রোহিঙ্গা বিষয়ে কোনো 'আমরা-ওরা' নয়

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

বাংলাদেশের ৩৩টি ক্যাম্পে ১০ লাখের মতো রোহিঙ্গা আশ্রিত। ক্যাম্পগুলোর ঘনবসতি বিপজ্জনক ধরনের। গাদাগাদি পরিবেশে তাঁদের বাস। এতটাই গা লাগোয়া যে তাঁদের করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি স্বাভাবিকভাবেই অন্য যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে বেশি। তাই একবার করোনা সংক্রমণ শুরু হলে নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়বে। তা ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই নতুন রোহিঙ্গা মিয়ানমারের ফাঁক-ফোকর গলে বাংলাদেশে ঢুকছেন। মিয়ানমারের অর্থনীতির সিংহভাগই চীননির্ভর হওয়ায় দেশটি নিশ্চিতভাবেই করোনাঝুঁকিপ্রবণ। মিয়ানমারের কী অবস্থা তা আমরা জানি না। কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রচরিত্রের কারণে দেশটিতে তথ্যপ্রবাহ অবাধ নয়, দুনিয়াবাসী এখনো জানে না দেশটিতে আসলে কতজন করোনায় সংক্রমিত বা কতজন ইতিমধ্যে মারা গেছেন।

মিয়ানমারের বন্ধুদেশ চীনও তথ্য গোপন করে। করোনার শুরুটাও যেহেতু চীনেই হয়েছে, প্রতিদিন মিয়ানমারে অসংখ্য চীনা ব্যক্তির অবাধ যাতায়াতের মাধ্যমে দেশটিতে করোনা ছড়িয়ে পড়াই স্বাভাবিক। এদিকে উত্তর কোরিয়া এশিয়ার একঘরে রাষ্ট্র হলেও মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রটিও সম্পূর্ণই একনায়কত্বের অধীন হওয়ায় কোনো তথ্যই বাইরের জগতে আসে না। ১৯৮৪ সালে মিয়ানমারের শত্রুরাষ্ট্রে পরিণত হলেও ২০০৭ সালে সমর এবং প্রতিরক্ষাবিষয়ক ব্যবসায়িক ও কূটনৈতিক স্বার্থে মিয়ানমার উত্তর কোরিয়াকে আপন করে নেয়। এই সুবাদে অনেক উত্তর কোরীয় মিয়ানমারে যাতায়াত করে। তাই এটি সহজেই অনুমান করা যায় যে মিয়ানমারে অবশ্যই করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু আছে।

এসব কারণে কক্সবাজারের স্থানীয়দের কাছে আর একজন নতুন রোহিঙ্গারা আশ্রয়প্রার্থীও গ্রহণীয় নয়। স্থানীয়রা বরাবরই রোহিঙ্গাবিদ্বেষী। বিদ্বেষ দিনে দিনে শুধু বাড়ছেই। আশ্রয়প্রাপ্তদের বিষয়েও তাঁদের অসংখ্য অভিযোগ-অসন্তোষ। পাল্লা দিয়ে কট্টর রোহিঙ্গাবিরোধী প্রচার-প্রচারণা এবং গুজবও ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভীতি-আতঙ্ক এবং নিরাপত্তাহীনতার দুশ্চিন্তা বাড়ছে। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি যে তাঁরা মন ছোট করে আছেন। সমান ভীতসন্ত্রস্তও। তাঁদের আশঙ্কা এই যে তাঁদের মধ্যে একটিও যদি করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে, সব দোষ এসে পড়বে রোহিঙ্গাদের ঘাড়ে। স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া সে ক্ষেত্রে খুবই অমানবিক হয়ে উঠতে পারে। শারীরিক আক্রমণসহ কত রকম নিগ্রহের শিকার যে হতে হয়, সেই আশঙ্কায় তাঁরা ভীত।

স্থানীয়দের রোহিঙ্গাবিদ্বেষের সঙ্গে অন্য আরেকটি ধারণা যুক্ত হওয়ায় রোহিঙ্গাদের ভীতিটি সীমাহীন হয়ে উঠছে। তারা শুনেছে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর চারপাশে তারকাঁটার সীমান্ত দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। খবরটি রোহিঙ্গাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ায় তাদের ভয়, সম্ভবত একটি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প তৈরি হতে চলেছে। অনুমেয় যে এই কারণে অনেকেই আপ্রাণ চেষ্টা করবে ছলে-বলে কলে-কৌশলে যেভাবেই হোক ক্যাম্পের বাইরে চলে আসার। এভাবে একজন করোনাভাইরাসের বাহকও স্থানীয় জনপদে মিশে গেলে কিন্তু বিপদ বহু গুন বাড়বে, কমবে না।

অত্যন্ত স্বস্তির বিষয় এই যে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনসহ রোহিঙ্গা বিষয়ে দায়িত্বরত জনপ্রশাসন, দাতা সংস্থা এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এই বাস্তবতাকে আমলে নিয়েছে। তাঁরা নিরলস চেষ্টা চালাচ্ছেন করোনা সংক্রমণ যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। কক্সবাজারে খোঁজ নিয়ে জেনেছি ক্যাম্পগুলোয় ব্যাপক প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। সচেতনতামূলক কর্মসূচির জন্য যা যা করা দরকার, সবই করা হচ্ছে। ক্যাম্পগুলোয় পর্যাপ্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার সরবরাহ করা হয়েছে। পরিচ্ছন্নতা রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত পানি ও সাবানের জোগানও নিশ্চিত করা আছে। কোয়ারেন্টিনের জন্য ব্যবস্থাসহ হাসপাতালের ২০০ আসন চিকিৎসাসেবার জন্য প্রস্তুত রাখা আছে। জেলা প্রশাসন অবশ্য একটি অনবধানতাজনিত অসতর্কতা দেখিয়েছে। কোয়ারেন্টিনের সুবিধার জন্য স্কুল-কলেজ বন্ধ করবার পর কিছু অসাবধানী নাগরিক যে সপরিবার সমুদ্রবিলাসে বেরোবে, আগেভাগে ধারণা করতে পারেনি সম্ভবত। পর্যটকরাও যে জনঘন সৈকতে কিছু মানুষের মধ্যে করোনা ছড়িয়ে দিয়ে আসেননি, সে কথা কি জোর দিয়ে বলার জো আছে?

কক্সবাজার এলাকায় এসব প্রশংসনীয় উদ্যোগের পর কিছু কিছু স্থানীয় মানুষের রোহিঙ্গাবিদ্বেষী মনোভাব যেন আরও উগ্র হয়ে উঠেছে। তারা ‘ওরা-আমরা’ প্রসঙ্গ টানছেন। ‘ওরা সব সুবিধা পাচ্ছে আমাদের বিপদে ফেলার মধ্য দিয়ে’—এই রকম একটি মনোভাব বেশ সবল রূপ নিচ্ছে। ফোনালাপে স্থানীয়দের উষ্মার কথা জানালেন একজন। তাঁদের আক্ষেপ বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের মূল নাগরিকদের সুরক্ষার কোনো কার্যকর ব্যবস্থাই যেখানে দৃশ্যমান নয়, সেখানে রোহিঙ্গাদের করোনামুক্ত রাখার কর্মসূচিগুলো বাড়াবাড়ি নয় কি?

উত্তরটি যে ‘না’ হবে সেটি বুঝিয়ে বলার জন্য এই আলাপের অবতারণা। করোনা সমস্যার বেলায় ‘আমরা-ওরা’ কিংবা ‘আমাদের-ওদের’ বিভাজনটি আনার কোনোই সুযোগ নেই। কারণ, করোনা সারা পৃথিবী হতেই এই ব্যবধান ঘুচিয়ে দিচ্ছে। স্থানীয়রা বরং কয়েকটি বাস্তবতাকে আমলে নিন—

এক, আনুমানিক ১০ হাজার মানুষ বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে বৈধ-অবৈধ ব্যবসায় জড়িত। তাদের মধ্যে একটি বড় অংশ ইয়াবা চোরাচালানে জড়িত। অল্প কিছু রোহিঙ্গা জড়িত থাকলেও এই দশ হাজার মানুষের বেশির ভাগই কক্সবাজার ও টেকনাফের স্থানীয় মানুষ। অর্থাৎ সংক্রমণ স্থানীয় অ-রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। এটি ঠিক যে নতুন একজন রোহিঙ্গার আগমনও ঠেকিয়ে দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

দুই, রোহিঙ্গাদের কারণে করোনা থেকে নিজেদের মুক্ত রাখার সুযোগ ও সম্ভাবনাই বরং অনেক বেশি। সুযোগটি এই যে রোহিঙ্গারা আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা কর্মসূচির হকদার। তারা অগ্রাধিকারমূলকভাবে আন্তর্জাতিক দাতা ও সাহায্য সংস্থার সহায়তা পাওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত। তাঁদের বিপদমুক্ত রাখতে গিয়ে যে ব্যবস্থা, স্থানীয়দের জন্যও একই ব্যবস্থাই থাকছে। উপরন্তু, একটি পলিসি আছে যে রোহিঙ্গাদের জন্য দাতা ও উন্নয়ন সংস্থা যেসব সহায়তা-সুবিধা দেবে বা প্রকল্প ব্যয় করবে, তার অন্তত ৩০ শতাংশ স্থানীয়দের উন্নয়নে ব্যয় করতে হবে। ফলে অ-রোহিঙ্গা স্থানীয় জনগোষ্ঠীও সমানভাবেই উপকৃত হচ্ছে। তাহলে ‘আমরা-ওরা’ বিভাজনের মাধ্যমে বিদ্বেষ ও ঘৃণা জিইয়ে রেখে কী লাভ?

তিন, সংক্রামক রোগ সারা বিশ্বকেই বিপর্যস্ত করে, কোনো ‘আমরা-ওরা’ মানে না। সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের জন্য তাই বিশ্বমানবতার বিকল্প হয় না। এই প্রসঙ্গে সকলেরই কিউবার অতি সাম্প্রতিক ঘটনাটি হতে শিক্ষাগ্রহণ দরকার। ব্রিটেনের একটি জাহাজে ৭০০ জন যাত্রী ছিল। তাদের মধ্যে পাঁচজনের করোনা ভাইরাস সংক্রমণ হয়েছিল। আমেরিকা, বাহামা এবং বার্বাডোজের কোনো বন্দর জাহাজটিকে নোঙর করতে দেওয়া দূরের কথা তাদের বন্দর সীমার কাছাকাছিও ঘেঁষতে দেয়নি। কিউবা জাহাজটিকে শুধু ভিড়তেই দেয়নি, সাদর সম্ভাষণ জানিয়েছে। যাত্রীদের বন্দরেও নামতে দিয়েছে। প্রত্যেক যাত্রী প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা পেয়েছে। যাত্রীদের করোনা আশঙ্কামুক্তি নিশ্চিত হওয়ার পর ১৯ মার্চ জাহাজটি ব্রিটেনে ফিরে যাওয়ার যাত্রা শুরু করে দিয়েছে।

ঘটনাটি উল্লেখ করার কারণ কিউবা কর্তৃপক্ষ সারা বিশ্বে মানুষকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে বিশ্বের প্রতিটি মানুষই স্বাস্থ্য-সুরক্ষার অধিকার রাখে। এই অধিকার স্থান-কাল-পাত্র-গোত্র-বর্ণনির্বিশেষে পৃথিবীর সব মানুষের বৈশ্বিক অধিকার। ভাইরাস যেহেতু পৃথিবীর কোনো সীমান্ত মানে না, আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা পাওয়ার ক্ষেত্রে সীমান্ত কেন বাধা হয়ে উঠবে?

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ এলেই যাঁরা ঠিক মানবিক থাকতে পারেন না, তাঁরা কিউবার উদাহরণটি মাথায় রেখে হলেও বুঝতে চেষ্টা করুন যে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগণের করোনা-সতর্কতা ও প্রতিরোধ-পরিকল্পনা বাংলাদেশের মূল জনগোষ্ঠীর জন্য গৃহীত পরিকল্পনার মতোই হওয়া প্রয়োজন। মূল ভূখণ্ডের মানুষদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্যই বেশি প্রয়োজন।

হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান; এবং গবেষক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়