করোনায় করণীয়

করোনাভাইরাসের ভয়াল ছায়া জনজীবনে কী মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে, মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলা অবরুদ্ধ হওয়ার ঘটনা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। গত এক মাসে ওই উপজেলার ৬৮৪ জন ইতালিপ্রবাসী দেশে ফিরলেও কোয়ারেন্টিনে গেছেন মাত্র ২১৩ জন। সারা দেশে এ রোগে আক্রান্ত ২০ জনের ৮ জনই শিবচরের বাসিন্দা। স্থানীয় প্রশাসন ভয়াবহ বিপদের আশঙ্কায় ওষুধ ও মুদিদোকান ছাড়া সবকিছু বন্ধ করে দিয়েছে। জনজীবন প্রায় স্থবির।

এ রকম পরিস্থিতি অন্যত্র হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। কেননা গত দুই মাসে শুধু শিবচরের বাসিন্দারাই বিদেশ থেকে আসেননি; গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, প্রতিদিন গড়ে সাত হাজার লোক বাইরে থেকে এসেছেন; যার একটা বড় অংশ কোয়ারেন্টিনের বাইরে থেকে গেছেন। এখন পর্যন্ত সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তা অপ্রতুল এবং অনেক ক্ষেত্রে অকার্যকরও। করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রধান উপায় হলো আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়ানো। গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সমাবেশ বন্ধের ঘোষণা যখন এসেছে, এর এক দিন আগে লক্ষ্মীপুরে বিশাল ধর্মীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়, যাতে লক্ষাধিক মানুষ
অংশ নিয়েছে। অথচ সৌদি আরবসহ বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশ ভিড় এড়াতে নাগরিকদের ঘরে নামাজ আদায়ের পরামর্শ দিয়েছে। সরকারের মন্ত্রীরাই এখন বলছেন, বিদেশ প্রত্যাগতদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাই বড় ব্যর্থতা। ইতিমধ্যে বিদেশ প্রত্যাগত হাজার হাজার মানুষ দেশে ফিরে জনজীবনে মিশে গেছেন। চোর পালানোর পর গৃহস্থের হুঁশ ফিরে এলে কোনো লাভ নেই।

পরিস্থিতি মোকাবিলায় অনেক দেশ ‘যুদ্ধাবস্থা’ ঘোষণা করেছে। প্রতিবেশী ভারতেও ‘জনতার কারফিউ’ জারি করা হয়েছে। এসবের মাধ্যমে জনগণকে বাইরে বের হতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, কিন্তু আমাদের এখানে একধরনের লুকোচুরি চলছে। যেখানে সরকারই পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে অপারগ, সেখানে তারা জনগণকে সচেতন করবে কীভাবে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলছেন, অনেকের জেল–জরিমানাও হয়েছে। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার, তা আগেই হয়েছে। যথাসময়ে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করে এখন আফসোস করলে খুব বেশি ফল পাওয়া যাবে না।

পরিস্থিতি যেদিকে মোড় নিচ্ছে, তাতে নাগরিক মাত্রেরই উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা; কিন্তু সরকারের কাজকর্মে সেই উদ্বেগের ছায়া নেই। সবকিছু ঢিমেতালে চলছে। আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগের ভঙ্গুরতা গত বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের সময়ই প্রকটভাবে ধরা পড়ে। করোনাভাইরাস ডেঙ্গুর চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক। প্রতিষেধক দূরের কথা, রোগটি পরীক্ষা করার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও আমাদের হাতে নেই।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সরকারের জরুরি কাজকর্ম চলবে। এ বিষয়ে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু ‘ডিজিটাল’ বাংলাদেশে সেই কাজ করতে কেন অফিসে যেতে হবে, একসঙ্গে বসে বৈঠক করতে হবে? কেন বাসায় বসে বা সহকর্মীদের সংস্রব থেকে দূরে থেকে দাপ্তরিক কাজকর্ম করা যাবে না? যেখানে করোনার সংক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় হলো যথাসম্ভব মানুষের সংস্পর্শ এড়ানো, সেখানে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পেশাগত—সব কাজেই বিকল্প উপায়ের কথা ভাবতে হবে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত সেই বার্তা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে আমরা বলব, ‘আমি আপনার জন্য হাসপাতালে বা কর্মক্ষেত্রে আছি, আপনি আমার জন্য ঘরে থাকুন।’