পিতাহারা পুত্রের কান্না শুনতে পান?

দেশে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা হয় একমাত্র আইইডিসিআর বা সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার সক্ষমতা নেই। তারা সবাইকে প্রয়োজনীয় সহায়তা ও সমর্থন দিতে পারছে না। এই পরিস্থিতিতে অসহায় মানুষের যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মিরপুরের এক বাসিন্দার ভুল চিকিৎসা ও মৃত্যুর ঘটনা আমাদের স্বাস্থ্যসেবার নাজুক অবস্থাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। মারা যাওয়ার আগে জানানো হলো, তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এর আগে আইইডিসিআর থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ও কিছু না, সাধারণ শ্বাসকষ্ট মাত্র। কী ভয়ংকর ব্যবস্থাপত্র!


আইইডিসিআর জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের বিষয়ে কারও কিছু জানার থাকলে তাঁরা যেন হটলাইন নম্বরে যোগাযোগ করেন। কিন্তু যোগাযোগ করলে যে ফল পাওয়া যায় না, তার অনেক প্রমাণের মধ্যে মিরপুরের এই বাসিন্দার উদাহরণ একেবারে জ্বলন্ত। তিনি ১৬ মার্চ অসুস্থ বোধ করলে তাঁকে কল্যাণপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।


সেখানে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাঁকে পরীক্ষা করে বলেন, তাঁর ধারণা, তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন। চিকিৎসক তাঁকে কোভিড-১৯ পরীক্ষারও পরামর্শ দেন।

এরপর ওই ভদ্রলোকের সন্তানেরা যোগাযোগ করেন আইইডিসিআরের নির্ধারিত হটলাইন নম্বরে। কেননা, সংস্থাটির কর্মকর্তারা তাঁদের গবেষণাগারে ভিড় না করে সবাইকে হটলাইনে যোগাযোগ করতে বলেছিলেন। অবশেষে দেড় ঘণ্টা চেষ্টার পর তাঁরা হটলাইনে একজনকে পেলেন। আইইডিসিআরের ভদ্রলোক রোগীর বর্ণনা শুনে বলেন, যেহেতু অসুস্থ ব্যক্তি বিদেশ থেকে ফেরেননি কিংবা বিদেশ থেকে ফিরেছেন এমন কারও সংস্পর্শে আসেননি, সেহেতু কোভিড–১৯ পরীক্ষার প্রয়োজন নেই।

এরপর তাঁকে বলা হলো, রোগী মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন। ফলে সেখানেও সংক্রমিত হতে পারেন। এর জবাবে আইইডিসিআরের ভদ্রলোক বলেন, করোনাভাইরাস এখনো জনসমাজে সেভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। অতএব আপনারা চিন্তা করবেন না, এটা সাধারণ শ্বাসকষ্টের ব্যাপার।

এরপর ওই অসুস্থ ভদ্রলোককে নিয়ে তাঁর সন্তানেরা একের পর এক হাসপাতালে ছোটাছুটি করেছেন। কোনো হাসপাতাল চিকিৎসা না করে তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছে। তাঁর শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়। সন্তানেরা দেখছেন, তাঁদের বাবা চোখের সামনে মারা যাচ্ছেন। হাসপাতালগুলোর কেউ বলছে, তাদের আইসিইউ নেই। কেউ বলছে, আইসিইউ থাকলেও এই রোগীকে ভর্তি করবেন না।

এভাবে দুই দিন দুঃসহ অবস্থার মধ্যে পার করে পুরো পরিবার। এরপর কল্যাণপুরের এক হাসপাতালের চিকিৎসক ফের আইইডিসিআরে পরীক্ষা করতে বললেন। সন্তানেরা যোগাযোগ করলেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও যোগাযোগ করল। কোনো সাড়া নেই। অবশেষ ১৯ মার্চ আইইডিসিআর রোগ পরীক্ষা করতে রাজি হয়। পরদিন তাঁর রিপোর্ট দেয় যে সত্যি ভদ্রলোক কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন।

এ তথ্য জানার পর যে হাসপাতালে ভদ্রলোক ভর্তি হয়েছিলেন, সেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দ্রুত তাঁকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যেতে বলে। লাইফ সাপোর্ট খুলে দেওয়ার তাগিদ দেয়। এমনকি রোগীর সঙ্গে কাউকে দেখাও করতে দেয় না। নিরাপত্তার জন্যই হয়তো সেটি করা হয়েছে। কিন্তু সন্তানেরা কীভাবে এই মৃত্যু মেনে নেন? ২১ মার্চ ভোররাত তিনটায় তিনি মারা যান।

ভদ্রলোকের মৃত্যুর পর বিভিন্ন মাধ্যমে নানা রকম প্রচারণা চালানো হচ্ছিল। তিনি ইতালি থেকে এসেছেন, তাঁদের অনেক আত্মীয়স্বজন বিদেশ থেকে এসেছেন। এতে পিতার মৃত্যুতে শোকাহত পরিবারটি আরও মুষড়ে পড়ে। অসত্য প্রচারণার জবাব দিতে গিয়েই তাঁর এক পুত্র প্রকৃত অবস্থা ফেসবুক স্ট্যাটাসে তুলে ধরেন। তাঁর এই বয়ানে বেদনা ছিল, কান্না ছিল, আর ছিল আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি ক্ষোভ। এই ক্ষোভ মিরপুরের পিতাহারা সন্তানের নয়। আরও অনেকের। যাঁরাই চিকিৎসাসেবা নিতে যান, একধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসেন। কেন এমনটি হবে?

এখনো তো করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রাথমিক অবস্থা নাকি, তাঁরা বলছেন। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক দশায় কী করবে আমাদের সরকারি সংস্থাগুলো?

আইইডিসিআর কেন ভদ্রলোককে পরীক্ষা না করে সাধারণ শ্বাসকষ্ট বলে ফিরিয়ে দিল? তারা কী করে নিশ্চিত হলো যে বাইরে থেকে না এলে কেউ এই রোগে সংক্রমিত হবেন না। বলা হয়েছিল যে, তিনি মসজিদে নামাজ পড়তেন। মসজিদে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ যান। কারও পক্ষেই চিহ্নিত করা সম্ভব নয়, কে বিদেশ থেকে এসেছেন।

সরকারের বিভিন্ন সংস্থা স্বীকার করেছে যে যাঁরা বিদেশ থেকে এসেছেন, তাঁদের খুব সামান্য অংশকেই কোয়ারেন্টিনে রাখা গেছে। বাকিরা অবাধে ঘোরাফেরা করছেন। সে ক্ষেত্রে আইইডিসিআরের ওই কর্মকর্তা বা কর্মী কীভাবে জানলেন, জনজীবনে এই ভাইরাস ছড়ায়নি? তাহলে কেন পুরো দেশে এখন অঘোষিত অচলাবস্থা চলছে?

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, করোনাভাইরাসে যত লোক আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গেছেন তাঁদের ৪-৫ শতাংশ। বাকিরা চিকিৎসায় ভালো হয়েছেন।

কিন্তু বাংলাদেশে সঠিক তথ্যটি জানা প্রায় অসম্ভব। কেননা, এখানে রোগ শনাক্ত করার ব্যবস্থাই নেই। ১৭ কোটি মানুষের জন্য দুই হাজার কিট। যেটুকু আছে, তাও অকার্যকর আইইডিসিআরের কর্মকর্তাদের খামখেয়ালিতে। আড়াই মাস চলে গেলেও সরকারের মন্ত্রীরা–আমলারা এখনো দেশবাসীকে অভয়বাণী শোনাচ্ছেন, রোগ নির্ণয়ের যন্ত্রপাতি আসছে। কিন্তু আপনারা এত দিন কোথায় ছিলেন, কী করছিলেন, তা দেশের মানুষ জানতে চায়।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক।