ভাইরাস মহামারি: বিপদে বিমূঢ়তা নয়, দরকার দক্ষতা

করোনাভাইরাস পরীক্ষা করতে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) আসছেন অনেকেই।  ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
করোনাভাইরাস পরীক্ষা করতে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) আসছেন অনেকেই। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

তামাম দুনিয়া আজ খুব বড় রকমের মুসিবতের মধ্যে পড়েছে। সমস্যাটা ভাত-কাপড়ের নয়, জীবন-মরণের। এক বেলা ভাত খেয়েও মানুষ বহুদিন বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু প্রাণঘাতী সংক্রামক রোগের মহামারির মধ্যে মানুষ মৃত্যুর ঝুঁকি এড়াতে পারে না। আমাদের শৈশবেও কলেরা ও গুটিবসন্তে গ্রাম উজাড় হতে দেখেছি। করোনাভাইরাসের মহামারির মধ্যে চীন, ইতালি ও ইরানের খবরাখবর শুনে এখনকার মানুষ সেকালের কলেরা-বসন্তের মহামারির অবস্থা কিছুটা অনুমান করতে পারেন।

দেশপ্রেম ও মনুষ্যত্ববোধ সব মানুষের মধ্যেই সুপ্ত থাকে। বিশেষ বিশেষ সময়ে তা প্রকাশের সুযোগ পাওয়া যায়। যেমন একাত্তরে আমাদের দেশাত্মবোধ প্রমাণের সুযোগ এসেছিল। তা ছাড়া, খুব বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মন্বন্তর ও মহামারির মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ প্রকাশের সুযোগ পাওয়া যায়।

চীনে করোনাভাইরাস মারাত্মক আকার ধারণ করার পর এই ভয়াবহ সংক্রামক রোগের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার নানা উপায় গণমাধ্যম থেকে প্রচারিত হয়। একেবারে প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসেবে নাকেমুখে মাস্ক ব্যবহারের কথা বলা হয়। কথাটি প্রচারিত হওয়ার পরবর্তী দুই দিনের মধ্যে বাজার থেকে মাস্ক উধাও হয়ে যায়। মজুতদারি ও কালোবাজারিতে বাঙালির জুড়ি নেই। ১০ টাকার দ্রব্যটি ১০০-১৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। একশ্রেণির দোকানি লাখ লাখ টাকা কামিয়ে নেন।

শুধু মাস্ক নয়, স্যানিটাইজার নয়, চাল-ডাল, তেল-নুন কেনার ধুম পড়ে যায়। চাহিদা বাড়লে দোকানদার বোকার মতো বসে থাকবেন না। সব জিনিসের দাম এক রাতের মধ্যে বেড়ে গেল। অবস্থাপন্নরা বেশি করে মজুত করতে থাকেন। তাতে পোয়াবারো ব্যবসায়ীদের। একটি ভয়াবহ মহামারির আশঙ্কা যেখানে, সেখানে মুনাফাখোরি কি না করলেই নয়! পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের মতো চালের ব্যাপারীরাও লুটে নিলেন শত শত কোটি টাকা। করুণা ও সততা শব্দ দুটি কি বাঙালির অভিধান থেকে তুলে দিতে হবে!

করোনা-আক্রান্ত দেশ থেকে যাঁরা দেশে এসেছেন, সরকার তাঁদের বলেছে ১৪ দিন ঘর থেকে বের না হতে, চিকিৎসাবিজ্ঞানে যার নাম কোয়ারেন্টিন। কিন্তু কার কথা কে শোনে? শ্বশুরবাড়ি যাওয়া, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করা, বাজারে গিয়ে চুটিয়ে আড্ডা দেওয়া, পিকনিকে যাওয়া, অর্থাৎ অবাধে চলাফেরা করা তাঁদের ফান্ডামেন্টাল রাইট। তাতে বাধা দেওয়ার অধিকার সরকারের নেই। তার ফলে বহু লোক সংক্রমিত হয়েছে। মারাও গেছেন দু-তিনজন। যেহেতু জীবাণুটি অতি দ্রুত একজন থেকে অন্যদের মধ্যে ছড়ায়, সুতরাং শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ায়, এখনই বলা যায় না। অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা হলো প্রথম সপ্তাহ থেকে দ্বিতীয় সপ্তাহে, দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় সপ্তাহে—এইভাবে জ্যামিতিক হারে রোগীর সংখ্যা বাড়ে।

সাধারণ নাগরিকেরাই-বা সরকারি নির্দেশ মানবে কেন? আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তারাই যখন আইন অমান্য করেন, সাধারণ নাগরিকদের দোষ দেওয়া যায় না। অগণিত দৃষ্টান্তের একটি। ‘করোনাভাইরাস ঠেকাতে জনসমাগম এড়ানোর নির্দেশনা না মেনে তিন শতাধিক অতিথি নিয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সিভিল সার্জন। তাঁর বাসভবনের পাশে জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদেরও বাসভবন। কিন্তু অনুষ্ঠানে বাধা দিতে যাননি তাঁদের কেউই। একই দিন বিজয়নগর উপজেলার একটি গ্রামে আয়োজন করা হয় এক ‘সাধারণ মানুষের’ মেয়ের বিয়ে। ওই বিয়ে বন্ধ করে মেয়ের বাবার কাছ থেকে মুচলেকা আদায় করে উপজেলা প্রশাসন। কনের বাবাকে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর মেয়ের বিয়ে দিতে বলা হয়।

