করোনা পরিস্থিতি

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে যে দুটি উপায়কে অধিক কার্যকর বিবেচনা করা হয়, সেই রোগ পরীক্ষা ও কোয়ারেন্টিন—দুটোতেই বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। গত ১৫ দিনে বিদেশ থেকে ১ লাখ ৭০ হাজারের বেশি মানুষ দেশে এসেছেন। কিন্তু কোয়ারিন্টেনে আছেন মাত্র ১৭ হাজার। আর পরীক্ষা হয়েছে মাত্র ৪৬৯ জনের।

বিভিন্ন সূত্র বলছে, বিদেশফেরত ব্যক্তিদের মাধ্যমেই করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছে। এ অবস্থায় সরকারের প্রথম কর্তব্য ছিল বিদেশফেরত প্রত্যেক নাগরিকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা এবং তাঁদের অন্তত দুই সপ্তাহ কোয়ারেন্টিনে রাখা। সেই কাজটি তারা ঠিকমতো করতে পারেনি বলে কোয়ারেন্টিনের বাইরে বেশি মানুষ রয়ে গেছেন। বিদেশফেরত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা কিংবা কোয়ারেন্টিন না করার পেছনে কর্তৃপক্ষের গাফিলতিই প্রধানত দায়ী। তবে এ ক্ষেত্রে একশ্রেণির বিদেশফেরত ব্যক্তির অসহযোগিতাও আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। যে প্রবাসীরা বাইরে থাকতে সংশ্লিষ্ট দেশের আইন অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন, দেশে ফিরে তাঁদের মধ্যেও আইন না মানার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। মারা গেছেন দুজন। তবে এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে না যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে কি নেই, সেটি জানতে যেসব তথ্য হাতে থাকার কথা, তা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছে নেই।

চীনের নিকটবর্তী হওয়া সত্ত্বেও তাইওয়ান যে করোনা প্রতিরোধে সফলতা দেখিয়েছে, তার কারণ প্রত্যেক নাগরিককে ভ্রমণের বিধিনিষেধ মানতে বাধ্য করা, সর্বাত্মক পরীক্ষা, করোনাভাইরাস রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত করা এবং কোয়ারেন্টিন বা পৃথক্‌করণ বিধিমালা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন। বাংলাদেশে কাজটি করা কঠিন হলেও অসম্ভব ছিল না। যদি আমরা বিদেশফেরত প্রত্যেক ব্যক্তিকে ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে পারতাম, তাহলে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা অনেক সহজ হতো। এখন তাঁরা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছেন বলে হাল ছেড়ে দেওয়ারও সুযোগ নেই। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, দেরিতে হলেও সরকারের বোধোদয় হয়েছে। মাদারীপুরের শিবচরে বিদেশফেরত আটজন আক্রান্ত হওয়ার পর পুরো এলাকা কার্যত অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। প্রবাসী-অধ্যুষিত অন্যান্য এলাকায়ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো সরকার বাস্তবায়ন করছে প্রশাসনের মাধ্যমে। কিন্তু এ রকম দেশব্যাপী একটি কর্মযজ্ঞ সফল করতে হলে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ তথা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, ক্লাব, যুব সংগঠনগুলোকেও যুক্ত করা প্রয়োজন। বিশেষ করে স্থানীয় সরকার সংস্থার প্রতিনিধিদের যুক্ত করতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। তাঁরা যেমন এলাকাবাসীকে চেনেন, তেমনি এলাকাবাসীও তাঁদের চেনেন।

এ রকম জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় সবচেয়ে জরুরি হলো সরকার ও জনগণের মধ্যে আস্থা-বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে তোলা। সরকার কেবল আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করলেই হবে না; সেই কাজের প্রতি জনগণ যাতে আস্থা রাখে, সে রকম পরিবেশও তৈরি করতে হবে। নানা কারণেই মানুষের মধ্যে ধারণা হয়েছে যে সরকার করোনাসম্পর্কিত সব তথ্য প্রকাশ করছে না, কোথাও কিছু লুকাচ্ছে। মন্ত্রীদের নানামুখী, ক্ষেত্রবিশেষে দায়িত্বহীন কথাবার্তা সেই ধারণাকে আরও পোক্ত করছে। প্রকৃত তথ্য জনগণকে জানানো তথা সরকারের কাজে সর্বাধিক স্বচ্ছতার মাধ্যমেই সব ভ্রান্তি ও গুজবের অবসান ঘটতে পারে।