করোনা সংক্রমণ: বিকল্প ভাবুন, জরুরি অবস্থা জারি নয়

জরুরি অবস্থা জারি নিয়ে কথা উঠেছে। অনেকেই নানা কথা বলছেন। এর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি বোধগম্য। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিদায়ী মেয়র সাঈদ খোকন ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক আবদুল্লাহ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা যেন জরুরি অবস্থা জারির অনুকূলেই মত দিলেন। আবদুল্লাহ এমনকি বললেন, সরকার প্রয়োজন মনে করলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করবে। ২০ মার্চ জোনায়েদ সাকির গণসংহতি আন্দোলন সরাসরি জরুরি অবস্থা চেয়েছে। এর মধ্যে সাঈদ খোকন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) কর্মকর্তাদের বরাতে জরুরি অবস্থা জারির কথা বলেছেন। ওই কর্মকর্তারা ২১ মার্চ তাঁর সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ওই পরামর্শ দেন। তবে এখানে আমাদের বোঝার ভুল হচ্ছে কি না, সেটা প্রশ্ন। ডব্লিউএইচও এর আগে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে।

বাংলাদেশের প্রচলিত আইনেই এ রকম স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা জারি করা সম্ভব। ইতিমধ্যে কিছু জায়গায় লকডাউন করা হয়েছে। করোনা সংক্রমণ রোধ বা করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা হলো আমাদের মূল লক্ষ্য। এর সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক প্রশ্ন নেই। প্রচলিত আইন ও নির্বাহী আদেশ দ্বারাই অনেক অসাধ্য সাধন সম্ভব। এর পথ সব সময় খোলা। আমরা জরুরি অবস্থা দ্বারা এই মুহূর্তে যা অর্জন করতে চাই, তা যদি প্রচলিত আইন ও সৃজনশীল নির্বাহী আদেশ দ্বারাই অর্জন করতে পারি, তাহলে জরুরি অবস্থা জারির বিকল্প পরিহার করতে হবে। এই প্রসঙ্গে আমরা দেখে নিতে পারি, জরুরি অবস্থা কি চাইলেই সরকার জারি করতে পারবে?

কেউ বলবেন, বিশ্বের বহু দেশ তো জরুরি অবস্থা জারি করেছে। তারা কী করে পারল? আমাদের মনে রাখতে হবে, সবার আইনি ব্যবস্থা এক রকম নয়। ইমার্জেন্সি কথাটি একটি বিশেষ পরিস্থিতি স্মরণ করিয়ে দেয়। আমাদের দেশে জরুরি অবস্থার ধারণাটি প্রধানত রাজনৈতিক গোলযোগ-সংক্রান্ত ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু করোনা একান্তভাবেই স্বাস্থ্যসংক্রান্ত। এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সংস্রব নেই। পাকিস্তান আমলে জরুরি অবস্থা তিক্ত অভিজ্ঞতা দিয়েছিল। সে কারণেই বাহাত্তরের সংবিধানে এই বিধান রাখা হয়নি। পরে তা যুক্ত করা হয় নবম ক ভাগ সংযোজন করে। এই ভাগে তিনটি অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়। এগুলো বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কার যে এর সবটাই একটি বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নির্দেশ করছে।

১৪১ক অনুচ্ছেদ বলেছে, (১) রাষ্ট্রপতির নিকট যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এমন জরুরি অবস্থা বিদ্যমান রহিয়াছে, যাহাতে যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগের দ্বারা বাংলাদেশ বা উহার যে কোন অংশের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবন বিপদের সম্মুখীন, তাহা হইলে তিনি অনধিক একশত কুড়ি দিনের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করিতে পারিবে। তবে শর্ত থাকে যে, অনুরূপ ঘোষণার বৈধতার জন্য ঘোষণার পূর্বেই প্রধানমন্ত্রীর প্রতি-স্বাক্ষর প্রয়োজন হইবে। এর চেয়ে বেশি পরিষ্কার করে আর বলার দরকার ছিল না। কিন্তু একই অনুচ্ছেদের ৩ উপদফা আবার নির্দিষ্ট করে বলেছে, ‘যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগের বিপদ আসন্ন বলিয়া রাষ্ট্রপতির নিকট সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে প্রকৃত যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগ সংঘটিত হইবার পূর্বে তিনি অনুরূপ যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগের জন্য বাংলাদেশ বা উহার যে কোন অংশের নিরাপত্তা বিপন্ন বলিয়া জরুরি অবস্থা ঘোষণা করিতে পারিবেন।’ সুতরাং সংবিধান সংশোধন করা ছাড়া এই অনুচ্ছেদের আওতায় বর্তমান পরিস্থিতিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা যাবে না।

তবে এটা ঠিক যে ২০১১ সালে যখন এই ভাগে সংশোধনী আনা হলো, তখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি বা অতিমারিজনিত পরিস্থিতি যুক্ত করার কথা ভাবা যেত। এখনো তেমন চিন্তাভাবনার সুযোগ থাকবে। জর্জিয়ায় সংবিধানের আওতায় জরুরি অবস্থা জারি করা সম্ভব হয়েছে। কারণ, তাদের সংবিধানের ৭১ অনুচ্ছেদে আমাদের সংবিধানে যা আছে, তা তাদেরও আছে। কিন্তু বাড়তি বলা আছে, ‘সন্ত্রাসী হামলা, প্রাকৃতিক বা প্রযুক্তিনির্ভর (টেকনোজেনিক) বিপর্যয় বা অতিমারি বা এমন একটি পরিস্থিতি যখন বিদ্যমান অবকাঠামাতে সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষ কার্যক্রম চালিয়ে নিতে অক্ষম’ তখন রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে সমগ্র দেশে বা কোনো অঞ্চলে জরুরি অবস্থা জারি করতে পারবেন।’ এই ধরনের বিধান যুক্ত করার কথা আমরা ভবিষ্যতে নিশ্চয় ভাবতে পারি। কোভিড-১৯ শেষ দুর্যোগ মনে করার কারণ নেই। ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু, ২০১৪ সালে পোলিও, ২০১৬ সালে জিকা এবং ইবোলায় দুবার (২০১৪ ও ২০১৯) ডব্লিউএইচও বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা জারি করেছিল। কিন্তু সংবিধানে উপযুক্ত বিধান না এনে বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানের আওতায় জরুরি অবস্থা জারি করা যাবে না।

প্রসঙ্গক্রমে, প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলামের সঙ্গে একটি কথোপকথন স্মরণ করতে পারি। তখন সবে তাঁর কনস্টিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ বইটি বেরিয়েছে। তিনি তাতে জরুরি অবস্থার বিধানাবলি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, জরুরি অবস্থা জারি হওয়ামাত্রই সংবিধানের ছয়টি অনুচ্ছেদ আপনা–আপনি স্থগিত হয়ে যাবে। উল্লেখ্য, সংবিধানের অধীনে এই ছয়টি হলো : চলাফেরার স্বাধীনতা (৩৬), সমাবেশের স্বাধীনতা (৩৭), সংগঠনের স্বাধীনতা (৩৮), চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্‌স্বাধীনতা (৩৯) ও ধর্মীয় স্বাধীনতা (৪১)। এর বাইরে আরও বলা আছে, রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থার আদেশে মৌলিক অধিকার বলবৎ করার জন্য রিট করার অধিকার স্থগিত রাখার কথা উল্লেখ করা যাবে। এতে পরিষ্কার যে সাংবিধানিক স্কিমে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য যা দরকার, তার সঙ্গে এর একটিরও কার্যত সম্পর্ক নেই। তবে কোনো অবস্থাতেই চিন্তার স্বাধীনতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্থগিত করা নিরর্থক। এটা অবাস্তব।

একদিন প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেলের সুপ্রিম কোর্টের চেম্বারে যাই। সবিনয়ে বলি, ব্যক্তিগত স্বাধীনতাসংক্রান্ত এসব অনুচ্ছেদ অটোমেটিক স্থগিত হয়ে যাওয়ার যুক্তির সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করি। তিনি নিরুত্তর ছিলেন। পরে তাঁর মূল্যবান বইটির সর্বশেষ সংস্করণে দেখি, তাঁর মত অপরিবর্তিত রেখেছেন। আমিও মত পাল্টাইনি। কারণ, রাষ্ট্রপতি তাঁর জরুরি অবস্থার কোনো আদেশে যে কয়টি মনে করবেন, সে কয়টি অনুচ্ছেদ উল্লেখ করবেন। তিনটি চাইলে তিনটি স্থগিত হবে। এমনকি আরও বিস্তারিত শর্ত জুড়ে দিতে পারবেন। কোনো কিছুই নিরঙ্কুশভাবে হরণ করতে হবে না। যেটুকু করবেন, তাকে তা নির্দিষ্টভাবে বলে দিতে হবে। উদাহরণ দিই। সামাজিক দূরত্ব ও স্বেচ্ছা কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা হলো বর্তমান পরিস্থিতিতে লক্ষ্য। গণমাধ্যমের অধিকতর কার্যকারিতা ও ব্যবহার করোনো মোকাবিলায় সব থেকে দরকারি। এর কোনো বিঘ্ন আমরা কেউ চাই না। তাহলে দেখা যাচ্ছে, সংবিধানের অধীনে যদি জরুরি অবস্থা জারি করতেই হয়, তাহলে আমরা যা কেউ চাই না, অথচ সংবিধানের ওই রূপ ব্যাখ্যার কারণে আমাদের তাই মানতে হবে। এই ব্যাখ্যা তাই অগ্রহণযোগ্য। বর্তমান সংবিধানও তা বলছে না।

ইদানীং কতিপয় ক্ষেত্রে প্রচলিত আইন ও সংবিধানের রীতিনীতির প্রতি অবজ্ঞা চলছে বলেই প্রতীয়মান হয়। ৫ শতাংশ ভোটের প্রহসনটা করে নির্বাচন কমিশন নিজেদের গায়ে আরেকবার কালি লাগাল। অথচ সংবিধান মানা যেত। সংবিধান বলেছে, উপনির্বাচন দৈবদুর্বিপাকের (অ্যাক্ট অব গড) কারণে আরও ৯০ দিনের জন্য পেছানো যাবে। ১০৪ (৪) অনুচ্ছেদ বলেছে, সিইসি এই সিদ্ধান্ত দেবেন। কিন্তু সিইসি জবরদস্তি অবিবেচকের পরিচয় দিলেন। করোনার মতো দৈবদুর্বিপাক আর কি হবে? ওদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি সাহেব ১২ মার্চ গণবিজ্ঞপ্তি জারি করলেন। বললেন, আইন না মানলে কী কী সংক্রামক আইনে কী কী শাস্তি হবে। অথচ ভুলেই গেলেন যে একটি সরকারি প্রজ্ঞাপন দিয়ে কোভিড-১৯-কে আগে রোগের তালিকায় আনতে হবে। অন্যথায় কারও শাস্তি বৈধ হবে না।

আশা করব, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংবিধানের অধীনে জরুরি অবস্থা জারির কথা ভাবা না হয়। সহকর্মী ভারতের সাংবাদিক সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যয়ের মতে ভারতে ‘জনতা কারফিউ’ আঠারো আনা সফল। ইসলামাবাদেও কিন্তু তা–ই। সেখানে একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পুরো রাজধানীতে ১৫ দিনের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করেছেন। এ রকম পদক্ষেপ নেওয়ার পথ উপমহাদেশের সবার জন্য খোলা।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]