ইতালিফেরত যুবকের সিস্টেম নিয়ে প্রশ্ন

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ইতালিফেরত এক যুবকের ক্ষোভ নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল বাংলাদেশ। তিনিসহ আরও অনেক বাংলাদেশি যাত্রী প্রায় ২০ ঘণ্টা ভ্রমণ করে দেশে এসেছিলেন। আরও কয়েক ঘণ্টা আনুষ্ঠানিকতার পর তাঁদের নেওয়া হয় আশকোনা হজ ক্যাম্পে। করোনা সন্দেহে তাঁদের কোয়ারেন্টিন করার কথা বলা হয় সেখানে। অনেকেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এতে। নীল গেঞ্জি পরা এক যুবক ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ‘আই..., ...ইয়োর বাংলাদেশ সিস্টেম।’ তাঁর বক্তব্য, এ দেশের সিস্টেমটা...সিস্টেম!

করোনায় মহামারি লেগে যাওয়া ইতালি থেকে ফিরলে অবশ্যই কোয়ারেন্টিনে যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা আরও অনেক উন্নত হওয়া প্রয়োজন, প্রয়োজন দীর্ঘ সফর শেষে উৎকণ্ঠিত যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও তাঁদের গ্রহণ করার সুব্যবস্থাও। এসব নিয়ে বিতর্ক নেই তেমন, থাকার কথাও নয়। কিন্তু ফেসবুকে অনেক মানুষ খেপে গেছে শুধু নীল গেঞ্জি যুবকের কথাগুলো শুনে। কারও কারও দেশপ্রেমে আঘাত লেগেছে, কেউ আবার দেশের প্রতি এই অপমানে নানা অবর্ণনীয় পন্থায় যুবকটিকে, এমনকি ইতালিফেরত সবাইকে শাস্তি দেওয়ার সুপারিশ করেছেন।

আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ লেগেছে বিষয়টা। মনে হয়েছে এ থেকে আমাদের মধ্যবিত্ত মানসিকতার কিছু বিশ্লেষণ প্রয়োজন। প্রয়োজন করোনা নিয়ে কিছু সত্যভাষণও। প্রয়োজন সিস্টেমটা আসলে কেমন, সেটা নিয়ে একটু আলোচনার।

২.

প্রথমে বলে রাখি, আমিও জানি যে ওই যুবকের ব্যবহৃত শব্দগুলো সামাজিকভাবে নিন্দনীয় ও বর্জনীয়। তবে পাশ্চাত্যে বহু বছর ধরে রাগ, ক্ষোভ, হাসি-ঠাট্টায়, এমনকি ভালোবাসার তীব্রতা বোঝাতে শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে ক্রমেই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে। লিন্ডন জনসন থেকে শুরু করে ডিক চেনি পর্যন্ত বহু আমেরিকান রাজনীতিবিদ এটি ব্যবহার করেছেন প্রকাশ্যে। সরকারের নীতিতে ক্ষুব্ধ হয়ে এমন শব্দ ব্যবহার করার নজির আছে বহু দেশের প্রতিবাদ সমাবেশে।

এটি এমনকি দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে থাকা বাংলাদেশের অনেক মানুষের মধ্যেও বহুল ব্যবহৃত। আমার নিজের প্রবাসজীবনে তা বহুবার দেখেছি। তারপরও শব্দটির ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু এটি বুঝে নিতে কারও সমস্যা থাকার কথা নয় যে ইতালিফেরত যুবক শব্দটি ব্যবহার করেছেন দেশের সিস্টেমের প্রতি তাঁর তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করার জন্য। দেশের প্রতি ক্ষোভ বা অবমাননা এটি নয়। সিস্টেমের প্রতি তীব্রতম ক্ষোভ প্রকাশ থেকেই তো আমরা আমাদের দেশে একসময় বহু হিরণ্ময় পরিবর্তন এনেছিলাম। সিস্টেমের প্রতি ক্ষোভ মানে দেশের প্রতি ক্ষোভ নয়।

আমার মূল প্রশ্ন হচ্ছে, এ দেশের সিস্টেম কি সত্যি খুব উত্তেজিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার মতো নয়? ইতালিফেরত যুবকের ক্ষোভ প্রকাশে শব্দপ্রয়োগটা শুধু দেখলাম কেন আমরা? কেন আলোচনা করলাম না বার্তাটা নিয়ে?

৩.

ইতালির ঘটনার জের টেনে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রবাসীদের সম্পর্কে ঢালাওভাবে একটি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বিদেশ থেকে ফিরে প্রবাসীরা ‘নবাবজাদা’ হয়ে যান। তাঁর মন্তব্যে অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাঁদের মূল বক্তব্য হচ্ছে প্রবাসীরা ‘নবাবজাদা’ই, তাঁরা নবাবজাদার মতো ব্যবহার পাওয়ার যোগ্য। আমি নিজে লিখেছি নবাবজাদা হওয়া হারামজাদা হওয়ার চেয়ে অনেক ভালো। প্রবাসীরা বিদেশে কষ্ট করে টাকা পাঠিয়ে দেশটাকে টিকিয়ে রেখেছেন। আর হারামজাদারা দেশ থেকে টাকা পাচার করে দেশের বারোটা বাজাচ্ছে। আমার দুঃখ হচ্ছে, হারামজাদারা এ দেশে পায় ভিআইপি মর্যাদা আর প্রবাসীরা পান তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অপমান, অবমাননা।

কিছু প্রবাসী প্রশ্ন তুলেছেন আরও বিভিন্ন মৌলিক বিষয়ে। তাঁরা রাতের ভোট, লাখো কোটি টাকা পাচার, গুম-খুন, সাবেক প্রধান বিচারপতির পরিণতি, বিচার বিভাগ, আর্থিক খাত, শিক্ষাব্যবস্থাসহ বহু উদাহরণ টেনে দেশের সিস্টেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্ন তুলছেন বিদেশে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের সন্তানদের পোরশে, বিএমডব্লিউ গাড়ি চালানো নিয়ে, অকাতরে তাঁদের টাকা ছড়াতে দেখে। জানতে চেয়েছেন এসব কোন সিস্টেমের লক্ষণ?

প্রবাসীরা নিজেদের স্বজন আর দেশকে ভালোবেসে কষ্টের টাকা পাঠান দেশে। তাঁদের সেই রেমিট্যান্সেই আসলে টিকে আছে এ দেশ। তাঁদের প্রশ্ন, সেই প্রবাসীদের যখন পাসপোর্ট নিতে গেলে টাকা দিতে হয়, এয়ারপোর্টে হয়রানি করা হয়, ব্যাগ ধরে টানাটানি করা হয়—এটা কেমন সিস্টেম?

তাঁরা সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন তুলেছেন করোনা নিয়ে আমাদের প্রস্তুতিতেও। প্রশ্ন তুলেছেন আমাদের সিস্টেম নিয়ে, করোনা মোকাবিলায় সেই সিস্টেমের অপ্রতুল, করুণ ও হাস্যকর অবস্থা নিয়ে। আমরা কি এখন একটু সৎভাবে আত্মবিশ্লেষণ করতে পারি এটি নিয়ে?

৪.

করোনা নিয়ে বহু কথা মানুষ বলছে, বহু কিছু লেখা হচ্ছে। সর্বজনস্বীকৃত কিছু বিষয় হচ্ছে: ক) করোনাভাইরাস ভয়াবহ ছোঁয়াচে। সাপোর্টিং কেয়ার দেওয়া ছাড়া এর কোনো চিকিৎসা নেই, সংক্রমণ বন্ধ করেই একে প্রতিরোধ করতে হবে। খ) এ জন্য রোগ শনাক্ত করতে হবে, শনাক্তকৃত বা যথেষ্ট সন্দেহভাজনদের (যেমন ইতালি থেকে আসা ব্যক্তিদের) আলাদা রাখার সুব্যবস্থা করে তদারকি, শুশ্রূষা ও চিকিৎসা দিতে হবে। গ) সংক্রমণের সামান্য লক্ষণ দেখামাত্র নিজেকে বাসায় বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে, যেন অন্য কেউ সংক্রমিত না হয়। অন্তত ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে এটি নিজে নিজে ভালো হয়ে যাবে। ঘ) গুরুতর অবস্থা হলে রোগীকে হাসপাতালে সাপোর্টিং কেয়ার (যেমন অক্সিজেন) দিতে হবে, এসব রোগীর জন্য হাসপাতালে সম্পূর্ণ পৃথক ব্যবস্থা রাখতে হবে। ঙ) করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকেন চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীরা। তাঁদের নিরাপত্তার জন্য প্রটেকটিভ গিয়ারসহ সব সরঞ্জাম দিতে হবে।
চ) এই সংকটের কারণে জীবন–জীবিকা হারিয়ে নিঃস্ব মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের শোচনীয় অবস্থা লাঘবে সামাজিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। এটিকে করোনা প্রতিরোধের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখতে হবে।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয় চীনের অনেক পরে। ফলে সরকারের কাছে অন্তত মাস দুয়েক সময় ছিল এসব ব্যবস্থা নেওয়ার। কিন্তু বারবার ‘করোনা মোকাবিলায় প্রস্তুত আছি’ বলেও সরকার প্রায় কিছুই করেনি। প্রায় ১৮ কোটি লোকের এ দেশে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের কিট দুই হাজার মাত্র! দুদিন আগপর্যন্ত করোনা শনাক্তকরণের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল একটিমাত্র জায়গায়। দেশের সেরা সরকারি হাসপাতালটিতে আলাদা রেখে চিকিৎসা করার জন্য নির্ধারিত জায়গায় দরজা–জানালাই লাগানো হয়নি এখনো। দেশের কোনো চিকিৎসাকর্মীর জন্য নেই নিরাপদ পোশাক। শুধু এসব তথ্য কি যে কারও আক্কেলগুড়ুম করে দেওয়ার মতো নয়?

যদি এর সঙ্গে বিভিন্ন খাতে সরকারের দুর্নীতি, অপচয় আর বাহুল্যের প্রসঙ্গ টানি, তাহলে সরকারকে অবশ্যই প্রশ্ন করা উচিত, মানুষের জীবন–মৃত্যু নিয়ে এ নিদারুণ অবহেলার অধিকার কে দিল তাদের?

কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, এ প্রশ্ন তোলার মতো কোনো জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সংসদও নেই এ দেশে। আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, এ নিয়ে মুক্ত আলোচনা করার সাহস বা সামর্থ্য পর্যন্ত নেই গণমাধ্যমের। আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, এ নিয়ে যৌক্তিক কিছু প্রশ্ন তুললে জেল-জুলুমের ভয় আছে এ দেশে।

সু–উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা আর তথ্যপ্রযুক্তির দেশগুলো আতঙ্কে চুপসে গেছে করোনায়। দেশে দেশে প্রতিদিন ২০-৩০ হাজার শনাক্তকরণ পরীক্ষা হচ্ছে, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, যুদ্ধ প্রস্তুতির ঘোষণা এসেছে, করোনাকে মানবতার বিরুদ্ধে শত্রু হিসেবে ঘোষণা এসেছে। এমন একটা দুর্যোগময় সময়ে এ দেশে বিশাল জনসমাগম করে আতশবাজির উৎসব হয়েছে সরকারের উদ্যোগে, আগামী সংসদ অধিবেশন ডাকা হয়েছে ঐতিহাসিক বিষয় আলোচনার জন্য।

এসব কী ধরনের সিস্টেমের পরিচয়? এই সিস্টেমকে লাথি মারতে, তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করে না আপনার?

ইতালিফেরত যুবক আর দেশ–বিদেশের বহু মানুষ এসব কথাই বলছে। শব্দপ্রয়োগটা ভিন্ন, বার্তাটা একই রকম। বার্তাটির দিকেই আমাদের মনোযোগ দেওয়া শ্রেয়।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক