করোনা পরীক্ষার প্রযুক্তিগত সক্ষমতার উপায়

উচ্চমাত্রার সংক্রামক নভেল করোনাভাইরাস বাংলাদেশে এখনো মহামারি আকারে ছড়িয়ে না পড়লেও বেশ কিছু মানুষের আক্রান্তের খবরে জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। যাঁরা নিজের অজান্তে আক্রান্ত ব্যাক্তির সংস্পর্শে রয়েছেন বা ইতিমধ্যে যাঁদের মধ্যে রোগের লক্ষণ প্রকাশিত হচ্ছে, তাঁরা পরীক্ষা করার জন্য সরকার–নির্ধারিত একমাত্র প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের শরণাপন্ন হচ্ছেন। স্বাস্থ্যসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত বিশেষজ্ঞগণও সংক্রমণ রোধে পরীক্ষার ওপর জোর দিচ্ছেন। কিন্তু চাহিদার তুলনায় প্রতিষ্ঠানটির সীমিত সক্ষমতার কারণে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে করোনাভাইরাস পরীক্ষার প্রস্তুতি বাংলাদেশের আসলেই আছে কি না। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে পরীক্ষার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের সময় এখনই। সময়মতো পরীক্ষার ব্যবস্থা হলে ভাইরাস ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়া রোধ করা সহজ হবে। জনমনেও স্বস্তি ফিরে আসবে।

করোনাভাইরাস পরীক্ষার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও স্বীকৃত পদ্ধতি হচ্ছে আরটি-পিসিআর (RT-PCR), যাতে আরএনএ (RNA) শনাক্ত করার মাধ্যমে সংগৃহীত নমুনায় ভাইরাসের উপস্থিতি আছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়। নমুনা হিসেবে গলা থেকে সংগৃহীত লালা (Throat swab), নাসোফেফেরেঞ্জিয়াল সোয়াব (সর্দি) বা ক্ষেত্রবিশেষে কফ ব্যবহার করা হয়। ভাইরাসজনিত রোগ নির্ণয়ে আরটি–পিসিআর (RT-PCR) একটি বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি, যার সুবিধা বাংলাদেশের অনেক হাসপাতালে বিদ্যমান আছে প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে। সঠিকভাবে পরীক্ষা সম্পন্ন করে নির্ভুলভাবে প্রতিবেদন প্রদান করতে সক্ষম বিশেষজ্ঞও আছেন যথেষ্ট সংখ্যায়।

আরটি-পিসিআর পদ্ধতিতে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য প্রয়োজন হয় চারটি উপাদান: ১. নমুনা সংগ্রহের উপযোগী পাত্র ও ব্যবস্থা, ২. সংগৃহীত নমুনা থেকে ভাইরাসের আরএনএ পৃথক করার যন্ত্র, ৩. পিসিআর মেশিন এবং ৪. প্রয়োজনীয় রিএজেন্ট (Reagent) বা কিট। এই চার উপাদানের মধ্যে প্রথম তিনটি বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালের পরীক্ষাগারে যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান আছে। আর চতুর্থ উপাদান, অর্থাৎ রিএজেন্ট বা কিট নির্দিষ্ট উৎস বা উৎপাদনকারীর কাছ থেকে দ্রুততম সময়ে সংগ্রহ করা সম্ভব। করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় RT-PCR রিএজেন্ট বা কিট যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি থেকে সংগ্রহ করা যায়, যেমনটি আইইডিসিআর বর্তমানে করছে।

বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনকারী বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকেও এই রিএজেন্ট সহজে সংগ্রহ করা যায়। তবে রোগের প্রাদুর্ভাব অতিমাত্রায় হলে এই দুই উৎস থেকে রিএজেন্ট সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। কারণ, ব্যাপক চাহিদার বিপরীতে সিডিসিসহ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা অনেক কম। সে ক্ষেত্রে একমাত্র বিকল্প হচ্ছে, দেশীয় ল্যাবরেটরিতে দেশের জন্য প্রয়োজনীয় রিএজেন্ট বা কিট ((Laboratory Made In-house Reagent)) প্রস্তুতের ব্যবস্থা করা। এই বিকল্প পদ্ধতিতে পরীক্ষার উপকরণ প্রস্তুতি ভারতসহ অনেক দেশ ইতিমধ্যে শুরু করেছে। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে গণস্বাস্থ্য সংস্থা এই কিট তৈরির সক্ষমতা অর্জনের ঘোষণা দিয়ে সরকারের কাছ থেকে এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি চেয়েছে এবং পেয়েছেও। RT-PCR পদ্ধতিতে করোনাভাইরাস পরীক্ষার রিএজেন্ট বা কিট তৈরি করার জন্য বৈজ্ঞানিক দক্ষতাসম্পন্ন মলিকুলার বায়োলজিস্ট বাংলাদেশেই বিদ্যমান আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সক্ষম বলে আমার বিশ্বাস।

ইতিমধ্যে বাংলাদেশের গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান এই কিট তৈরির সক্ষমতা অর্জন করেছে বলে ঘোষণা দিয়েছে এবং সরকারের কাছে তা উৎপাদনের অনুমতি চেয়েছে। এ বিষয়ও যথেষ্ট আগ্রহ জাগায়।

করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য আরটি-পিসিআরের মতো আধুনিক মলিকুলার পদ্ধতি ছাড়া আরও কিছু পদ্ধতি আছে, যা সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য না হলেও ব্যবহারযোগ্য। যেমন IgG ও IgMcix ও v পরীক্ষা বা অ্যান্টিজেন–নির্ভর স্ট্রিপ টেস্ট। এসব পরীক্ষার প্রয়োজনীয় উপাদান বিশ্বের অনেক দেশ ইতিমধ্যে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করছে। প্রাথমিক স্ক্রিনিং টেস্ট হিসেবে এগুলো ব্যাপক চাহিদা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস এখনো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। বর্তমানে আমরা ভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় পর্যায়ে আছি। ব্যাপক হারে সংক্রমণ প্রতিরোধের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়ার এখনই সময়। সংক্রমণ প্রতিরোধের স্বীকৃত অনুষঙ্গ হচ্ছে সন্দেহভাজন আক্রান্ত ব্যক্তি ও তাঁর সংস্পর্শে আসা সবার জন্য ভাইরাসের পরীক্ষা করা। করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও উপকরণ বাংলাদেশে বিদ্যমান থাকার পরও কেন যে একটিমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠানে সীমিতসংখ্যক পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, তা বোধগম্য নয়। এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে সরকারি-বেসরকারি বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান যন্ত্রপাতি ও জনশক্তি সমন্বয় করে ভাইরাস পরীক্ষার ব্যাপক পরিকাঠামো প্রস্তুত করা প্রয়োজন। বিদেশ থেকে পরীক্ষার রিএজেন্ট বা কিট পাওয়া না গেলে দেশীয় ল্যাবরেটরিতে তা উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে এখনই। উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে সরকারকেই।

ড. মামুন আহমেদ: মলিকুলার ভাইরোলজিস্ট, অধ্যাপক, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।