সিভিল সার্জনের মেয়ের বিয়েতে অংশ নেন চিকিৎসক, বেসরকারি ক্লিনিকের মালিক, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিসহ অন্তত ৩০০ জন। খাওয়াদাওয়া চলাকালে ছবি না তুলতে অনুরোধ করেন ‘জেলার চিকিৎসক সংগঠনের এক নেতা’। [কালের কণ্ঠ, ২১ মার্চ]

বাংলাদেশে একই আইনের প্রয়োগ একাধিক। দুর্বলের ওপর একভাবে, ক্ষমতাবানের ওপর অন্য রকম। ‘সাধারণ মানুষের’ ওপর যা প্রযোজ্য, অ-সাধারণ ক্ষমতাবানদের—রাজনৈতিক নেতা ও কর্মকর্তাদের—ক্ষেত্রে তা নয়। শুধু কাজে নয়, কথাতেও বাংলাদেশে অ-সাধারণরা অনন্যসাধারণ। করোনাভাইরাসের মতো বিষয় নিয়েও প্রধান দুই দলের নেতারা এবং কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী যে ভাষায় পরস্পরকে আক্রমণ করে কথা বলছেন, তা করোনাভাইরাসের আক্রমণের কাছাকাছি। সরকারি দলের নেতারা এতই ক্ষমতাশালী যে কোনো ভাইরাস-টাইরাসকে তাঁরা পরোয়া করেন না। বিরোধী দলের এক নেতা, যিনি নিজেই বছর দুই যাবৎ দলের কার্যালয়ে একরকম কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন, তাঁর কথাবার্তা আরও গা-জ্বালাকারী। সরকারকে সমালোচনা করার সময় ও ভাষা আছে, প্রতিদিন বক্রোক্তি ও কাব্যিক অলংকারবহুল ভাষা উপভোগ্য নয়।

বলা হচ্ছে ঘরে থাকতে। ঘরে থেকে ভোট দেওয়া যায় না। ভোট দিতে গেলে ভোটকেন্দ্রে যেতে হয়। বাঙালির জীবন থেকে ভোটের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে, কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের কাছে নির্বাচন জীবন-মরণ সমস্যা। যে উপনির্বাচনগুলো হয়ে গেল, তার
কোনো প্রয়োজন ছিল না। ভালো হতো এক্সিকিউটিভ অর্ডার দিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে আড়াই লাখ ভোটে বিজয়ী এবং নিকটতম প্রার্থীকে ৮১৭ ভোট দেখিয়ে দিলেই। জাতির বিচার-বিবেচনা ও কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেলে পরিণতি শুভ হয় না।

যেকোনো রোগের অদৃশ্য জীবাণু বাতাসে ঘুরে বেড়ায়। তা বস্তিতেও যায়, প্রাসাদেও ঢোকে। কিন্তু আক্রান্ত বস্তির মানুষ আর অট্টালিকার মানুষ সমান সুবিধা ও চিকিৎসা পাবে না। বাংলাদেশের নগরগুলোতে বস্তির সংখ্যা ১৩ হাজার ৯৩৫ এবং শুধু ঢাকাতেই ভাসমান খানা ৪ লাখ ৩১ হাজার ৭৫৬। বস্তির বাসিন্দা ও ভাসমান মানুষের সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই, কোভিড-১৯ সম্পর্কে তো থাকার প্রশ্নই ওঠে না। হোম কোয়ারেন্টিনসহ যেসব বিধি মেনে চলার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা মেনে চলা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে তাদের কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে, তা করতে হবে শুধু তাদের স্বার্থে নয়, বিত্তবানদের স্বার্থে।

বস্তিবাসী রিকশা-ভ্যানচালক, তৈরি পোশাক কারখানার কর্মী, গৃহকর্মী, দিনমজুর, হকারদের সুরক্ষার ব্যবস্থা অন্যদের থেকে ভিন্ন হতে হবে। আশুলিয়া প্রভৃতি এলাকায় যেসব নতুন বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি হয়েছে এবং বাসিন্দারা ওঠেননি, সেগুলোকে দরিদ্র ছিন্নমূল মানুষের কোয়ারেন্টিনের জন্য ব্যবহার করা যায় কি না, ভেবে দেখা দরকার।

করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বাংলাদেশ আড়াই মাস সময় পেয়েছিল। সেই সময়ের সদ্ব্যবহার করা হয়নি। পরিস্থিতি গুরুতর আকার ধারণা করা পর্যন্ত অপেক্ষা করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়, পশ্চিমের দেশগুলোর নেতারা তা দেরিতে উপলব্ধি করছেন।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় করণীয় শুধু সরকারের নয়, প্রশাসনের নয়, সব মানুষের। মহামারি কোনো দলীয় বিষয় নয়, রাজনৈতিক বিষয় নয়, ধর্মীয় বিষয় নয়। এ ধরনের দৈবদুর্বিপাকে, সর্বজনীন বিপদের মধ্যে, সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে আত্মোপলব্ধির প্রয়োজন রয়েছে। এমন বিপদকে বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক উভয় দৃষ্টিতে দেখতে হবে। বিপদের সময় বিমূঢ়তা নয়, দরকার দক্ষতা। বিপদ-আপদ অনন্তকাল থাকে না; কিন্তু ভবিষ্যতের মানুষ বলবে সমস্যা মোকাবিলায় জাতি কতটা দক্ষতা-যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিল।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক