সামরিক আমলাতন্ত্রের কাছে সু চির হার

অং সান সু চি। রয়টার্স ফাইল ছবি
অং সান সু চি। রয়টার্স ফাইল ছবি

জেনারেল অং সান স্বাধীন মিয়ানমারে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে সম্মানিত। ট্র্যাজেডি হলো, দেশটির স্বাধীনতা তিনি দেখে যেতে পারেননি। আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার প্রায় ছয় মাস আগে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের হাতে রেঙ্গুনে ছয় সহযোগীসহ তিনি নিহত হন। জীবিত অং সান ছিলেন সম্ভাব্য বহুজাতির দেশটিতে ঐক্যের একমাত্র প্রতীক। তাঁর খুনের মধ্য দিয়ে সেখানে ফেডারেল ধাঁচের শাসনব্যবস্থার স্বপ্নেরও মৃত্যু ঘটে। ফলে মূল জনজাতি ‘বামার’দের ‘স্বাধীনতা’ সেখানে অন্য সব সংখ্যালঘু অবামার জাতির জন্য প্রায় পরাধীনতা হয়ে যায়। অং সানও তাই কেবল এক জাতির ‘হিরো’ এখন। অথচ দেশটিতে রয়েছে সরকারি হিসাবেই আরও ১৩৩টি জাতিসত্তা।

অং সানের মৃত্যুর ৪০ বছর পর ১৯৮৮ সালে তাঁর কন্যা সু চি দেশটিতে ফিরে গণতন্ত্রপন্থীদের আশার দীপশিখা হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু শারীরিকভাবে বেঁচে থাকলেও রাজনীতিতে তাঁর শেষ পর্যন্ত অপমৃত্যু ঘটছে বলা যায়। গণতান্ত্রিক সংস্কার সাধনে তাঁর কর্মসূচি সম্প্রতি চরমভাবে ব্যর্থ হলো। জেনারেলদের তৈরি সংবিধানকে পাল্টাতে সু চির চূড়ান্ত চেষ্টা পার্লামেন্টে থামিয়ে দিয়েছেন সশস্ত্র বাহিনীর এমপিরা।

১৯৪৭ সালের জুলাইয়ে জেনারেল অং সানের আকস্মিক মৃত্যু ছিল তখনকার ‘বার্মা’র আশাভঙ্গের সূচনা। ওই ঘটনার ২১ মাস পর সেখানে নে উইন সামরিক বাহিনীর প্রধান হন। এরপর বিরতিহীনভাবে সামরিক আমলাতন্ত্রের বিকাশের শুরু। বহুদলীয় রাজনীতি এবং বহুত্ববাদী সমাজের প্রত্যাশা বিলীন হয়ে যায় তাতে। বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে লৌহমানব নে উইনের ‘সমাজতান্ত্রিক বার্মা’। নে উইন বিদায় নেন ১৯৯০ সাল নাগাদ। কিন্তু পরবর্তী জেনারেলরাও একই ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। ২০২০ সালের মার্চে দেখা যাচ্ছে, সু চির হাত ধরেও দেশটি সেই কালো অতীত থেকে বের হতে পারল না।

করোনাভাইরাসের আতঙ্কের মুখে দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশে দীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের এই বিপর্যয় সামান্যই মনোযোগ পেল বিশ্বব্যাপী।

অনির্বাচিতদের ‘বিজয়’

প্রায় এক বছর মিয়ানমারে সাংবিধানিক সংস্কার নিয়ে তুমুল আলাপ চলছে। তারই অংশ হিসেবে পার্লামেন্টে অনেকগুলো সংশোধন প্রস্তাব নিয়ে চূড়ান্ত বিতর্ক হলো ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ মার্চ। ১৪৯ জন সদস্য তাতে অংশ নেন। মূলত সু চির দল এনএলডি (ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি) সংবিধান সংশোধনের এ চেষ্টা নেয়। প্রধান প্রধান সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ছিল পার্লামেন্ট থেকে সশস্ত্র বাহিনীর কোটা অপসারণ, সংবিধান সংশোধনে তাদের ‘ভেটো’ ক্ষমতা রদ, যেকোনো সংস্কার প্রস্তাব অনুমোদনে ৭৫ ভাগ পার্লামেন্ট সদস্যের সমর্থনের নিয়মকে দুই–তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনা ইত্যাদি। বিতর্ক শেষে ভোটাভুটি শুরু হয় ১০ মার্চ। কয়েক দিন ধরে ভোট চলে। মিয়ানমারবাসী হতাশ চোখে দেখল, প্রায় সব সংস্কার প্রস্তাবই একে একে বাতিল হয়ে গেল পার্লামেন্টে।

সংবিধান অনুযায়ী মিয়ানমারে পার্লামেন্টের ২৫ ভাগ আসন সশস্ত্র বাহিনী মনোনীত করে। সু চি ও তাঁর দল এনএলডি আগামী নির্বাচনে এটা ১৫ ভাগ, পরের নির্বাচনে ১০ ভাগ এবং ২০৩০ নাগাদ ৫ ভাগে নামিয়ে আনতে চেয়েছিল। এই প্রস্তাবের ভোটাভুটিতে এনএলডি ৪০৪ ভোট পায়। বিপক্ষে ভোট পড়ে ২২৯। বিপক্ষের ভোটদাতাদের মধ্যে আছেন সশস্ত্র বাহিনী থেকে আসা ১৬৬ পার্লামেন্ট সদস্য। সশস্ত্র বাহিনীর সমর্থক বেসামরিক কিছু রাজনৈতিক দলও প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। গুরুত্বপূর্ণ অন্য সব সংস্কার প্রস্তাবের ভোটের ব্যবধান এমন। সু চির পক্ষ ৫৭ থেকে ৬০ ভাগ সমর্থন পেয়েছে, যা সংবিধানের নিয়মমতো প্রয়োজনীয় ৭৫ ভাগ সমর্থনের চেয়ে কম।

মিয়ানমার পার্লামেন্টের এই ভোট দেশটির রাজনীতি ও সমাজকে বুঝতে গভীরভাবে সাহায্য করে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধিরা চাইলেও সংবিধানের গণতান্ত্রিক সংশোধন ঘটানো যাচ্ছে না সেখানে।

এনএলডিকে গত নির্বাচনে ১ কোটি ২৮ লাখ মানুষ ভোট দিয়েছিল। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে এই জনতা আবারও দেখল, পার্লামেন্টে তাদের প্রতিনিধিদের অভিমত সামান্যতম মূল্যও পেল না।

সশস্ত্র বাহিনী সংবিধানে এমন বিধান করে রেখেছে—যাতে ৭৫ ভাগ পার্লামেন্ট সদস্যের সমর্থন ছাড়া মৌলিক কোনো সংস্কারই করা যাচ্ছে না। আবার সশস্ত্র বাহিনী নিজেই দখল করে রেখেছে পার্লামেন্টের ২৫ ভাগ আসন।

পার্লামেন্টে এনএলডির আসন রয়েছে ৫৯ শতাংশ এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক দলগুলোর রয়েছে ১১ ভাগ আসন। অন্যদিকে সেনাবাহিনীর ২৫ ভাগ ছাড়াও তাদের সমর্থক দল ইউএসডিপির আসন রয়েছে ৫ ভাগ। অর্থাৎ সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে পার্লামেন্টে ৩০ ভাগ সদস্যকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এ রকম অবস্থায় ৭৫ ভাগ জনপ্রতিনিধির সমর্থন নিয়ে সংবিধান সংশোধন কোনো দিনই হবে না। আবার সংবিধানের যেকোনো পরিবর্তনে সশস্ত্র বাহিনীর ‘না’ বলে দেওয়ার চূড়ান্ত অধিকারও রয়েছে। এই ভেটো ক্ষমতার এখতিয়ারও আগের মতো তাদের হাতে রয়ে গেল। সংবিধানের এ–সংক্রান্ত ৪৩৬ নম্বর অনুচ্ছেদও ভোটাভুটিতে পাল্টাতে পারেনি এনএলডি।

তারপরও বিজয় দেখছে এনএলডি

পার্লামেন্টে সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাতিল হওয়ার প্রধান তাৎপর্য হলো সর্বোচ্চ ক্ষমতা ‘টাটমা-ড’ তথা সশস্ত্র বাহিনীর হাতেই থাকছে। মিয়ানমারে চালকের আসনে থাকছেন যথারীতি পাঁচ তারকা জেনারেল মিন অং হ্লাই। কখনো জরুরি অবস্থা জারি হলে সাংবিধানিকভাবেই ‘সার্বভৌম ক্ষমতা’ সরাসরি সশস্ত্র বাহিনীর এই ‘সিনিয়র জেনারেল’-এর হাতেই চলে যাবে। পার্লামেন্টের ভোটে এই বিধানও বদলানো যায়নি। তবে এনএলডি মনে করছে, পার্লামেন্টে তারা হেরে গেলেও মাঠের রাজনীতিতে এই ব্যর্থতা তাদের সুবিধা করে দেবে। এনএলডির এক নেতার ভাষায়, ‘পার্লামেন্টের ভোটের ফল সেনাবাহিনীর পক্ষে গেলেও এর রাজনৈতিক ফল ভালো হবে আমাদের জন্য!’ আন্তর্জাতিক অনেক ভাষ্যকারও মনে করেন, সু চিকে কিছু ছাড় না দেওয়া দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর জন্য দীর্ঘ মেয়াদে কৌশলগত ভুল। দেশে-বিদেশে তারা এখন গণতন্ত্রের পথে বাধা হিসেবে সহজে চিহ্নিত হবে।

রাষ্ট্র পরিচালনায় অসহায় সু চি

মিয়ানমারে এ পর্যন্ত তিনবার সংবিধান লেখা হয়েছে। এর মধ্যে নে উইনের সময় ১৯৬২ থেকে ১২ বছর সংবিধান ছাড়াই দেশ চালায় সেনাবাহিনী। সর্বশেষ সংবিধানও তাদের তৈরি। এই সংবিধানের মূল সমস্যা তিনটি। এতে মিয়ানমারকে একটা ‘জাতি’ হিসেবে উল্লেখ করে তার ‘একত্বের’ ওপর জোর দেওয়া হয়। তাতে দেশটির ফেডারেল চরিত্রের সর্বনাশ ঘটে। হারাতে বসেছে শান, কারেন, কাচিন, রাখাইনদের স্বায়ত্তশাসনের স্বপ্ন। ২০০৮ সালের এই সংবিধান রাষ্ট্র পরিচালনায় সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে বহুভাবে বৈধতা দিয়ে রেখেছে। বেসামরিক শাসন-সংস্কৃতির বিকাশে এটা দ্বিতীয় প্রধান সাংবিধানিক বাধা। দেশটিতে গুরুত্বপূর্ণ তিন মন্ত্রণালয় (স্বরাষ্ট্র, সীমান্ত ও প্রতিরক্ষা) সেনাবাহিনীর অধীনেই আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকছে। সু চির অসহায়ত্বের বড় জায়গা এটা। বিশ্ববাসী তাঁকে গালি দিতে গিয়ে অনেক সময়ই ভুলে যায়, মানবাধিকার দলনে সেনাবাহিনী সৃষ্ট আবর্জনাই বয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাঁকে।

সংবিধানের তৃতীয় প্রধান সমস্যা ‘নাগরিকত্ব’কে এই সনদ এমন অদ্ভুত এক আইনের অধীনে এনেছে, যার দ্বিতীয় নজির বিশ্বে নেই। সেই সূত্রেই সৃষ্টি হয়েছে রোহিঙ্গা–সংকট, যার ধারাবাহিকতায় দেশটির নেতারা এখন দ্য হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মোকদ্দমার মুখে। সংগত কারণেই ২০১৫ সালের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে এনএলডির প্রধানের প্রতিশ্রুতি ছিল সংবিধান পাল্টানো। কিন্তু তারা সেটা পারল না। এই ব্যর্থতা নিয়েই তারা আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে। নভেম্বরে যে নির্বাচন হওয়ার কথা।

তবে ২০১৫ সালের নির্বাচনের আগে আগে মিয়ানমারজুড়ে আশা-প্রত্যাশার যে ঢেউ বয়ে গিয়েছিল, এবার তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। এই নির্বাচনে জনগণকে দেওয়ার মতো ভালো কোনো প্রতিশ্রুতি নেই সু চির হাতে। তবে তাঁর দলই এই নির্বাচনে জিতবে। এনএলডির বিকল্প গড়ে ওঠেনি মিয়ানমারে। সু চির জন্য এ–ও বড় ট্র্যাজেডি হয়েই থাকছে, ২০২০ সালের নির্বাচনে জিতলেও তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। সংবিধানের এ–সংক্রান্ত ৫৯-চ ধারাটিও তিনি সংশোধন করাতে পারেননি পার্লামেন্টে। তাঁর প্রেসিডেন্ট হওয়া ঠেকাতেই সেনাবাহিনী সংবিধানে লিখে রেখেছে, ‘যারা বিদেশি বিয়ে করবে বা যাদের সন্তান বিদেশি নাগরিক হবে, তারা প্রেসিডেন্ট হতে পারবে না।’ সু চির প্রয়াত স্বামী বিদেশি ছিলেন। তাঁর দুই সন্তানও ব্রিটেনের বাসিন্দা হিসেবে সেখানে থাকছেন। সেনাবাহিনী একে ‘অপরাধ’ সাব্যস্ত করে বিধান করে রেখেছে।

পার্লামেন্টে মার্চের ভোটাভুটিতে সামরিক বাহিনীর কাছে এনএলডি যে সব প্রস্তাবেই হারবে, সেটা মিয়ানমারে কারও অজানা ছিল না। তারপরও এনএলডি ভোটাভুটিতে গিয়েছে আসন্ন নির্বাচনে জনগণকে এটা বলার জন্য, তারা সংবিধান সংশোধনের চেষ্টা করেও পারেনি।

তবে সংবিধান ও তার সংশোধনের চেষ্টা নিয়ে এভাবে যতই ‘রাজনীতি’ হোক, এই সংবিধান থাকাবস্থায় দেশটিতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারে অগ্রগতির কোনো সুযোগ নেই। এই সংবিধানকে ব্যবহার করে সামরিক আমলাতন্ত্র গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে এক কদমও এগোতে দেবে না।

গণতন্ত্রে আগ্রহী সেনানায়ক খুঁজছে এনএলডি

এনএলডি কোনো বিপ্লবী দল নয়, মধ্যপন্থা ও জাতীয়তাবাদই তার আদর্শ। তারপরও এই দল সংবিধানের সংশোধনী চেয়েছিল প্রায় ১১৪ জায়গায়। সব দল মিলে পার্লামেন্টে সংবিধানের সংশোধন প্রস্তাব ওঠে ১৩৫টি। এনএলডি তাদের প্রস্তাবগুলোর পক্ষে ৫০ লাখ মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিল। সবচেয়ে মৌলিক ও জরুরি সংশোধন প্রস্তাবগুলোর একটিও সেনা সমর্থন পায়নি। তুলনামূলকভাবে গুরুত্বহীন দুটি সংশোধন প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে কেবল। এনএলডির কৌশল থেকে স্পষ্ট—দলটি তাদের এই ব্যর্থতা নিয়েই রাজনৈতিক প্রচারযুদ্ধ চালাবে ভবিষ্যতে। হয়তো তারা এখন সংবিধান প্রশ্নে গণভোট চাইবে। এ ধরনের প্রচারণার মাধ্যমে তারা ফিলিপাইনের ফিদেল রামোস কিংবা ইন্দোনেশিয়ায় সুশিলো বামবাং ইয়ুধোইয়োনোর মতো সেনানায়কদের খুঁজছে, যিনি বা যাঁরা সশস্ত্র বাহিনীতে থেকেও গণতন্ত্রের বিকাশে অবদান রাখবেন।

সামরিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থেকেই জেনারেল রামোস বিগত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে স্বৈরশাসক মার্কোসের হাত থেকে ফিলিপাইনের গণতান্ত্রিক রূপান্তরে সাহায্য করেন, ফিলিপাইনের ইতিহাসে যা ১৯৮৬-এর ‘ইডিসা বিপ্লব’ নামে খ্যাত। ঠিক পরের দশকেই একই রকম ভূমিকা রেখেছিলেন ইন্দোনেশিয়ার প্রভাবশালী জেনারেল সুশিলো বামবাং, দেশকে জেনারেল সুহার্তোর ৩১ বছরের শাসন থেকে মুক্ত করতে।

আসিয়ানভুক্ত ওই দুই দেশে প্রশাসনকে সামরিক ছায়া থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে নিয়ে আসায় ওই দুই জেনারেলের তৎপরতার অনুরূপ কিছু খুঁজছে এনএলডি তাদের দেশে। মিয়ানমারও আসিয়ানভুক্ত দেশ। তবে বর্তমান জেনারেল মিন অং হ্লাই থাকাবস্থায় সেই সুযোগ নেই। ২ দফায় ৯ বছর হলো তিনি ওই পদে আছেন এবং আগামী বছর পর্যন্ত তাঁর মেয়াদ আছে। বিগত সময়ে তিনি রাজনৈতিক সংস্কারে কোনো আগ্রহ দেখাননি। ধারণা করা যায়, একই মনোভাবের কোনো জেনারেলকেই তিনি এই পদে রেখে যাবেন ভবিষ্যতে। যুক্তরাষ্ট্র জেনারেল শো উইনসহ মিন অং হ্লাইয়ের প্রধান তিন ঘনিষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাকে ‘কালো তালিকাভুক্ত’ করে তাঁকে বিব্রত অবস্থায় ফেলেছে। এদের কারোরই পরবর্তী ‘সিনিয়র জেনারেল’ হওয়ার কথা ছিল। তবে রেঙ্গুনে কান পাতলে শোনা যায়, আন্তর্জাতিক বিচারের হাত থেকে বাঁচতে জেনারেল মিন অং হ্লাই নতুন নির্বাচন শেষে ২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট হতে চাইবেন। সু চি এবং মিয়ানমার উভয়ের জন্য সামনের দিনগুলো তাই আরও জটিল।

‘৮৮৮৮ জেনারেশন’-এর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা

মিয়ানমারে আজকের শাসনতান্ত্রিক বদ্ধ অবস্থার কারণ খুঁজতে গেলে চিরায়ত এক রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতার নজির মেলে। ১৯৮৮ সালের এপ্রিলে আজকের সু চি যখন ‘বার্মা’য় ফিরে এসেছিলেন অসুস্থ মাকে দেখতে, তখন তিনি ছিলেন শুধুই ‘জেনারেল অং সানের মেয়ে’। এনএলডি বলে কোনো দলও ছিল না তখন। কিন্তু ছাত্র-তরুণদের আবেগ অক্সফোর্ডে রাজনীতি নিয়ে পড়া সু চিকে প্রভাবিত করছিল। তাঁদের সঙ্গে আকাঙ্ক্ষার মিল ঘটে তাঁর। সু চির সহানুভূতি পেয়ে রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়সহ ছাত্র-তরুণদের ঘাঁটিগুলো বিদ্যুতায়িত হয়ে ওঠে সেদিন। আধা গোপন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তখন বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও শামিল ছিলেন, আজ যা কল্পনাতীত।

