মহামানবের মহা সফর মিরাজ

নবী–রাসুলের দ্বারা প্রকাশিত অতিপ্রাকৃতিক ঘটনাকে মুজিজা বলা হয়। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর বহু মুজিজার মধ্যে অন্যতম সেরা মুজিজা হলো মিরাজ। অন্য কোনো নবী ও রাসুলের মিরাজ হয়নি। মিরাজ অর্থ ঊর্ধ্বগমন। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সশরীর সজ্ঞানে জাগ্রত অবস্থায় হজরত জিবরাইল (আ.) ও হজরত মিকাইল (আ.)-এর সঙ্গে বোরাকে চড়ে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা হয়ে প্রথম আসমান থেকে একে একে সপ্ত আসমান এবং সিদরাতুল মুন্তাহা পর্যন্ত যান এবং সেখান থেকে একাকী রফরফ বাহনে আরশে আজিম পর্যন্ত যান। এরপর মহান রাব্বুল আলামিনের সঙ্গে তাঁর দিদার লাভ ও সংলাপ হয় এবং জান্নাত–জাহান্নাম পরিদর্শন করে তিনি ফিরে আসেন। মহানবী (সা.)–এর এই যাত্রা থেকে শুরু করে ফিরে আসা—ইসলামি পরিভাষায় এই পুরো প্রক্রিয়াই হলো মিরাজ। আর মিরাজের প্রথম অংশ কাবা শরিফ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণ হলো ইসরা।

ইসরা অর্থ রাত্রিকালীন ভ্রমণ। নবী করিম (সা.)–এর মিরাজ রাত্রিকালেই হয়েছিল, তাই এটিকে ইসরা বলা হয়। মিরাজ রজনীকে আরবিতে ‘লাইলাতুল মিরাজ’ এবং ‘লাইলাতুল ইসরা’ বলা হয়; যা সাধারণের কাছে ‘শবে মিরাজ’ নামে পরিচিত। বিরুদ্ধবাদীদের অবিশ্বাসই প্রমাণ করে মিরাজ স্বপ্নযোগে নয়, ধ্যানের মধ্যেও নয়; ইসরা ও মিরাজ হয়েছিল সশরীর, সচেতন ও জাগ্রত অবস্থায়। অন্যথায় বিরোধিতাকারীদের অবিশ্বাস ও আপত্তির যৌক্তিক কোনো কারণই ছিল না।

রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর নবুয়তের ১১তম বছরের ২৭ রজব মিরাজ সংঘটিত হয়। তখন নবীজি (সা.)–এর বয়স ছিল ৫১ বছর। এ বছর নবীজি (সা.)–এর চাচা আবু তালেব এবং স্ত্রী হজরত খাদিজা (রা.) অল্প দিনের ব্যবধানে ইন্তেকাল করেন। এ বছরকে রাসুলে কারিম (সা.)–এর জীবনের ‘আমুল হুজন’ বা দুঃখের বছর বলা হয়। মহানবী (সা.)–এর দুঃখ নিবারণ ও দাওয়াতি কাজে উদ্বুদ্ধকরণে আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম বান্দাকে মিরাজ দ্বারা সম্মানিত করেন।

মিরাজের বিবরণ কোরআন কারিমের সুরা নাজমে ও সুরা বনি ইসরাইলে আলোচিত হয়েছে। ইসরার বিবরণ কোরআন মাজিদে আল্লাহ এভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘তিনি পবিত্র (আল্লাহ) যিনি তাঁর বান্দাকে (হজরত মুহাম্মদ সা.) ইসরা বা রাত্রিকালীন ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত, যার আশপাশ আমি বরকতময় করেছি। যাতে আমি তাকে আমার নিদর্শনসমূহ দেখাতে পারি। নিশ্চয় তিনিই সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা–১৭ ইসরা, আয়াত: ১)।

ইমানের পরই প্রধান ইবাদত নামাজ। মিরাজেই আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রিয় নবীজি (সা.)-এর উম্মতের জন্য নামাজ উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছে, যা কিয়ামত পর্যন্ত সব মুমিন ও অনুগত মুসলমানের জন্য মিরাজ হিসেবে গণ্য।

তাশাহহুদ (আত্তাহিয়্যাতু) মিরাজ সংলাপের অংশবিশেষ নামাজে ওয়াজিব হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নবীজি (সা.) আল্লাহর সমীপে উপনীত হয়ে বললেন, ‘আমার মৌখিক, শারীরিক ও আর্থিক যাবতীয় ইবাদত একমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্য।’ উত্তরে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বললেন, ‘আপনার প্রতি শান্তি, রহমত ও বরকত আমার পক্ষ থেকে সদা সর্বদা।’ প্রতি–উত্তরে রাসুলে আকরাম (সা.) বললেন, ‘আমাদের প্রতি ও আল্লাহর নেককার বান্দাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক।’ তখন ফেরেশতাগণ বললেন, ‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নাই, হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর প্রিয় বান্দা ও রাসুল।’

মিরাজের রাতে মসজিদুল আকসায় সব নবী ও রাসুলের জামাতে নবীজি (সা.) ইমামতি করেন। এতে তিনি ‘ইমামুল আম্বিয়া’ (নবীদের ইমাম বা নেতা) ও ‘সাইয়িদুল মুরসালিন’ (রাসুলদের সরদার) অভিধায় অভিহিত হন। মিরাজের সফরে আমাদের নবীজি (সা.)–এর সঙ্গে বিভিন্ন নবী–রাসুলের বিশেষ সাক্ষাৎ হয়।

মিরাজে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জাত মানবজাতির কল্যাণ ও সুরক্ষার জন্য সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন, ‘আল্লাহ ছাড়া কারও ইবাদত কোরো না, পিতা–মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো, নিকট আত্মীয়স্বজনের অধিকার দাও; মিসকিনদের অধিকার দাও; অপচয় কোরো না, অপচয়কারী শয়তানের ভাই, কৃপণতা কোরো না, সন্তান হত্যা কোরো না, ব্যভিচারের নিকটেও যাবে না, মানব হত্যা করবে না, এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ কোরো না, প্রতিশ্রুতি পালন কোরো, মাপে পরিপূর্ণ দাও, অজ্ঞতার সঙ্গে কোনো কিছু কোরো না, পৃথিবীতে গর্বের সঙ্গে চলো না।’ (সুরা-১৭ ইসরা, আয়াত: ২২-৪৪)।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail,com