বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাব ফেলে রাখা হচ্ছে কেন

সব জাতির জীবনেই কিছু কিছু ক্রান্তিকাল আসে। স্বাধীনতাযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, ভয়াল বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস এবং আরও অনেক ছোট-বড় বিপর্যয়। বাংলাদেশের মানুষের একটি সুনাম আছে, তারা অন্য জাতির তুলনায় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে অনেক শক্ত প্রতিরোধযোদ্ধা।

আমাদের প্রজন্মের সামনে এখন সেই সময় উপস্থিত—করোনাকাল। আক্ষরিক অর্থেই এমন দুর্যোগ আমরা আগে দেখেনি। মানবসভ্যতা গত ১০০ বছরেও হয়তো দেখেনি। এই সংকট নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে উদ্ভূত। আক্রান্ত হচ্ছে লাখো মানুষ, মারা যাচ্ছে হাজার হাজার। কারও দিকে কারও তাকানোর সুযোগ নেই। এমন অবস্থায় নিজেদের যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া ছাড়া আর কোনো গতি নেই।

আমরা এবার লড়ছি এক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে। কিন্তু বিজ্ঞান আমাদের অনেক কিছুই জানিয়েছে। আমরা সেই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নিজেদের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করতে পারি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশের সামর্থ্যগুলো এখনো সঠিকভাবে ব্যবহারের জন্য সমন্বয় করা হয়নি। আইইডিসিআর নামে একটি প্রতিষ্ঠান মাসের পর মাস একা এই ভয়ংকর বিপদ সামলানোর দায়িত্ব নিজের হাতে নিয়ে রেখেছে। অথচ চেষ্টা করলে দেশের এবং দেশের বাইরের বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞদের আমরা এই বিপদের সময় কাজে লাগাতে পারি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, এই সংক্রমণ থামানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে আক্রান্ত ব্যক্তিদের পরীক্ষা করা এবং তাদের আলাদা রাখার ব্যবস্থা করা। সামাজিক দূরত্বায়ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সরকারকে এ বিষয়ে অত্যন্ত সক্রিয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সে রকম কিছু এখনো চোখে পড়েনি। ছুটি পেয়ে মানুষজন বেড়াতে বের হচ্ছে। এ বিষয়গুলো আরও কঠোরভাবে থামাতে হবে। এই দেশের মানুষ দিনের পর দিন হরতাল, ধর্মঘটের কারণে ঘরে থাকতে বাধ্য হয়েছে, তাদের এখন জাতীয় প্রয়োজনে ঘরে থাকতে হবে।

সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, যেহেতু এই সংক্রমণ খুব দ্রুত একজন থেকে আরেকজনে ছড়ায়, সেহেতু আক্রান্ত ব্যক্তির সংক্রমণ বুঝতে পারার জন্য টেস্ট করাটা এখন প্রথম কাজ। কিন্তু সেই কাজটাই করা যাচ্ছে না। শুধু একটি জায়গায় টেস্ট করার ব্যবস্থা রাখা একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।

আমাদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এই টেস্ট করার সক্ষমতা আছে। যেকোনো জৈব নমুনায় ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত করার সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হচ্ছে আরটি-পিসিআর। এই পদ্ধতিতে ভাইরাসের আরএনএকে ডিএনএতে রূপান্তর করে তারপর সেই ডিএনএকে পিসিআর করা হয়। গবেষণার কাজে আমরা নিয়মিত এসব টেকনিক ব্যবহার করি। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে ডেঙ্গু ভাইরাস নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছি। আমি জানি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণাগারে একই কাজ করা হয় বা করার সামর্থ্য আছে। এখন জাতির প্রয়োজনে এগুলোকে ব্যবহার করতে হবে।

এ ছাড়া দেশের বাইরে বিশেষত চীন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, কানাডা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আমাদের প্রবাসী বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। তাঁরা অনেকেই সহযোগিতা করতে চেয়েছেন। এই মুহূর্তে সরকারের একটি বিশেষ ‘সেল’ তৈরি হওয়া দরকার, যার কাজ হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কাছে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সুবিধা সম্বন্ধে তথ্য চাওয়া এবং তারপর সেগুলো সমন্বয় করে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা। HEQEP প্রজেক্টের অধীনে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও উন্নয়নকাজে অনুদান দিয়েছে। তাদের কাছেও রিপোর্ট আছে সেই অনুদান ব্যবহার করে কী কী যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে, সে সম্বন্ধে। ইউজিসির কাছে তথ্য চাওয়া হোক আমাদের সক্ষমতা সম্বন্ধে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সব ল্যাব না হলেও কিছু কিছু ল্যাবকে নির্দিষ্ট সরঞ্জাম দিয়ে নতুন এই ভাইরাসের উপস্থিতি টেস্ট করার জন্য প্রস্তুত করা যায়।

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মলিক্যুলার বায়োলজি বিষয়ে কাজ করার প্রায় সব রকমের যন্ত্রপাতি রয়েছে। এবং সেগুলো পৃথিবীর বড় বড় গবেষণাগারের সঙ্গে তুলনীয়। এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য যে কেমিক্যাল ও রিএজেন্ট দরকার, তার একটা সংস্থান করতে পারলে আমরা এদের কাজে লাগাতে পারব।

পৃথিবীর সব বড় বড় রিএজেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে সার্স কভ-২ টেস্ট করার জন্য আলাদা রিএজেন্ট তৈরি করেছে। সেগুলো অল্প সময়ের জন্য কিনে আনা যায়। কুরিয়ার কোম্পানি যেমন ফেডেক্স বা ডিএইচএলের সঙ্গে আলাপ করে এ ব্যবস্থা করা খুব একটা কঠিন নয়।

অনেকেই বলতে পারেন, শুধু টেস্ট করে কী লাভ হবে? লাভ তো অবশ্যই হবে। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত না হয়েও যারা হাসপাতালে চিকিৎসা পাচ্ছে না তারা। হাসপাতালগুলো সন্দেহবশত রোগী ভর্তি করাচ্ছে না। যত বেশি টেস্ট করার সুবিধা পাওয়া যাবে, তত বেশি জীবন আমরা বাঁচাতে পারব। শুধু টেস্ট নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেসব ওষুধ ব্যবহারে সফলতা পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো নিয়েও আমাদের গবেষণা চলতে পারে। কোনো গবেষণাগার একা একা এ কাজে হাত দিতে পারবে না। যাঁরা এই টেস্ট বা গবেষণার সঙ্গে যুক্ত হবেন, তাঁদের জন্যও কিছু নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশে আইসিডিডিআরবির সহযোগিতায় এই নিরাপত্তা কৌশল ঠিক করা যায়।

আমি বলতে চাচ্ছি, এই কঠিন বিপদ মোকাবিলায় আমাদের হাত-পা বেঁধে বসে থাকলে চলবে না। হয়তো একটি আদর্শ অবস্থায় যুদ্ধ করার জন্য সবকিছু আমাদের হাতে নেই। কিন্তু আমাদের যা কিছু আছে, তা ব্যবহার করতে পারলেও এই যুদ্ধে আমাদের জয়ের সম্ভাবনা বাড়বে।

ড. মুশতাক ইবনে আয়ূব: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।
[email protected]