এ রকম পটভূমিতেই ১৯৮৮ সালের ৮ আগস্ট সামরিক বাহিনীর শাসনের বিরুদ্ধে মিয়ানমারজুড়ে ছাত্র গণ-অভ্যুত্থান শুরু। ২৬ আগস্ট সু চি তাতে যুক্ত হন। সেপ্টেম্বরেই সামরিক বাহিনী গণহত্যা চালিয়ে সেই আন্দোলন স্তিমিত করে দেয়। শত শত ছাত্র সংগঠককে দীর্ঘ সময়ের জন্য কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়, একপর্যায়ে যা প্রায় ১০ হাজারে উপনীত হয়েছিল। অনেকে নির্যাতন থেকে বাঁচতে দেশ ছাড়ে। কেউ কেউ গোপনে সংগ্রাম অব্যাহত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যায়। সু চি নিজেও ১৯৮৯ থেকে ১৬ বছরের জন্য গৃহবন্দিত্বে নিক্ষিপ্ত হন, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দিয়ে বিশ্ব যে অধ্যায়ে সংহতি জানিয়েছিল। সেদিনের সংগ্রামীদের মিয়ানমারের সমাজ আজও ‘৮৮৮৮ জেনারেশন’ নামে শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে রেখেছে। প্রতিবছরই ৮ আগস্ট মিয়ানমারের ক্যাম্পাসগুলোতে অনেক স্মরণানুুষ্ঠান হয়। কিন্তু জান্তার তৈরি সংবিধান সংস্কারের ব্যর্থতা আসলে ‘৮৮৮৮ জেনারেশন’-এর সঙ্গে সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতাই।

১৯৮৮ সাল থেকে চলে আসা ওই গণতান্ত্রিক আন্দোলনেরই সর্বশেষ অর্জন ছিল ২০১৫ সালের নির্বাচন। প্রত্যাশা ছিল, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সরকার দেশটিকে নতুন সংবিধান দেবে, যা সামরিক আমলাতন্ত্রের দীর্ঘ ছায়া থেকে মিয়ানমারকে মুক্ত করবে। কিন্তু ২০২০ সালের মার্চে এসে সেটা দুরাশায় পরিণত হলো। ইতিমধ্যে দেশটির সেনাবাহিনী ভিক্ষু সংঘগুলোর মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদী মনোভাবের প্রবেশ ঘটিয়ে তাদের সঙ্গে এক অদৃশ্য আদর্শিক মৈত্রীর বন্ধন গড়েছে, যা দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চায় সু চিকে আরও দুর্বল করেছে।

এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়েই ‘৮৮৮৮ জেনারেশন’-এর অনেক ছাত্র-তরুণ সংগঠক পুরোনো রাজনৈতিক অঙ্গীকারকে সামনে এনে দেশজুড়ে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গড়ার উদ্যোগ চালাচ্ছেন। তবে সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি সু চির এনএলডিও সেটা চাইছে না। সংবিধান সংস্কারের ব্যর্থতা এই নতুন উদ্যোগের দিকে বিশ্ববাসীকে মনোযোগী করে তুলেছে। মিয়ানমারে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্য দিয়ে পরিবর্তনের শেষ আশা এখন কেবল ‘৮৮৮৮ জেনারেশন’। যদিও এই যুবারা দেশজুড়ে সামাজিক ও ভৌগোলিকভাবে অসংগঠিত অবস্থায় রয়েছে। সর্বশেষ পরিস্থিতি হয়তো তাদের সংঘবদ্ধ হতে কিছুটা অনুপ্রাণিত করবে।

সংখ্যালঘু জাতিসমূহের জন্য দুঃসংবাদ

মার্চের পার্লামেন্ট ভোট মিয়ানমারের ছোট ছোট জাতিসত্তার জন্য সরাসরি চপেটাঘাতসুলভ। জেনারেল অং সানের বিখ্যাত একটা প্রতিশ্রুতি ছিল, ‘বামাররা এক কিয়াত পেলে শান বা কাচিনরাও এক কিয়াত পাবে।’ অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় সম্পদ সমরূপে বণ্টিত হবে। কিন্তু তা হয়নি। গণতন্ত্রহীনতায় সেই না হওয়ার কথা বলাও যাচ্ছে না। দশকের পর দশক জাতিগত সংখ্যালঘুরা প্রশাসন ও সম্পদে ন্যায্য হিস্যার জন্য লড়ছে, জনসংখ্যায় যারা ৪৫ ভাগ। এসব জাতিসত্তা মিয়ানমারের জন্য এমন এক নতুন সংবিধান চাইছে, যেখানে দেশটি সত্যিকারের এক ‘ইউনিয়ন’ হয়ে উঠবে। দশকের পর দশক এসব দাবিতে আলোচনা চলছে।

কিন্তু যেহেতু সেনাবাহিনী পার্লামেন্টে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রায় ৩০ ভাগ আসন নিয়ন্ত্রণে রাখছেই, এ কারণে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে, সাংবিধানিক পথে ভবিষ্যতেও গণতান্ত্রিক একটা সংবিধান প্রণয়ন অসম্ভব হয়ে থাকছে। এতে শান, কারেন, কাচিন ও রাখাইন অঞ্চলে সশস্ত্র সংগ্রামের ধারাই আরও বেগবান হয়ে উঠবে বলে ধারণা করা যায়। প্রায় ১৮টি সংগঠন এ মুহূর্তে দেশটির বিভিন্ন স্থানে জাতিগত স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সশস্ত্র অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়নসহ ১০টির সঙ্গে সেনাবাহিনীর যুদ্ধবিরতি চলছে ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে। কিন্তু রাখাইনের ‘আরাকান আর্মি’, কাচিনের ‘কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মি’, শানের ‘ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি’ ও ‘টাঙ ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি’র মতো আটটি গ্রুপের সঙ্গে ‘টাটমা-ড’ নামে পরিচিত জাতীয় সেনাবাহিনীর থেমে থেমে যুদ্ধও চলছে। সংবিধান সংশোধন চেষ্টার অপমৃত্যু এ রকম গৃহযুদ্ধে বাড়তি জ্বালানি দিল। কারেনসহ অনেক জাতিসত্তা ‘যুদ্ধবিরতি’ থেকে যেকোনো সময় বেরিয়ে যেতে পারে বলেও মনে হচ্ছে।

জেনারেলরাও এটাই চাইছেন হয়তো। তাঁদের ভূমিকা যে দেশের ‘নিরাপত্তা’ ও ‘স্থিতিশীলতা’র জন্য অপরিহার্য এবং তার জন্য সাংবিধানিকভাবে তাদের হাতেই যে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকা উচিত—এটা দেখাতে আঞ্চলিক সশস্ত্রতা বেশ সুবিধাজনক। অর্থাৎ পুরো পরিস্থিতি মিয়ানমারের জন্য একটা ফাঁদে পরিণত হয়েছে। সিনিয়র জেনারেলরা গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করে রেখেছেন বলেই আঞ্চলিক জাতিগুলো নিয়মতান্ত্রিক পথে কিছু অর্জন করতে পারছে না; আবার তাদের সশস্ত্র প্রতিবাদকে পুঁজি করেই সশস্ত্র বাহিনী অভিভাবকসুলভ ভূমিকার ন্যায্যতা তুলে ধরছে।

স্বাধীনতার পর সাত দশক দেশটি সশস্ত্রতা ও গণতন্ত্রহীনতার এই দুষ্ট চক্রে পড়ে আছে। এই পরিস্থিতির পার্শ্বফল হিসেবে সমাজের সব পরিসরে শিকড় গেড়েছে সামরিক আমলাতন্ত্রের জবাবদিহিহীন প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব। দেশের উপরিকাঠামোতে বেসামরিক সরকার থাকলেও নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তাদের সীমিত, বিশেষ করে জননিরাপত্তা ও মানবাধিকার বিষয়ে। এই অবস্থার সবচেয়ে নির্মম শিকার সংখ্যালঘু অবামার মানুষেরা। স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ ও দলবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রীয় নীতির সংস্কারের দাবি তুলতে পারেন না তাঁরা। দীর্ঘ সেনা সংস্কৃতিতে এগুলো ‘অপরাধ’ হিসেবে সাব্যস্ত হয়ে আছে। সু চি এর ব্যতিক্রম ঘটাতে অনেকাংশেই ব্যর্থ। ইতিমধ্যে এ–ও স্পষ্ট, ২০১৫ সালের নির্বাচনের মতোই আগামী নভেম্বরের নির্বাচনেও মুসলমান জনগোষ্ঠী নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে থাকছে। অথচ অনানুষ্ঠানিক হিসাবে তারা দেশটির দ্বিতীয় প্রধান ধর্মীয় সংখ্যালঘু।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায় বেড়ে গেল

মিয়ানমারের পার্লামেন্টে গত সপ্তাহের ব্যর্থ আয়োজনের মধ্য দিয়ে সু চি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বোঝাতে চেয়েছেন, তিনি চাইলেও মিয়ানমারে রাজনৈতিক সংস্কার দুরূহ। এই বার্তা মিথ্যা নয়। আবার এ–ও সত্য, তিনি আপসের পথেই হেঁটেছেন ক্ষমতার শুরু থেকে; কিন্তু সফলতা আসেনি। এখন পার্লামেন্টের ভোটাভুটির মাধ্যমে বিশ্বকে তিনি দেখাতে পেরেছেন, দেশটিতে গণতন্ত্রের বিকাশে মূল সমস্যা তিনি নন, সশস্ত্র বাহিনী। অর্থাৎ মিয়ানমারের গণতন্ত্রের সংগ্রামের ভবিষ্যৎকে তিনি কিছুটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়দায়িত্ব ও অংশগ্রহণের দিকে ঠেলে দিলেন। বিশ্বসমাজকে তাঁর দেশ নিয়ে নতুন করে বোঝাপড়া এবং সেনা আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে চাপ প্রয়োগের তাগিদ রয়েছে তাঁর নতুন কৌশলে।

মিয়ানমারের পার্লামেন্টে মার্চের অভিজ্ঞতা দেখাল, রাজনৈতিক সংস্কারে দেশটির সেনাবাহিনীর অঙ্গীকার ও সমর্থন ছাড়া বিকল্প নেই। সংবিধানের বর্তমান কাঠামোতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সবাই অর্থাৎ পার্লামেন্টের ৭৫ ভাগ সদস্য চাইলেও গণতন্ত্রের স্বার্থে কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়—যদি না সেনাবাহিনীর (অনির্বাচিত) এমপিরা তাতে সম্মতি দেন। এই অর্থে মিয়ানমারে পূর্ণ এক সেনাশাসনই চলছে, যদিও তার ধরন অভিনব। সরকার ব্যবস্থার বাহ্যিক স্বরূপ দেখে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র ও কর্তৃত্ব সম্পর্কে মোটেই ধারণা পাওয়ার উপায় নেই সেখানে।

এই অবস্থায় মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের কেবল দুটি পথই খোলা থাকছে, দেশের ভেতর জনগণের পক্ষ থেকে আন্দোলনের মাধ্যমে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের মাধ্যমে। যেসব অঞ্চলে তীব্র গৃহযুদ্ধাবস্থা, সেখানে মানবিক বিপর্যয় রোধ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কেবল সু চিকে দোষারোপ করে, আর তাঁকে দেওয়া পদক কেড়ে নিয়েই দায়িত্ব শেষ করতে পারে না। দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে আন্তর্জাতিক বোঝাপড়া না এগোলে মিয়ানমার মানবাধিকার দলনের বধ্যভূমিই হয়ে থাকবে আরও অনেক কাল। সংবিধান সংশোধনে এনএলডির ব্যর্থতা বাংলাদেশের জন্যও অতি খারাপ বার্তা। রোহিঙ্গা সমস্যার ফয়সালায় বাংলাদেশ যদি ‘দ্বিপক্ষীয়’ পথে এগোতে চায়, তাহলে সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাই ও তঁার সহযোগীদের সঙ্গেই দর-কষাকষি করতে হবে, যা বিব্রতকর। বিশ্বজুড়ে এই শক্তির বিরুদ্ধে রয়েছে গণহত্যার মতো অভিযোগ। অনেকেই ইতিমধ্যে ‘কালো তালিকাভুক্ত’। কিন্তু বাংলাদেশের সামনে বিকল্প কী?

কক্সবাজারের উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতেও মিয়ানমার পার্লামেন্টের সর্বশেষ ভোটাভুটির ফলাফল হতাশার নতুন মেঘই কেবল প্রসারিত করেছে।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক