করোনা মোকাবিলায় বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা কী বলে

>করোনাভাইরাসের মহামারি যে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক সংকট, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এটি যেমন জনস্বাস্থ্যগত সংকট, তেমনই দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সংকট। ‘আমাদের এমনটি হবে না’, ভাবনাটি ইতিমধ্যেই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। একই সঙ্গে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাত এ ধরনের বৈশ্বিক মহামারি মোকাবিলায় কতটা অপ্রস্তুত, তা–ও এখন ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশের আগে আরও শতাধিক দেশে এই রোগের সংক্রমণ ঘটেছে। ফলে অজানা শত্রুর ভয়ংকর থাবা থেকে ক্ষয়ক্ষতি কমানোর সবচেয়ে কার্যকর কৌশল বেছে নেওয়ার কিছুটা সুযোগ আমাদের সামনে রয়েছে। তাই বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা থেকে কী কী শিক্ষা আমরা নিতে পারি, তা নিয়ে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। 

সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের দেশগুলোর চিত্র

করোনার সংক্রমণ যেখানে প্রথম ঘটেছিল, চীনের সেই উহানে গত বৃহস্পতিবারের পর নতুন কোনো সংক্রমণ ঘটেনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস বলেছেন, করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উহান সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর মাধ্যমে বাকি বিশ্বের জন্য আশা জাগিয়েছে। প্রতিদিনই আমরা এই ভাইরাস সম্পর্কে শিখছি বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন। চীনের শাসনব্যবস্থার কর্তৃত্ববাদী চরিত্র এবং বিপুল সম্পদ বিনিয়োগের সামর্থ্য অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। চীন ভাইরাসটির সংক্রমণ উহানেই সীমিত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। অন্যান্য দেশে সে রকমটি হচ্ছে না। 

চীনের বাইরে সংক্রমণের ব্যাপ্তি এবং ভয়াবহতা সবচেয়ে বেশি প্রকট হয়েছে যেসব দেশে, সেগুলো হচ্ছে ইতালি, ইরান ও দক্ষিণ কোরিয়া। ইউরোপ, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াবে, তা এখনো অস্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের পরিস্থিতি অবশ্য অন্য কারও সঙ্গেই তুলনীয় নয়। তবে এসব দেশ চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইতালি থেকে শিক্ষা নিয়ে কৌশল পরিবর্তনেও পিছপা হয়নি। দক্ষিণ কোরিয়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক হারে শনাক্তকরণ পরীক্ষা চালিয়ে সংক্রমিতদের দ্রুত বিচ্ছিন্ন করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। আর বাইরে থেকে আসা প্রবাসী ও বিদেশিদের সেলফ কোয়ারেন্টিনে নজরদারিতে মোবাইল অ্যাপসের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাফল্য পেয়েছে। ইতালিতেও যেখানে সংক্রমণের সূচনা, সেই ভো নামক গ্রামের তিন হাজারের বেশি বাসিন্দার সবাইকে সংক্রমণ শনাক্তকরণ পরীক্ষার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের সাফল্য মিলেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইউরোপের সেরা চিকিৎসাব্যবস্থার সুনাম থাকলেও ধনীদের বসতি হিসেবে পরিচিত লম্বার্ডি এলাকায় সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বলা হচ্ছে আশির ওপরে বয়স, এ রকম একটি প্রজন্ম পুরোপুরি হারিয়ে যাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য উভয় দেশেই শুরুর দিকে গলদ থাকায় দ্রুতই পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রে মূল কারণ ছিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও রিপাবলিকান পার্টির রাজনীতি এবং সমস্যার বিপদকে নাকচ করা। আর যুক্তরাজ্যে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সরকার ভাইরাসের সংক্রমণ অল্প সময়ের ব্যবধানে আরও শক্তিশালী রূপে ফিরে আসার আশঙ্কা বিবেচনায় জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে উঠতে দেওয়া প্রয়োজন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কথিত ‘হার্ড ইমিউনিটি’ কৌশলে রোগী শনাক্তকরণের বদলে কারও মধ্যে লক্ষণ দেখা দিলে তাকে স্বেচ্ছাবিচ্ছিন্নতা বা সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিংয়ের নীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।

 যে গবেষণা সব বদলে দিয়েছে

অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই ইম্পিরিয়াল কলেজের অধ্যাপক নিল ফার্গুসনের নেতৃত্বে পরিচালিত এক গবেষণায় যখন সম্ভাব্য ব্যাপকতা ও ভয়াবহতার তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়, তখন দ্রুতই সরকার তার কৌশলে পরিবর্তন আনে। ধারণ (কনটেইন) নীতির বদলে শুরু হয় অবদমন (সাপ্রেশন) নীতি বাস্তবায়নে পর্যায়ক্রমিক লকডাউনের পথে যাত্রা। প্রথমে বড় ধরনের সমাবেশ বন্ধ করা, অফিসের বদলে বাসায় বসে কাজ করতে উৎসাহিত করা, সত্তরোর্ধ্ব ও কয়েক ধরনের নিরাময়যোগ্য নয় এমন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্বেচ্ছান্তরীণ করার পরামর্শের পর গত শনিবার থেকে বার, রেস্তোরাঁ ও ক্লাবগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়। লন্ডনে সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি হওয়ায় সেখানে এখন একধরনের অঘোষিত লকডাউন চলছে। শনিবার রাতে প্রধানমন্ত্রী জনসন নাগরিকদের উদ্দেশে সামাজিক বিচ্ছিন্নতার নির্দেশনা মেনে চলার জন্য ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক এবং অন্য আরও কয়েকটি জনঘন শহর ও ইউরোপের বিভিন্ন শহরে অবশ্য গত সপ্তাহ থেকেই সরকারিভাবে লকডাউন ঘোষিত হয়েছে। বিধিনিষেধ অমান্য করলে জরিমানাও করা হচ্ছে। অধ্যাপক নিল ফার্গুসনের গবেষণায় বলা হয় যে সংক্রমণের ধারাবাহিকতা ভাঙতে না পারলে যুক্তরাজ্যের ৬০ শতাংশ মানুষ সংক্রমণের শিকার হবে এবং মৃত্যুর সংখ্যা আড়াই লাখ ছাড়িয়ে যাবে। প্রশমনের ব্যবস্থা না নিলে তা পাঁচ লাখও হতে পারে। ওই গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে এবং ট্রাম্প প্রশাসনও দ্রুত তৎপর হয়ে ওঠে। 

গুরুত্বপূর্ণ যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে: ১. এসব দেশে করোনা–সংকটকে এখন শত বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। সংকটকে স্পষ্টতই দুটো ভাগে ভাগ করে কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে এবং প্রয়োজনমতো সেগুলোতে রূপান্তর ঘটানো হচ্ছে। এর একটি হচ্ছে জনস্বাস্থ্যগত এবং অপরটি অর্থনৈতিক। ২. জাতীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক এবং সামাজিক সমঝোতা ও মতৈক্যের মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলায় সর্বাত্মক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যুদ্ধকালীন জাতীয় ঐক্যের প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেমন ডেমোক্র্যাট স্পিকার পেলোসি এবং বিভিন্ন রাজ্যের গভর্নরদের সঙ্গে সমন্বয় করে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন, ঠিক তেমনই যুক্তরাজ্যে বরিস জনসন বিরোধী নেতা জেরেমি করবিন এবং অন্য দলগুলোর সঙ্গে এবং মন্ত্রীরা ছায়ামন্ত্রীদের সঙ্গে নিয়মিত সলাপরামর্শের ভিত্তিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন। ৩. সরকারের স্বাস্থ্যবিধিবিষয়ক নির্দেশনাগুলোর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি এবং ব্যাখ্যা তুলে ধরছেন বিজ্ঞানবিষয়ক উপদেষ্টা এবং স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। ৪. সংক্রমণ ও প্রাণহানির তথ্য প্রকাশে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা বজায় রাখা হচ্ছে। ৫. শনাক্তকরণের সরঞ্জাম (কিট) এবং চিকিৎসাকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) সরবরাহের বিষয়টিকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। ঘাটতি পূরণে উৎপাদকদের কাছ থেকে সরাসরি এগুলো সংগ্রহ করা হচ্ছে। ৬. হাসপাতালগুলোতে শয্যাসংখ্যা বাড়াতে জীবন রক্ষার জন্য অত্যাবশ্যক নয় এমন সব অস্ত্রোপচার পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর আট হাজার শয্যা এবং কয়েক হাজার ডাক্তার ও চিকিৎসাকর্মীর সেবা গ্রহণের জন্য জাতীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ চুক্তি করেছে। আর গত তিন বছরে অবসরে গেছেন, এমন প্রায় ৩৫ হাজার ডাক্তার ও নার্সের প্রতি কাজে ফিরে আসার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ৭. ইতালিতে ক্রিটিক্যাল কেয়ার দেওয়ার শয্যার সংখ্যা যেখানে প্রতি এক হাজার রোগীর বিপরীতে ১২টি, সেখানে যুক্তরাজ্যে এর সংখ্যা তার অর্ধেকের কম। ক্রিটিক্যাল কেয়ারের জন্য অপরিহার্য ভেন্টিলেটর মেশিনের অভাবের কারণে বড় ধরনের সংকটের আশঙ্কায় গত সপ্তাহে সরকার স্থানীয় শিল্প খাতের প্রতি তাদের যন্ত্রপাতিতে কিছুটা পরিবর্তন ঘটিয়ে ভেন্টিলেটর তৈরি করে দেওয়ার আহ্বান জানায়। মোটর রেসিংয়ের জন্য বিখ্যাত ফর্মুলা ওয়ান ঘোষণা করেছে যে তারা ভেন্টিলেটর উৎপাদন করবে। এ রকম আরও কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান তাদের কলকারখানায় কিছুটা রূপান্তর ঘটিয়ে ভেন্টিলেটর তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে এবং আগামী সপ্তাহ কয়েকের মধ্যে তারা ৩০ হাজার ভেন্টিলেটর সরবরাহ করবে। ৮. সেনাবাহিনীর সরবরাহ পরিকল্পনাকারীদের স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশে স্বেচ্ছান্তরীণ ১৫ লাখ পরিবারের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জোগান দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার কাজে লাগানো হয়েছে। 

 অর্থনীতি সচল রাখতে জরুরি ব্যবস্থা

ট্রেড ইউনিয়ন ও বিভিন্ন ব্যবসায়ী সমিতি এবং পেশাজীবীদের মতামত নিয়ে সবাইকে আস্থায় নেওয়ার নীতি অনুসৃত হচ্ছে। মানুষের জীবন রক্ষাকে প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য হিসেবে গণ্য করে স্বাস্থ্য খাতের নজিরবিহীন চাপ মোকাবিলায় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি মানুষের মৌলিক চাহিদা অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের নিরাপত্তা এবং অর্থনীতির ধস রক্ষায় জরুরি কর্মসূচি ঘোষিত হচ্ছে। উন্নত অর্থনীতির সব কটি দেশেই নজিরবিহীন আর্থিক প্যাকেজ ঘোষিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্যাকেজ এক ট্রিলিয়ন ডলারের ওপরে। সেখানে নাগরিকদের হাতে সরাসরি নগদ টাকা পৌঁছানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাতে বাজারে চাহিদা বজায় থাকে। শিল্প এবং পুঁজিবাজার সচল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার নাটকীয়ভাবে কমিয়ে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর ব্যবস্থা করেছে। একই ধরনের ব্যবস্থা ইউরোপীয় ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সরকারগুলো গ্রহণ করেছে। 

ব্রিটেনে প্রথমে বাজেটে তিন হাজার কোটি পাউন্ড বরাদ্দের ঘোষণা দেওয়া হলেও সপ্তাহ না ঘুরতেই অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনাক ঘোষণা করেছেন, অর্থনীতি সচল রাখতে সরকার ‘যা দরকার হবে তা’-ই করবে। নতুন ঘোষিত প্যাকেজে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর জন্য আরও ৩৫ হাজার কোটি পাউন্ডের সংস্থান রাখা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজেটের দিনে সুদের হার ০.৭৫ শতাংশ থেকে কমিয়েছিল ০.২৫ শতাংশে। কিন্তু শুক্রবার তা কমিয়ে ০.০১ শতাংশে নামিয়ে এনেছে, যা ২৩৫ বছরের ইতিহাসে কখনো হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার আগে শিল্পমালিক ও ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে কাউকে চাকরিচ্যুত না করার আহ্বান জানিয়েছেন। বেসরকারি খাতের সব কর্মীর বেতনের ৮০ শতাংশ পর্যন্ত দেওয়ার দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করেছে। আপাতত তা তিন মাসের জন্য এবং প্রয়োজন হলে তা আবারও বাড়ানো হবে। বাড়ি বা স্থাবর সম্পদের জন্য নেওয়া ঋণ পরিশোধে তিন মাসের অবকাশ দেওয়া হয়েছে। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের স্থাপনার ওপর যে কর দেয়, সেই বিজনেস রেট এক বছরের জন্য মওকুফ করা হয়েছে। ছোট ও মাঝারি আকারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অনুদান এবং সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কর পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বাড়ি ভাড়া দিতে না পারার কারণে কাউকে উচ্ছেদ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে স্বাধীন পেশাদার যেমন সুতোর মিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, একাকী ব্যবসা পরিচালনাকারীদের মতো ব্যক্তিদের জন্য তেমন কোনো বরাদ্দ না দিয়ে তাদের জন্য বেকার ভাতাসহ অন্য কিছু সুবিধাভোগের শর্তগুলো সহজ করা হয়েছে। 

 বাংলাদেশের প্রস্তুতি অথবা প্রস্তুতিহীনতা 

এসব দেশের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে সহায়ক হতে পারত বলে বিশ্বাস করার যৌক্তিকতা কোনোভাবেই নাকচ করা যায় না। কিন্তু মহামারি ঝুঁকির ব্যাপকতা অনুধাবনে সরকারের তরফে একধরনের উদাসীনতার পরিচয় পাওয়া যায়। বিপরীতে অতি আত্মবিশ্বাস প্রকটভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ডিসেম্বরে শুরু হওয়া এই ভাইরাসের সংক্রমণ কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ার পরও আমাদের সরকার বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। ৩১ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জনস্বাস্থ্যবিষয়ক বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা ঘোষণার পরও সরকার অতি আত্মবিশ্বাসে ভর করে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের গুরুত্ব উপেক্ষা করেছে। ১ ফেব্রুয়ারি চীনের উহান থেকে শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনার পর কোয়ারেন্টিন পরিচালনার ক্ষেত্রে দুর্বলতা এবং ঘাটতি প্রকাশ পাওয়ার পরও সরকার সেগুলো কাটিয়ে ওঠার কোনো চেষ্টা করেনি। হাসপাতাল ও টেস্টিংয়ের পরীক্ষাগারের মতো অবকাঠামোগুলোতে ন্যূনতম কোনো প্রস্তুতি দেখা যায়নি। ৮ মার্চ দেশে প্রথম সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হওয়ার পরপরই চিকিৎসাকর্মী এবং অন্যান্য সহায়ক সেবার জন্য প্রয়োজনীয় জনশক্তির প্রস্তুতিতে দুর্বলতাগুলো প্রকাশ হয়ে পড়ে। এই সংকট মোকাবিলায় সরকারের নীতিকৌশল কী, তা এখনো স্পষ্ট নয়। একদিকে অতি আত্মবিশ্বাস এবং বিপরীতে প্রস্তুতিহীনতা জনমনে অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার জন্ম দিয়েছে। সেলফ-কোয়ারেন্টিন, কোয়ারেন্টিন এবং সামাজিকতা পরিহারের নানা নির্দেশনা দেওয়া হলেও মন্ত্রীরা চলছেন দল বেঁধে এবং সভা–সমাবেশ–নির্বাচন সবই বহাল থেকেছে। রোগী শনাক্তকরণের পরীক্ষা, চিকিৎসক ও চিকিৎসাসেবীদের নিরাপত্তার ন্যূনতম ব্যবস্থা করা এখনো সম্ভব হয়নি। শুধু শিল্পমালিকদের জন্য ঋণ পরিশোধের বিষয়ে কিছু ছাড় ঘোষণা ছাড়া লাখ লাখ শ্রমিক ও কর্মজীবীর রুটি-রুজির নিরাপত্তার বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। 

 এখনো সময় শেষ হয়ে যায়নি

একটি সম্ভাব্য জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় সবার অংশগ্রহণের জন্য যে ধরনের জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন হয়, সে রকম কোনো সমঝোতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ চোখে পড়ে না। অথচ আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার দোলাচলে অস্থির নাগরিকদের সাহস ও আস্থা জোগানোর জন্য সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক গোষ্ঠী ও পেশাজীবীদের সম্পৃক্ত করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। জনস্বাস্থ্য–সম্পর্কিত শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের এই কার্যক্রমে যুক্ত না করে শুধু আমলানির্ভর নীতিকৌশল কতটা কাজে দেবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাবে। কোন ধরনের পদক্ষেপে সংক্রমণ কতটা ব্যাপকতা লাভ করতে পারে এবং তাতে সম্ভাব্য জীবনহানির ঝুঁকি কতটা, তার একটা পরিষ্কার চিত্র প্রয়োজন। এই চিত্র পেলে সম্ভাব্য বিধিনিষেধের যৌক্তিকতার আলোকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ হবে। অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং স্বচ্ছতার নীতি অনুসরণ করা হলে গুজব ও অপপ্রচারের সুযোগ বন্ধ হবে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধানের কথায় সব দেশের প্রতি তাঁদের বার্তা হচ্ছে পরীক্ষা, পরীক্ষা, পরীক্ষা। তাই যত দ্রুত সম্ভব রোগী শনাক্ত করার জন্য টেস্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে। সরকারের সংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় মনিটরিংয়ের মধ্যেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও টেস্টিংয়ের কার্যক্রমে যুক্ত করা প্রয়োজন। তা হতে হবে সরকারি খরচে, যাতে কেউ এটি নিয়ে মুনাফা করতে না পারে এবং বাড়তি খরচের কারণে যাতে সাধারণ নাগরিকেরা কেউ টেস্টিং এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা না করেন। একই সঙ্গে স্থানীয়ভাবে উদ্ভাবিত টেস্টিং কিটের কার্যকারিতা যাচাই ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন। 

সংক্রমণের ধারা ভেঙে দিতে যে সামাজিক দূরত্ব তৈরির প্রতি বিশ্বজুড়েই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, তা কার্যকরের লক্ষ্যে লকডাউনের মতো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। অত্যাবশ্যক না হলে সব ধরনের যানবাহনের চলাচল আনুপাতিক হারে কমিয়ে আনা থেকে প্রয়োজন হলে বন্ধ করে দেওয়ার কথা বিবেচনা করতে হবে। আরব দেশগুলোর মতো ধর্মীয় সমাবেশ ও সম্মিলিত প্রার্থনায়, বিশেষ করে বয়স্ক ও অসুস্থ ব্যক্তিদের নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন। মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলোতে আবাসন ব্যবস্থায় স্বাস্থ্যগত নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে হবে। 

চিকিৎসক, চিকিৎসাসেবাকর্মী এবং স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম দিতে না পারার মানে হচ্ছে জীবন বাঁচানোর দায়িত্ব পালনকারীদেরই সংক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলা, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। জরুরি ভিত্তিতে এগুলো আমদানির পাশাপাশি পোশাকশিল্পের কারখানাগুলোতেও তা উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া যায়। অন্যান্য দেশের মতোই বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো সরকার ন্যূনতম তিন মাসের জন্য নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সেগুলোর ক্ষমতাকে মহামারি মোকাবিলায় কাজে লাগানোর কথা ভাবতে পারে। এ ধরনের সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতাও কাজে লাগানো সম্ভব। 

শুধু খাবারের প্রয়োজনে কাজ করতে বাধ্য যাঁরা, তাঁদের জন্য বিশেষ সহায়তার ব্যবস্থা না করা হলে সংক্রমণ বিস্তারে তাঁরা হবেন অনিচ্ছুক এবং অদৃশ্য বাহক। অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটার কারণে তাই যেসব কর্মী ও শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়বেন, তাঁদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। যাঁরা দিনমজুরের কাজ করেন, তাঁদের জন্যও যত দিন প্রয়োজন হবে, তত দিন ত্রাণের ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকাসহ সারা দেশের সব বস্তি ও নিম্ন আয়ের লোকজনের জন্য এই ত্রাণের ব্যবস্থা করতে হবে। 

১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংক্রমণের ঝুঁকি উপেক্ষিত হলে আশ্রয়কেন্দ্রের আশপাশের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বে। তাই ওই অঞ্চলের জন্য জরুরি ভিত্তিতে বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তারও আহ্বান জানানো দরকার। 

কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার চেয়ে তিন গুণ বন্দী থাকায় সেখানে সংক্রমণের ঝুঁকি বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছাতে পারে। আবার কারাবন্দীদের একটা বড় অংশই বিচারাধীন মামলায় বন্দী। সুতরাং, জামিনযোগ্য মামলায় বিচারাধীন সব বন্দী এবং হত্যা, ধর্ষণ ও ডাকাতির মতো গুরুতর অপরাধের দণ্ডপ্রাপ্ত ছাড়া অন্যান্য মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সাজার মেয়াদ বিবেচনায় মুক্তি প্রদানের কথা ভাবা উচিত। ইরানে বিপুলসংখ্যায় বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে। 

অর্থনীতিকে সচল রাখতে এবং সম্ভাব্য মন্দার কবল থেকে উদ্ধারে একটি জাতীয় পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিতে হবে। বিশেষ করে ছোট ব্যবসা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, রপ্তানি খাত, কৃষি ও কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য ক্ষতি কাটাতে বিশেষ প্রণোদনা ও সহায়তা দিতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে উন্নয়ন অগ্রাধিকার পর্যালোচনায় সবার অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। 

বৈশ্বিক মহামারির ছোঁয়াচের বাইরে যে আমরা নেই, তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে বড় ধরনের বিপর্যয় এড়ানো এবং ক্ষতি কমানোর সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি। বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার শিক্ষা আমাদের সহায় হতে পারে। তবে তার জন্য প্রয়োজন সবাইকে সঙ্গে নেওয়া। 

 কামাল আহমেদ সাংবাদিক