করোনা সংক্রমণ: রোগ নির্ণয় ও গবেষণার পথ উন্মুক্ত করুন

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স
>

আমরা জানি না আমাদের দেশে যে করোনাভাইরাস এসেছে, তার স্বরূপ কী? প্রকৃতি কী? উৎপত্তিস্থল কোথায়? কোন ধরনের প্রোটিন বা বিষক্রিয়া তারা তৈরি করে? কী কী জিন তার মধ্যে আছে? কোন দেশের করোনাভাইরাসের ডিএনএ তথা জেনেটিক গঠনের সঙ্গে তার মিল-ইতালি, চীন, ফ্রান্স নাকি ইরান? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা জরুরি। লিখেছেন আদনান মান্নান, মোহাম্মদ রেজওয়ানুল হক, এ এম এ এম জুনায়েদ ছিদ্দিকী।

কোভিড-১৯-এর আক্রমণে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত দুজনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে ২০ জন। বলা হয়ে থাকে, এ ভাইরাসে আক্রান্ত এক ব্যক্তি থেকে আরও অন্তত ২.৫ জন মানুষ আক্রান্ত হয়। অর্থাৎ যদি ২০ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়, তাহলে আসলে মোট ৫০ জন ইতিমধ্যে আক্রান্ত। কিন্তু আমরা এখনো জানি না আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসা মানুষের কী অবস্থা। আমরা জানি না আমাদের দেশে যে করোনাভাইরাস এসেছে, তার স্বরূপ কী? প্রকৃতি কী? উৎপত্তিস্থল কোথায়? কোন ধরনের প্রোটিন বা বিষক্রিয়া তারা তৈরি করে? কী কী জিন তার মধ্যে আছে? কোন দেশের করোনাভাইরাসের ডিএনএ তথা জেনেটিক গঠনের সঙ্গে তার মিল—ইতালি, চীন, ফ্রান্স নাকি ইরান?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা জরুরি। কারণ, এই তথ্যগুলো ছাড়া কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি পরামর্শ দেওয়া চিকিৎসকদের জন্যও একটু কষ্টসাধ্য হবে। এমনকি জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদেরও এই তথ্যগুলো জানতে হবে যেন এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া যায় এবং প্রতিরোধের জন্য কোন দেশের কার্যক্রমকে অনুসরণ করা হবে, তা নির্ণয় করার জন্য। আর এই তথ্যগুলো জানার জন্য এখনই, ঠিক এখনই কোভিড রোগ নির্ণয় ও প্রতিরোধের সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্ব দিতে হবে গবেষণা কার্যক্রমকে।

কয়েক দিন ধরে হইচই পড়ে গেছে কোভিড-১৯ শনাক্তকরণের পর্যাপ্ত রাসায়নিক তথা কিট আমাদের কাছে নেই। বলা হচ্ছে, এই রোগ নির্ণয়ের জন্য দক্ষ জনবল আমাদের নেই। অনেকে বলছে, ল্যাবরেটরি আমাদের নেই। আসলেই কি সত্যি? নভেল করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত আরটি পিসিআর পদ্ধতিকেই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। কোভিড-১৯ কিংবা নভেল করোনাভাইরাস যে নামেই ডাকি না কেন, এর প্রায় ৩০ হাজার নিউক্লিওটাইড অণু রয়েছে এবং এসব নিউক্লিওটাইড মিলে তৈরি করে ডিএনএ এবং আরএনএ। এতে দুটি বিশেষ জিন অন্তর্ভুক্ত আছে। এখন আক্রান্ত মানুষের নমুনাকে তখনই পজিটিভ হিসেবে বিবেচনা করা হয় যদি পরীক্ষাটি উভয় জিনকে খুঁজে পায়। এ ক্ষেত্রে প্রাইমার এবং প্রব নামে দুটি রাসায়নিক বস্তুর বিক্রিয়া পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তিন ঘণ্টার মধ্যেই শনাক্তকরণ সম্ভব। এই কাজ বাংলাদেশের অনেক বিজ্ঞানীই করতে পারেন। বায়োটেকনোলজি, প্রাণরসায়ন, মাইক্রোবায়োলজি সংশ্লিষ্ট অনেক গবেষক ও চিকিৎসক এই কাজগুলো নিয়মিতভাবে করেন।

এই ভাইরাসের কাজের জন্য বেশ কয়েকটি গ্রহণযোগ্য ল্যাবরেটরি দেশে আছে এবং এর বিকল্পভাবে কীভাবে আরও কিছু ল্যাবকে ব্যবহার করা যায়, তা এখনই গবেষকদের নিয়ে বসে ভাবতে হবে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণাগারসহ অনেক জায়গাতেই অন্তত ১০০ বিশেষজ্ঞ গবেষক পাওয়া যাবে, যাঁরা এই কাজে দক্ষ। এই মুহূর্তেই তাঁদের নিয়ে অনেক বড় আকারে রোগ নির্ণয়ের কাজটা শুরু করতে হবে। বাংলাদেশের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র দাবি করেছে, তারা এমন একটি কিট তৈরি করতে সক্ষম, যার সাহায্যে মাত্র ৩৫০ টাকায় করোনাভাইরাস শনাক্ত করা যাবে। এই কিটের কার্যকারিতা একটি বিএসএল-২+ (জীবনিরাপত্তা স্কেল ২-এর বেশি) গবেষণাগারে এর আগে শনাক্ত করা রোগীর নমুনা দিয়ে পরীক্ষা করে দেখা হোক এবং যদি তা আসলেই কার্যকর হয়, সরকার যথাযথ প্রমাণাদি সাপেক্ষে তা অনুমোদন করার কথা ভাবতে পারে। তবে বর্তমান বাস্তবতায় সরকারের উচিত দেশের প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি উঁচু মানের গবেষক দল গঠন করে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের সহজতর উপায় বের করার চেষ্টা।

অধ্যাপক নিল ফার্গুলনের এক সাম্প্রতিক তথ্যে দেখানো হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে ২২ লাখ লোক মারা যেতে পারে, যদি করোনা ভয়ংকর রূপ ধারণ করে এবং যুক্তরাজ্যে ৫ লাখের বেশি লোক মৃত্যুর মুখোমুখি হতে পারে। বিভিন্ন দেশে শুরু হয়ে গেছে জিআইএস ট্র্যাকার দিয়ে কোন জায়গাগুলো বেশি আক্রান্ত হতে পারে, তা নির্ণয়ের চেষ্টা, কোন জায়গা থেকে বেশি ছড়ায়, তা বোঝার প্রয়াস। আমরা কি জানি আমাদের দেশে কোন জায়গায় কেমন ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে? কোন রুট দিয়ে ভাইরাস ছড়াতে পারে? যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁরা ইতিমধ্যে কোন জায়গা ভ্রমণ করেছেন? আমরা কি হটস্পট চিহ্নিত করেছি? না! আমাদের কিছুই করা হয়নি। এই তথ্যগুলো না পেলে গঠনমূলকভাবে সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না।

এ জন্য এই মুহূর্তেই দরকার সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, জিনবিজ্ঞানী, জীবপ্রযুক্তিবিদ, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, ফার্মাসিস্ট, প্রাণরসায়নবিদ, পরিসংখ্যানবিদ, ভূগোলবিদ ও প্রোগ্রামারদের একযোগে কাজ করা। আমাদের স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকেরা আছেন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে। তাঁদের জন্য পর্যাপ্ত পার্সোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট বা ব্যক্তিগত সুরক্ষার উপাদান সরবরাহ করা এখনই জরুরি। সরকারের কাছে পর্যাপ্ত অর্থ না-ও থাকতে পারে। বিজিএমইএ এবং ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে বসা হোক। দেশীয় প্রযুক্তিতে এসব তৈরি দু-তিন দিনেই সম্ভব।

ইতিমধ্যে বেশ কিছু দেশ তাদের রোগীর নমুনা থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করে জিনোম সিকোয়েন্সিং করে ফেলেছে। যার ফলে জানা যাচ্ছে কী ধরনের জিন সেই দেশে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসে আছে, এই জিনগুলো আর কোন ভাইরাসে আছে, অতীতে এ রকম জিন বহনকারী অণুজীবের বিরুদ্ধে কেমন ওষুধ কার্যকর হয়েছে, কোন কোন দেশে এ রকম জিন বহনকারী একই প্রকারের করোনাভাইরাস আছে। এই তথ্যগুলো থেকে বোঝা যাবে ভাইরাসটির তীব্রতা, আমাদের দেশে তা কোন পর্যায়ে যাবে, কোন কোন অঞ্চলের সঙ্গে আমাদের আক্রান্তদের দেহে পাওয়া ভাইরাসের শারীরবৃত্তীয় মিল আছে। চিকিৎসকদের তা অবহিত করতে হবে। তাহলে নির্ণয় করা যাবে প্রতিরোধের বিভিন্ন পর্যায়। এই তথ্যগুলোই চীনের সরকারকে সাহায্য করেছে এই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে। আমরা কি তা করতে সক্ষম? অবশ্যই, আমাদের দেশে হাজারের মতো জীবপ্রযুক্তিবিদ আছেন। জিনোম সিকোয়েন্সিং এখন নিয়মিতভাবে আমাদের দেশেই করছেন বিজ্ঞানীরা। বিশেষজ্ঞ আছেন আইসিডিডিআরবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।

আমরা নিশ্চিত, দেশকে সেবা দেওয়ার জন্য চিকিৎসকেরা যে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছেন এবং করে যাচ্ছেন, তেমনি গবেষক ও বিজ্ঞানীরাও ঝাঁপিয়ে পড়বেন, যদি এই তথ্যগুলো উন্মোচন ও গবেষণার দায়িত্ব তাঁদের দেওয়া হয়। রোগীদের নমুনাগুলো অতি দ্রুত জিনোম সিকোয়েন্সিংসহ শারীরবৃত্তীয় এবং রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ার গবেষণার জন্য দুয়ার এই মুহূর্তেই বাংলাদেশ সরকারের উন্মুক্ত করা উচিত।

আদনান মান্নান, মোহাম্মদ রেজওয়ানুল হক, এ এম এ এম জুনায়েদ ছিদ্দিকী: লেখকেরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবপ্রযুক্তি–সংশ্লিষ্ট গবেষক ও শিক্ষক