একসঙ্গে দুই ভাইরাস, করোনা ও গুজব

করোনাসংক্রান্ত দুটি মহামারি এখন একসঙ্গে চলছে—একটা ভাইরাসের, আরেকটা গুজবের। গোমূত্র পানে করোনা থেকে মুক্তি বা স্বপ্নে করোনার প্রতিষেধক পাওয়ার খবর লাখো–কোটিবার শেয়ার হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘করোনা দ্বারা সৃষ্ট কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসা এ মুহূর্তে আমাদের হাতে নেই, তবু বানোয়াট চিকিৎসার খবরে ফেসবুক ছেয়ে যাচ্ছে।’ ভুয়া খবরে বিভ্রান্ত হয়ে অ্যালকোহল, গরম পানি, ভিনেগার ইত্যাদি গিলে নিজেকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারেন যে কেউ। গুজব ও ভুয়া খবরে আক্রান্ত হচ্ছেন শিক্ষিত-অশিক্ষিতনির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। বাংলাদেশে করোনা মোকাবিলা করতে হলে করোনা গুজব মোকাবিলায় আমাদের দক্ষ হতে হবে। সে জন্য গুজব শনাক্তকরণ ও বিচারমূলক চিন্তায় দক্ষতা আমাদের দরকার।

গুজব থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য প্রথমত আমাদের মনে রাখতে হবে, কোনো তথ্য ‘বিশ্বাস’ কিংবা ‘অবিশ্বাস’ করা ছাড়াও তৃতীয় আরেকটা বিকল্প আছে, যা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা হচ্ছে তথ্যকে ‘বিবেচনাধীন’ রাখতে পারা। ইন্টারনেটের কল্যাণে প্রতিদিন আমাদের চোখের সামনে উদয় হচ্ছে বিপুল পরিমাণ তথ্য। কোনো একটা তথ্য বা খবর চোখের সামনে দেখলে আমরা মনে করি এটি এক্ষুনি হয় আমাকে বিশ্বাস করতে হবে, নয়তো অবিশ্বাস করত হবে। কিন্তু ‘বিবেচনাধীনতার’ একটা প্রকোষ্ঠ আমাদের মনের মধ্যে তৈরি রাখা দরকার। যেসব তথ্য বা খবর সত্য বা মিথ্যা বলে এ মুহূর্তে রায় দেওয়া যাচ্ছে না, সেগুলোকে আপাতত পাঠিয়ে দিতে হবে ‘বিবেচনাধীন’ প্রকোষ্ঠে। কোনো খবরকে বিবেচনাধীন রাখা মানে এর সত্যতা বা মিথ্যার বিষয়ে রায় স্থগিত রাখা, যেহেতু এ মুহূর্তে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ হাতে নেই। তড়িঘড়ি করে ভুল বিশ্বাস করার চেয়ে কিছু সময়ের জন্য রায় স্থগিত রাখা আখেরে বেশি উপকারী।

ভুয়া খবর থেকে বাঁচার প্রধান উপায় হচ্ছে খবরের উৎসের খোঁজ করা। অর্থাৎ নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে খবর জানা। করোনা আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ জানার সঠিক উৎস ডব্লিওএইচও বা আইইডিসিআরের ওয়েবসাইট বা তাদের কোনো প্রতিনিধির বক্তব্যের ভিডিও। এ ধরনের জাতীয় বা আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে পাওয়া তথ্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বাছাই করা বিশেষজ্ঞরা দিয়ে থাকেন। করোনাসংক্রান্ত তথ্যের জন্য এ ছাড়া নির্ভর করতে পারেন মেডিসিন, পাবলিক হেলথ, মাইক্রোবায়োলজি ও এপিডেমিওলজির বিশেষজ্ঞদের ওপর। করোনা পরিস্থিতি জানার জন্য দেশি ও বিদেশি প্রধান জাতীয় দৈনিকগুলোর (যেগুলোর অনলাইন ভার্সন খুব সহজলভ্য) ওপর নির্ভর করা ভালো। ফেসবুকের নাম-পরিচয়হীন উৎসের ওপর নির্ভর করলে আপনি বিভ্রান্ত হতে পারেন।

মূল ঘটনা, পরিস্থিতি বা বিষয়ের যিনি যতই কাছাকাছি, তিনি সাধারণত উৎস হিসেবে তত বেশি নির্ভরযোগ্য হন। আপনি হয়তো একটা খবর দেখলেন যে সাভারের এনাম মেডিকেলে ১০ জন রোগীর করোনা ধরা পড়েছে। যদি সন্দেহ হয়, নেট থেকে এনাম মেডিকেলের ফোন নম্বর বের করে সরাসরি একটা ফোন করে দেখতে পারেন। কোনো জেলার করোনা পরিস্থিতি বিষয়ে একটা পিলে চমকানো খবর দেখলেন। খবরের সত্যতা বিষয়ে সন্দেহ জাগলে ওই জেলার আপনার পরিচিত কাউকে ফোন করতে পারেন। ফেসবুকে একটা ভিডিওতে একজনকে জরুরি কিছু একটা বলতে শুনলেন। বিশ্বাস করে ফেলার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন ‘তিনি যে বিষয়ে বলছেন, সে বিষয়ে বলার জন্য তিনি কি যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য? কী উদ্দেশ্যে তিনি বলছেন? তাঁর কথার মধ্যে কি আগাগোড়া সংগতি আছে? তিনি কি আমার আবেগকে স্পর্শ করে, কথার ফুলঝুরি দিয়ে কিছু লুকাচ্ছেন বা আমাকে কোনো মিথ্যা গেলাতে চেষ্টা করছেন? আমি ইতিমধ্যে অন্য নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে বা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে যা জানি, তার সঙ্গে এই বক্তব্য কি সাযুজ্যপূর্ণ? এই ভিডিওটা কে, কখন, কেন তৈরি করেছে ইত্যাদি।

কেউ হয়তো বলবেন, বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রীয় সংস্থা থেকে বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কখনো কখনো মিথ্যাচার হয় বা তথ্য গোপন করা হয়। উদাহরণ হিসেবে চীন সরকার কর্তৃক প্রথম দিকে করোনা পরিস্থিতি বিষয়ে তথ্য গোপন করার কথা আসতে পারে। এ ধরনের ক্ষেত্রে সত্য জানার জন্য আমরা সাধারণ জনগণ প্রথমত নিজেকে প্রশ্ন করতে পারি, ‘সংস্থাটি কী ‍উদ্দেশ্যে তথ্য লুকাতে বা গোপন করতে পারে?’ আপনি বলতে পারেন, দেশে বা পৃথিবীতে করোনা আক্রান্ত আসলে কতজন বা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সত্যিকার করণীয় বিষয়ে অফিশিয়াল বিবৃতির প্রতি আপনি আস্থাশীল নন। এ ক্ষেত্রে প্রথমত করণীয় হচ্ছে, হুট করে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করার আগে বিচার-বিবেচনা করা। সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে নজর রাখা। আরেকটি করণীয় হচ্ছে, একটি মাত্র উৎসের ওপর নির্ভর না করে একাধিক উৎসের ওপর নির্ভর করা। যে তথ্যের সঠিকতা নিয়ে আপনার সন্দেহ হচ্ছে, সেটি অন্য একাধিক নির্ভরযোগ্য ভালো উৎস দ্বারা ক্রস চেক করে নিলে আপনি আরও নিশ্চিত হতে পারবেন। প্রশ্ন হচ্ছে, একাধিক ভালো উৎস থেকে যদি পরস্পরবিরোধী তথ্য পাওয়া যায়, তখন কী করণীয়? তখন ধৈর্য ধরতে হবে, সিদ্ধান্ত মুলতবি রাখতে হবে। অথবা নিজের কাণ্ডজ্ঞান, বিচারবুদ্ধি, ও সর্বোপরি, ইংরেজিতে যাকে বলে গাট ফিলিংসের (gut feelings) ওপর নির্ভর করে আপনার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

অনলাইনে খবরের নির্ভরযোগ্যতা যাচাইয়ের আরেকটা ভালো উপায় খবর পরিবেশনের ধরন খেয়াল করা। ভালো মানের সংবাদ প্রতিবেদনে সংবাদের উৎস উল্লেখ করা থাকে, এমনভাবে যে আপনি চাইলে নিজে সরাসরি উৎস থেকে খবরটার সত্যতা যাচাই করে নিতে পারবেন। আপনার ফেসবুক নিউজ ফিডে ভেসে বেড়ানো কিছু খবর খুঁটিয়ে পড়লে দেখবেন, এগুলোর ভাষা দুর্বল, বানান ভুল, বাক্য গঠনে ভুল। অর্থাৎ খবরটিতে থাকতে পারে তাড়াহুড়ো, অদক্ষতা ও অযত্নের ছাপ। ভুয়া খবর অনেক সময়ই চমকপ্রদ শিরোনাম দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা থাকে। খবর পড়ার সময় আমরা শুধু প্রতিবেদনটিতে কী দাবি করা হয়েছে, তা দেখব না। কিসের ভিত্তিতে, কী ধরনের যুক্তি ও তথ্য-প্রমাণের ওপর দাবিটিকে দাঁড় করানো হয়েছে, তা-ও খেয়াল করব। ভুয়া খবর ও গুজবগুলোতে উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই বড় বড় দাবি করা হয়।

সঠিক তথ্য জানার জন্য জরুরি সত্য জানার আকাঙ্ক্ষা। অনেক সময় সত্য এড়ানোর বা মিথ্যা বিশ্বাসের জন্য আমাদের মনের মধ্যেই পক্ষপাতিত্ব থাকে। আবার কখনো সত্য জানার জন্য যে সময় ও শ্রম দিতে হবে, তা এড়াতে আলসেমিবশত হাতের কাছের মিথ্যাতেই আমরা আস্থা রেখে ফেলি। করোনা পরিস্থিতিতে গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যুর খবর আমাদের আতঙ্কিত করে তুলছে। আমরা মরিয়া হয়ে এর সমাধান খুঁজছি। আমাদের আকাঙ্ক্ষা আমাদের মাত্রাতিরিক্ত বিশ্বাসপ্রবণ করে তুলছে এবং ফেসবুকের নিউজ ফিডে উদয় হওয়া অনেক পোস্ট আমরা যাচাই না করেই বিশ্বাস করে ফেলছি। আমাদের ভয় ও আকাঙ্ক্ষা আমাদের পক্ষপাতদুষ্ট (biased) করে দিচ্ছে। কিন্তু যা সত্য, তা কারও বিশ্বাস করা না-করার অপেক্ষা করে না। রবীন্দ্রনাথের বাণী স্মরণে রেখে ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চনা’ নীতি অবলম্বনই শ্রেয়।

আমাদের মনে রাখতে হবে, ছাপার অক্ষরে কিংবা কম্পিউটার বা মোবাইল স্ক্রিনে যা থাকে, তার সবই সত্য নয়। বাস্তবে আপনার চেনা পরিচিত মানুষদের মধ্যে যেমন সত্যনিষ্ঠ, সৎ, দায়িত্বশীল মানুষ আছে, তেমনি আছে মিথ্যাবাদী, প্রতারক, অসৎ ও দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ। ফেসবুকে হাজার হাজার মানুষ দ্বারা শেয়ারড ও ফরওয়ার্ডেড হয়ে শেষ পর্যন্ত আপনার কাছে আপনার বন্ধুর মাধ্যমে যে বার্তাটি পৌঁছেছে, তার মূল লেখক যে একজন সৎ ও দায়িত্বশীল মানুষ হবেন, এটা ধরে নেওয়ার কোনো মানে নেই। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে যে কেউ সামাজিক মাধ্যমে যা খুশি কিছু একটা লিখে ছেড়ে দিতে সক্ষম।

ভুয়া খবর শনাক্ত করার কাজটা কখনো সহজ, কখনো আবার বেশ কঠিন। সে কারণে উচ্চশিক্ষিত মানুষদেরও কখনো কখনো ভুয়া খবর শেয়ার করে বোকা বনতে দেখা যায়। কাজটা সব সময় সহজ না হলেও আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারি, যাতে ভুয়া খবর ও গুজবের শিকারে পরিণত না হই।

সাহিদ সুমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক