড় হুমকির মধ্যে পড়তে পারে। আমাদের খাবারের সরবরাহ নিশ্চিত রাখার স্বার্থে কৃষিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রকৃত কৃষককে উপযুক্ত ভর্তুকি দিয়ে হলেও এই মৌসুমে সর্বোচ্চ উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে। যেন কৃষক তার লাভ রেখে দেশের কোটি মানুষকে খাদ্য নিরাপত্তা দিতে পারে।

দেশ-বিদেশের সহযোগিতা
সব সংকট মানুষকে তার গণ্ডির বাইরে আসার তাগিদ দেয়। সৃজনশীলতা আর উদ্ভাবনের ঝোঁক তৈরি করে। জাহাঙ্গীরনগর, বুয়েট, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র আবার সেটার প্রমাণ দিল। জাতির জন্য প্রতিটি প্রচেষ্টাই আশাবাদের। এসব গবেষণাকে স্বীকৃতি দিয়ে উৎসাহিত করতে হবে। জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এবং সেখানে কর্মরত গবেষকদের এ–সম্পর্কিত গবেষণায় উৎসাহিত করতে হবে। ভাইরাস ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন দেশের (কিউবা, জাপান, চীন) অর্জনের হালফিল খবর রাখতে হবে।

বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের জন্য যেসব দেশ (চীন, জাপান) আমাদের সহযোগিতার জন্য এগিয়ে এসেছে বা যাদের সহযোগিতা আমাদের কাজে লাগতে পারে, তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা প্রয়োজন। আমাদের স্বাস্থ্যকর্মী (চিকিৎসক, নার্সসহ সব কর্মী) স্বাভাবিকভাবে তাঁদের নিজ নিজ নিরাপত্তা নিয়ে বিশেষ চিন্তিত। পর্যাপ্ত ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের ব্যবস্থা এখনই করতে হবে। আমাদের পোশাক কারখানাগুলো সেটার দায়িত্ব নিতে পারে।

কঠোর সুরক্ষা জরুরি
জাতির সর্বোত্তম স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে প্রয়োজনে কঠোর ও নির্দয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে। ইতালি তার চিকিৎসাব্যবস্থায় যুদ্ধাবস্থার জন্য প্রযোজ্য নীতিমালা অনুসরণের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। এই নীতির মানে হচ্ছে শুধু তাকেই সেবা দেওয়া হবে যার বাঁচার সম্ভাবনা আছে। চিকিৎসক এবং নীতিনির্ধারক উভয়ের জন্য এই পরিস্থিতি বেশ কষ্টের। অনেকই মানসিকভাবে এটা নিতে পারে না। কিন্তু সত্য যে কঠিন কঠিনের ভালোবাসি সে কখনো করে না বঞ্চনা। আমরা বঞ্চিত হব না সত্যকে মেনে নেব? সিদ্ধান্ত আমার-আপনার।

গওহার নঈম ওয়ারা: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা গবেষক।
[email protected]