ঘরবন্দী শিশুর পড়াশোনা

প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স
প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স

দুনিয়াজুড়ে মানুষ ঘরবন্দী। শিশু থেকে বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ সবাই এখন ঘরবন্দী। কেউ জানি না, কত দিন চলবে এই বন্দিজীবন।

সারা পৃথিবীর স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জনসমাগম এড়ানোর জন্যই এ ব্যবস্থা। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে এ ব্যবস্থা দীর্ঘদিন চলতে পারে না। বিচ্ছিন্নতা মানবধর্ম নয়। সামাজিকতাই তার যথার্থ জীবন। তাই বিচ্ছিন্ন বা ঘরবন্দী জীবন থেকে যত দ্রুত বেরিয়ে আসা যাবে ততই মঙ্গল। এই ঘরবন্দী জীবন যত দীর্ঘায়িত হবে, তত নানা রকম সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক নৈরাজ্য শুরু হবে। মানসিক বৈকল্যের শিকার হবে মানবজাতি।

কিন্তু স্বল্পকালের জন্য হলেও যে ঘরবন্দী জীবন শুরু হয়েছে সারা দুনিয়ায়, সে সময় আমাদের শিশুদের জন্য আমরা কী করতে পারি?

প্রথমেই চীনের উদাহরণ দিতে চাই। আমরা জানি, গত আড়াই মাসের বেশি চীনের হুবেই প্রদেশ ছিল সম্পূর্ণ ঘরবন্দী। অন্য প্রদেশেও তার প্রভাব ছিল মারাত্মক। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সেখানে কি তবে লেখাপড়াও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে?

না, চীনারা তা করেনি। গুয়াংজুতে লেখাপড়া করতেন বাংলাদেশি ছাত্র সৈকত। তিনি বলছেন, প্রথমেই তাঁদের করোনা ভাইরাস সম্পর্কে ব্রিফ করা হয়। আতঙ্কিত না হয়ে সংকট মোকাবিলায় করণীয় বুঝিয়ে বলা হয়। সবাইকে ডরমিটরির বাইরে না যেতে নির্দেশনা দিয়ে ঘরে বসে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কীভাবে অনলাইনে অর্ডার দিয়ে ঘরে বসেই পাওয়া যাবে, তা জানানো হয়। কোনো রকম অসুস্থতা বোধ করলে দ্রুত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা হয়। তারপর সুযোগমতো সবাইকে নিজ নিজ বাড়িতে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে কর্তৃপক্ষ। আর লেখাপড়া? সেটি এক দিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। অনলাইনে নিয়মিত পাঠদান চলছে। শিক্ষার্থী চীনা কিংবা বিদেশি যা–ই হোক না কেন। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী উভয়েই ঘরবন্দী; কিন্তু পড়ালেখা বন্ধ হয়নি।

এ অভিজ্ঞতা কি আমরা কাজে লাগাতে পারি? না, আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ কিন্তু এখনো এত দূর এগিয়ে যায়নি। আমাদের অনলাইন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে করপোরেট বাণিজ্যের দুয়ার খুলে দিতে। আমরা শিক্ষকদের সেভাবে উপযুক্ত করে তুলিনি। এ দেশে এখনো মান্ধাতার আমলের শিক্ষাব্যবস্থা। স্কুলগুলো কার্যত অকার্যকর। কোচিং সেন্টারই বিদ্যা বিকিকিনির শেয়ারবাজার।

তাহলে উপায়? লাভলী মল্লিক বাগেরহাটের একজন মাধ্যমিক শিক্ষক। তিনি এখন ঘরে বসে লেসন প্ল্যান, ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করছেন। ফেসবুকে আক্ষেপ করে লিখেছেন, যদি আমাদের সব শিশুর কাছে ট্যাব থাকত, তিনি তো ঘরবন্দীদের নিয়মিত পড়াতে পারতেন। সাতক্ষীরার বিজ্ঞান শিক্ষক মাসুদ, কুষ্টিয়ার গণিত শিক্ষক মাইনুদ্দীন একই কথা বলছেন। যশোরের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক দেবনাথ ডিজিটাল শিক্ষাদানে পারদর্শী। যশোরের প্রাথমিক শিক্ষক ফেরদৌসী রহমানও চান তাঁর স্কুলের ঘরবন্দী বাচ্চারা যেন নিয়মিত পড়ালেখার মধ্যেই থাকে। তাঁরা সবাই ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরিতে ব্যস্ত। এ বিষয়ে তাঁদের দক্ষতা আছে। ইউটিউবে তাঁরা পাঠদান করতে পারঙ্গম। তাঁরা সেটা করতে চান।

আমাদের দেশে শিক্ষার অনেক প্রসার ঘটেছে। অনেক মা-বাবাই এখন শিক্ষিত। তাঁরা নিজেরা সন্তানকে পড়াতে চান। কিন্তু আমাদের পাঠ্যবইগুলো আজগুবি। শিক্ষিত মা-বাবাও তা পড়াতে পারেন না। লম্বা সিলেবাস। আবার পরীক্ষার চাপে পিষ্ট আমাদের শিশুরা।

এসব প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে আমাদের শিশুদের পড়ালেখা কীভাবে অব্যাহত রাখা যাবে? বিশেষ করে শিশু যখন ঘরবন্দী?

আমার মতে দুটো ব্যবস্থা করা যায়। কেন্দ্রীয় ও স্থানীয়ভাবে সে ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেতে পারে। কেন্দ্রীয়ভাবে পাঠদান হবে টিভি সম্প্রচারের মাধ্যমে। কিন্তু সেটি যেন একপাক্ষিক না হয়, প্রাণহীন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। ভালো হতো যদি ভিডিও কনফারেন্সের সুবিধা করা যেত।

দ্বিতীয় উপায়, স্থানীয় উদ্যোগ। আমরা জানি, দেশে প্রায় সবার হাতে এখন স্মার্টফোন। শিক্ষক স্মার্টফোনে পড়ুয়াদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন, অনুশীলনী পাঠাবেন। ঘরবন্দী শিক্ষক ঘরবন্দী শিক্ষার্থীকে এভাবে সক্রিয় রাখবেন। তাকে দরকারি পরামর্শ দেবেন, কাজে উৎসাহিত করবেন।

তবে, শুধু ক্লাসের পাঠে শিশুদের যেন ক্লান্ত না করে তুলি। তাদের এখন আনন্দপাঠের সুযোগ দিতে হবে বেশি বেশি। কেননা, ঘরবন্দী শিশুর চিত্তবিনোদনের পরিসর ভীষণভাবে সংকুচিত হয়ে গেছে। তাই কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় পাঠদান যেন দিনে কোনোভাবেই চার ঘণ্টার বেশি না হয়। সেটাও সকালে দুই ঘণ্টা, বিকেলে দুই ঘণ্টা এভাবে ভাগ করা উচিত। শিশুদের এখন পাঠ্যসূচির বাইরে গল্প, উপকথা, কমিক, ভ্রমণ, কল্পকাহিনি ইত্যাদি পড়তে উৎসাহিত করা উচিত। এগুলোও এখন স্মার্টফোনে সহজেই পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে শিশুদের মগ্ন রাখা যায় তাদের স্বপ্নের জগতে, উদ্ভাবনী কাজে উৎসাহ জুগিয়ে।

এই দুষ্কালে শিশুর ওপর কোনো চাপ দেওয়া একেবারেই অনুচিত হবে। ঘরবন্দী শিশু যেন ভাবতে পারে ঘরের মধ্যে থাকলেও তার অপার স্বাধীনতা আছে, আনন্দ–বিনোদনের সুযোগ আছে।

আমিরুল আলম খান: যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।
[email protected]